Advertisement

উন্মেষ

লোক থেকে শহর : শিল্পতাত্ত্বিক পথরেখায় একটি দেশ

nafiul weeklyunmesh.com

নাফিউল হক

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আধুনিকতার এক দুর্বোধ্য সংকটের মধ্যে জন্ম নিয়েছে—একদিকে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, অন্যদিকে ভাষা, ভূমি ও সংস্কৃতির জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এই দ্বৈত নির্মাণ আমাদের সাংস্কৃতিক বয়নকেও চিহ্নিত করেছে এক টানাপোড়েনপূর্ণ গতিপথে—যেখানে লোকজ ও শহুরে, প্রথাগত ও আধুনিক, আত্মীয়তা ও বিচ্ছিন্নতা একে অন্যের শরীর ছুঁয়ে ছিন্ন হয়েছে বারবার।

লোকজ সংস্কৃতি কোনো 'অতীত' বা 'গ্রাম' বিষয় নয়, বরং একটি নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক শরীর যা ভাষা, সংগীত, চিত্রকলা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনের আচার এবং উৎপাদনের কাঠামোর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বাংলার লোকসংস্কৃতি মূলত মৌখিক ঐতিহ্যে গঠিত—যেখানে গান, আখ্যান, মিথ, লোককাহিনি, প্রবাদ-প্রবচন, এমনকি শ্রমের ছন্দও এক ধ্রুপদ রচনার রূপ নেয়।

লোকসংস্কৃতির ভিত্তি হলো গোষ্ঠীভিত্তিক অভিজ্ঞতা। একজন বাউল যখন একতারা বাজিয়ে গায়—“মনরে কাহারে বলব, আমারে জাগাইল কে?”—তখন সেটি শুধু ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের ডাক নয়, বরং নিপীড়িত শ্রেণির এক আত্ম-অন্বেষণও। একইভাবে মৃৎশিল্পে ব্যবহৃত প্রতীক, কাঠের নকশা, বা নকশিকাঁথার সূচিফোঁড়েও লুকিয়ে থাকে এক নারীর সংসারজীবন, যুদ্ধ, যন্ত্রণা ও আশা। এই লোকসংস্কৃতি তাই কেবলমাত্র শিল্প নয়, বরং প্রতিরোধ, স্মৃতি ও অস্তিত্বের ভাষা।

আধুনিক শিক্ষা, ছাপাখানা, রেললাইন, নগর প্রশাসন—উনিশ শতকে বাংলার সমাজে যে পরিবর্তন আসে, তা একদিকে 'উন্নয়ন'—অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক চর্চায় এক নতুন ধারা এনেছিল, কিন্তু এই ধারা গড়ে ওঠে পাশ্চাত্য নন্দনতত্ত্ব ও প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভিত্তিতে। এই সময়েই লোকজ শিল্পকে “নিম্ন”, “অপরিণত”, “অশিক্ষিতদের শিল্প” হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা শুরু হয়।

শহুরে সংস্কৃতির এই আধুনিকতাবাদী নির্মাণ বাংলা নাটক, কবিতা, উপন্যাসে এক নতুন আত্মচেতনা তৈরি করলেও, তা ছিল লোকজ সত্তা থেকে পৃথক। শহুরে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা গ্রামকে নস্টালজিয়া হিসেবে ব্যবহার করলেও, লোকজ শিল্পীকে আর নিজের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করেননি। ফলে লোকজ-শহুরে সম্পর্ক হয়ে পড়ে একরকম সাংস্কৃতিক শ্রেণি-রাজনীতির বিষয়।

তবে শহুরে শিল্পচর্চা লোকজ উপাদান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল না। বরং সেটি ছিল একরকম 'উপাদানগত পুনঃব্যবহার'—যেখানে লোকজ সুর, ভাষা বা চিত্ররীতি ব্যবহার করা হয় কিন্তু তার দার্শনিক ভিত্তিকে উপেক্ষা করে। নাট্যকার সেলিম আল দীনের নাটকে যেমন গ্রামীণ ভাষা ও আচার ব্যবহৃত হয়, কিন্তু তাও এক শহুরে মঞ্চভাষ্যে রূপান্তরিত হয়ে যায়। লোকসংগীত নিয়ে কাজ করেছেন অনেকে, কিন্তু খুব কমই তার অন্তঃসারকে বুঝেছেন—যেমন লালনের ভাবতত্ত্ব, বা ভাটিয়ালির নদীমাতৃক দর্শন।

