ঊনিশ শ ঊনত্রিশ সালের একটা রাত, সম্ভবত বিশ্বে অঘ্রাণ, তিন কুড়ি বছর আগে ঠিক এই দিনে মাল্যবান জন্মেছিলেন। ঘটনাটি ১৯২৯ সালের হলেও জীবনানন্দ দাশ যখন মাল্যবানের সেই রাত্রির কঠিন অপ্রেমের কাহিনি বিবৃত করেছেন তখন ১৯৪৮ সাল। আর উপন্যাসটি প্রকাশিত হল জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর কুড়ি বছর পর। যেন ‘বছর কুড়ি পরে তাঁর সাথে দেখা হয় যদি'। উপন্যাসটি লিখবার পর জীবনানন্দ দাশ খুব বেশি দিন জীবিত ছিলেন না, বছর ছয়েকের মধ্যেই তিনি ট্রামাহত হয়ে মারা গেলেন। জীবনানন্দ দাশের অভ্যাসই ছিল প্রথম লেখার পর কিছুদিন ফেলে রাখা, তারপর সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্নভাবে তা প্রকাশ করা যায় কিনা তার উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ উপন্যাসের ক্ষেত্রে সে সৌভাগ্য জীবনানন্দ দাশের হয়নি। কিন্তু ১৯৭৩ সালে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর কুড়ি বছর পরে উপন্যাসটি যখন প্রথম প্রকাশের মুখ দেখতে যাচ্ছে তখনও উপন্যাসটির ভূমিকা লিখতে অমলেন্দু বসু পাঠকের কাছে আবেদন করেছেন, 'জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে যাদের চিত্ত অনুরণিত হয়েছে তারা অন্তত এই উপন্যাসের ত্রুটিগুলোও যেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন।' জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর কুড়ি বছর পর মাল্যবানই ছিল তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। কিন্তু তখন কে জানত, ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর যে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হয়েছে, সেই জীবনানন্দ দাশ কেবলই ছিলেন কবি, যার কাব্য-শক্তির প্রাবল্য বাংলা কবিতার পাঠককে ক্রমান্বয়ে বেষ্টন করে চলেছে; কিন্তু কথাশিল্পী জীবনানন্দ দাশ, যাকে জানা তখনও আমাদের সম্পূর্ণ হয়নি।
১৯৭৩ সালে 'মাল্যবান' প্রকাশের মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম পদস্থাপন হলেও সে যাত্রা এখনও সমাপন হয়নি। আমাদের চোখের সামনে ক্রমান্বয়ে খুলে যাচ্ছে তাঁর কথাসাহিত্যের অমূল্য সব অপ্রকাশিত ভাণ্ডার এবং তা এখনো তেমন স্বীকৃত হয়নি। কেননা উপন্যাস পাঠের কষ্টকর অভিজ্ঞতা আমাদের পাঠকের তেমন নেই বলা চলে। সেক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ কবি হিসেবে এতদিনের নিজের অবস্থানটি যেভাবে সুদৃঢ় করেছেন, কথাসাহিত্যিক হিসেবে এখনও তা অনির্ণিত রয়ে গেছে। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, কবি হিসেবে জীবনানন্দ দাশ আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন, কথাসাহিত্যিক হিসেবেও তার তেমন একটা প্রাপ্য রয়ে গেছে, যা এখনও আমরা তাঁকে দিতে পারিনি। তিনি মনে করতেন, 'পরিণতিশীল জীবনকে সজাগ ও শালীন করে তোলার ভার কবিতার উপর আমার মনে হয় তেমনি উপন্যাসের উপরও। তেমনি মহৎ ঔপন্যাসিকের ভাবনা সূক্ষ্ম, হৃদয় আন্তরিক, অভিজ্ঞতা সজাগ ও চেতনা-অবচেতনা ঐকান্তিকভাবে সক্রিয়, ব্যবহারিক পৃথিবীতে ও রকম মানুষের কাছ থেকে জীবনের উন্নতিশীল ভাঙ্গা-গড়ায় কাজে শুভ ও সার্থক আত্মনিয়োগ দাবি করা যেতে পারে। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, লেখকতো দ্রষ্টা তার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে আগামী মানুষের জন্য। অর্থাৎ উচ্চ মূল্যের সাহিত্য তার সমকালের পাঠকদের চোখের বাইরে থাকলেও আগামী পাঠকদের কাছে তা যথার্থ বলে প্রতিয়মান হয়। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অবশ্য আমরা এসব কথা অধিকাংশই জীবনানন্দ দাশের কবিতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকি। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কথাসাহিত্য যদি আরও দূর সময় এগিয়ে থাকে তাহলে কি আমাদের আশ্চর্য হবার কিছু আছে?
প্রথমেই উল্লেখ করেছি ১৯২৯ সালের মাল্যবানের এক রাত্রির জীবনানুভব ও জীবনাচরণ জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৮ সালে বিবৃত করেছেন, আর সেটি তাঁর মৃত্যুর বিশ বছর পর বই আকারে বেরুচ্ছে। কিন্তু প্রকাশক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিঃসংশয় হতে পারছেন না তার সাহিত্য মূল্য নিয়ে, বরং বিষয়টিকে তাঁরা দেখছেন একজন মহৎ কবির বিক্ষিপ্ত সৃষ্টি-প্রায়াস হিসেবে। ভূমিকাতে তো বলাই হচ্ছে, উপন্যাস হিসাবে মাল্যবান প্রচুর সম্ভাবনাময়, কখনো কখনো কৃতিত্বে উজ্জ্বল গ্রন্থটির প্রকাশকাল আরও দুই যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে, ইতোমধ্যে ঢাউস ও ক্ষুদ্রাকার আরও গোটা সাতেক উপন্যাস এবং বেশকিছু গল্প প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। কিন্তু কথাশিল্পী জীবনানন্দ দাশের প্রতিষ্ঠা কী হয়েছে? কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রায় একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ও খ্যাতি এসেছিল। রবীন্দ্রোত্তর যুগে বাংলা কবিতাতে যেমন জোয়ার এসেছিল, তেমনি কথাসাহিত্যের ভূগোলেও আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। কবিতার কথা স্বীকৃত হলেও কথাসাহিত্যের পরিবর্তনের কারিগরদেরও যে অন্যতম প্রধান জীবনানন্দ দাশ-সে কথা আমাদের জানা হয়নি। প্রথমত, তিরিশের তিন বন্দোপাধ্যয়ের সঙ্গে তার নাম উচ্চারিত হয়নি। এখন পর্যন্ত কথাসাহিত্য নিয়ে লেখা অধিকাংশ গ্রন্থে জীবনানন্দ দাশ প্রায় অনুপস্থিত। তাহলে কি জীবনানন্দ দাশ অনুপস্থিত থাকবার মত একজন লেখক না কি তাঁর প্রেমহীন, ক্ষমাহীন কঠিন উপন্যাস আমাদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। অবশ্য এর জন্য জীবনানন্দ দাশও কম দায়ী নন, তিনি তো আমাদের জানতেই দেননি তাঁর কথাসাহিত্যের এই রহস্যঘন রূপটির কথা।
জীবনানন্দ দাশ যখন উপন্যাস লেখা শুরু করেছেন, তখনও দেশের উপন্যাসে শরৎচন্দ্র প্রবল পরাক্রম বিরাজিত। এবং উপন্যাস পাঠকরা শরৎচন্দ্র-মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন। কেবল তাই নয়, আবহমান কাল থেকে বাংলার রমণীকুলের লক্ষ্মী ও কল্যাণময়ীরূপের প্রতিষ্ঠা তিনি সুদৃঢ়ভাবে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেন তিনি প্রতিষ্ঠা করেই শুরু করেছিলেন নারী মানেই সর্বংসহা মাতৃরূপিণী। তাঁর নায়িকারা মহিমা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পাঠকের অন্তরে। বিয়ে এবং প্রেম কামনার জন্য শরৎচন্দ্রের নারীরা মডেল হয়ে উঠেছিল। এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অল্পবয়স্ক কুমারী মেয়েরা নিজেদের শরৎ উপন্যাসের নায়িকাদের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করত। আর বয়স্করা, বিধবারা বড়দিদি, মেজদিদি, বিরাজ বৌ, শুভদার মতো ভাবতে ভালবাসত। শরৎচন্দ্রের যুগে অন্তত পুরুষের একটি নিশ্চিত আশ্রয় থাকত। সেই আশ্রয় মাতৃরূপিণী স্ত্রী কিংবা শ্রীকান্তের মতো স্ত্রী গলগ্রহ হয়ে পড়বে। বৌয়ের সিন্ধুক খুলে গয়না চুরি করে গাঁজা খেয়ে আসবে, জুয়ার আসরে পয়সা খুইয়ে আসবে, তারপর ফিরে আসলে শুভদার মতো স্ত্রী পরম মমতায় আঁচলের তলে টেনে নেবে। শরৎচন্দ্রের এসব স্ত্রী চরিত্র বুঝি রামায়ণের গার্হস্থ্য জীবনের মধ্য থেকে উৎসারিত হয়েছিল, মৃত্তিকাকন্যা সীতা প্রিয় চরিত্র বুঝি রামায়ণের সংস্থিতা। শরৎচন্দ্রের পরে বাংলা উপন্যাসের ধরনটি যারা পাল্টে দিয়ে ছিলেন, জীবনকে নির্মম এবং কঠোরভাব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, প্রেম-রিংরসায় নারী-পুরুষের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, জীবনের অস্তিত্বহীনতার এবং অতি সাধারণ মানুষের সংগ্রামশীলতা যারা উপন্যাসে এনেছিলেন তারাও কিন্তু নারীর সেই কল্যাণমতী রূপ খুব একটা ব্যাহত করেননি। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক সবার সম্পর্কেই এ ধরনের কথা বলা যায়। কিন্তু তাদেরই সমকালে, সকল নারীচরিত্রকে জীবনানন্দ যেন চ্যালেঞ্জ করেছেন। সকল নারীচরিত্রের সামনে যেন এককভারে উৎপলাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই আজ একটা প্রশ্নের উদয় হওয়া স্বাভাবিক স্ত্রী চরিত্রের স্রষ্টা হিসেবে কে বেশি সার্থক, জীবনানন্দ দাশ না জীবনানন্দ দাশ-পূর্ব ঔপন্যাসিকগণ?