লোকজ উপাদানকে শহুরে চাহিদার অনুকূলে বিকৃত করা হয়েছে বারবার। ফোক ফেস্ট থেকে শুরু করে ফিউশন ব্যান্ড, লোকজ ভাষা থেকে ফ্যাশন হাউজ—সবখানেই লোকজ চেতনা নেই, আছে লোকজ ‘স্টাইল’। এই সংকট 'কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন'-এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
এই সংকটের মধ্যেও কিছু শিল্পধারা এবং আন্দোলন লোকজ চেতনাকে পুনরুদ্ধার করেছে। গণসঙ্গীত, গণনাট্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন পোস্টার, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের কাজ—সবই লোকচেতনার সঙ্গে আধুনিক প্রতিবাদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। বাউল তত্ত্বকে যে কেবল আধ্যাত্মিকতা নয়, বরং অস্তিত্ববাদী প্রতিরোধ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়, তা প্রমাণ করেন কিছু গবেষক ও শিল্পী।

চিত্রকলায় গিয়াসউদ্দিন সেলিম বা শিল্পী কাজী গিয়াসদের কাজেও আমরা দেখি ক্যানভাসে পটের আখ্যান প্রবেশ করছে। পুতুলনাচ, পটচিত্র, পুঁথিপাঠকে কেউ কেউ আবার পারফর্মেন্স আর্টের আঙ্গিকে নতুন করে হাজির করছেন। এ এক সাংস্কৃতিক পুনর্দখলের ভাষা, যেখানে শহুরে কাঠামোতেই লোকজ আত্মা প্রবেশ করছে এক প্রতিস্পর্ধার আত্মবিশ্বাসে।

আজকের শহর মানেই শুধু কংক্রিট নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক সংগ্রামক্ষেত্র। গ্রাম থেকে আগত শ্রমজীবী, নগরের প্রান্তে থাকা বস্তিবাসী, বা মধ্যবিত্ত তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা লোকজ স্মৃতি ও অভ্যাস এক নতুন সাংস্কৃতিক নক্সা গড়ছে। ফেসবুক, ইউটিউব, মেট্রোস্টেশনের দেয়াল—সবখানেই লোকজ রেফারেন্স ছড়িয়ে পড়ছে। এটি নিছক 'ফোক রেনেসাঁ' নয়, বরং এক নতুন সাংস্কৃতিক রাজনীতির সূচনা।

লোকজ সংস্কৃতি এখন আর শুধু গ্রামে নেই—তবে শহরে সে এসেছে কি নিজের ভাষায়? নাকি একটি নতুন ভাষা নির্মাণ করেছে শহুরে অভিজ্ঞতার আলোয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, লোকজ সংস্কৃতির প্রাণ হলো ‘সম্মিলিত স্মৃতি’ এবং ‘দৈনন্দিনতা’। শহর সেই সম্মিলন ভেঙে দেয়, আবার নতুনভাবে গড়ে তোলে।

বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির গতিপথ লোক থেকে শহর—এটি কেবল একটি গমন নয়, বরং একটি গহ্বরও। লোকজ শিল্প, সংগীত, ভাষা ও দর্শনকে বাদ দিয়ে আধুনিকতা শুধু এক ধরনের নকলনবিশ নাড়িভাঙা আত্মপরিচয় তৈরি করে। আমাদের প্রয়োজন এমন এক শিল্পতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা লোক ও শহরের দ্বৈততাকে অতিক্রম করে—একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক, বহুস্বরিক, প্রতিরোধমুখী ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে।

Post a Comment

0 Comments