অবশ্য কারো ছোটত্ব এবং বড়ত্ব খুঁজে দেখা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কেবল এ কথা বলা যায়, জীবনানন্দ দাশের ‘মাল্যবান' সমকালে এবং সীমিত চিত্রের মধ্যে আশ্চর্য শিল্পশক্তির প্রমাণ রেখেছে চরিত্রায়নে, কথোপকথনে কাহিনির গতিতে। সত্য, এ উপন্যাসে মহাকাব্যের দ্যোতনা নেই, কিন্তু একটি জীবনের অপ্রেমের অত্যাশ্চর্য অথচ আকড়া সত্য সব ঘটনা রয়েছে। তাছাড়া উপন্যাসের নায়ক মনের দিক দিয়ে অন্তত গড়পরতা বাঙালি নয়। মাটির নিচে গেড় আর কন্দ খাওয়া শুয়োরের মত (আপার গ্রেডের) অফিসারগিরিই তার সব নয়। এক জোড়া রেশমি স্টকিং, বার্ণিশ করা নিউ কীট তসরের কোট, পরিপাটি টেরি, সিগারেট কেস ও ফুটবল গ্রাউন্ডের বেঞ্চি দিয়ে নিজেকে চোখে ধরাতে সে ভালোবাসে না। এসবের চেয়ে সে আলাদা। সেই আলাদা সংস্থাপনই উপন্যাসের মূল কাহিনি। ঔপনিবেশিক আমলের একজন বি.এ পাশ কেরানি মাল্যবান। অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করবার সাধ ছিল, অনেক জিনিস শিখতে ইচ্ছে, বুঝতে ইচ্ছা ছিল। নিজের মনটা যে নেহাত কেরানির ডেস্ক আটা নিরেট নিরস কিছু নয়, মানুষকে সেটা বোঝাবার ইচ্ছা মাল্যবানের মধ্যেও ছিল। নানা রকম ইচ্ছে মনে। অনেক রকম ভাল সু-শৃঙ্খল কাঠকাঠামোর কথা জেগে ওঠে তার মনে, এসব কথা মানুষকে জানাতে ইচ্ছে করে মাল্যবানের। এক এক সময় তার মনে হয়, অফিসের কাজ ছেড়ে নিজের জীবনটাকে মহৎ কাজে নিবেশ করতে। যেমন, উত্তেজনাময় কর্মীসঙ্গের মধ্যে জীবনটাকে এরকম অফিসে চেপে সাপটে মেরে লাভ কি? তার কাছে টাকা পরিবারের সচ্ছলতা এগুলোকে ঘাসের বিচি, ধন্দুলের বিচি, রামকার্পাসের আটি বলে মনে হয় এক এক সময়। স্টিক হাতে নিয়ে গোল দীঘিতে ঘুরতে ঘুরতে এক এক সময় তার মনে হয়, একটা বড় বাজপেয়ে সভায় বেশ মার্জিত ভঙ্গিতে আবেগের বিরাট অকুল পাথারে নিজেকে আশ্চর্যভাবে নিয়ন্ত্রিত করে বক্তৃতা দেবার অদ্ভুদ ক্ষমতা আছে তার, পলিটিক্সে বাঙ্গালিরা আজকাল গুজরাটি মারাঠি মাদ্রাজি ইড-পিলনদের কাছে পদে পদে ভূঞ্জু খেয়ে ফিরছে- ভাবতে ভাবতে রক্ত কেমন যেন হয়ে ওঠে মাল্যবানের। বাঙালির মানসম্মান ফিরিয়ে আনবার জন্য বড় নয়াল আগুনের মত দাউ দাউ করে উঠতে ইচ্ছা করে তার। বিপ্লব থেকে বিপ্লবে ফ্রান্স, রুশ, স্পেন, চীন সমস্ত বিপ্লবের ইয়ে স্তনাগ্রচূড়ায় নতুন দুগ্ধের উল্লাস নবীন পৃথিবীর জন্য। তারপর ফুটবল মাঠের ঠাণ্ডা মেঝেতে বসে এসব কাল ভুলে যায় মাল্যবান। মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত বাঙালি যুবকের এই আকাড়া করুণ পরিণতি তার আগে কিংবা পরে আর কোনো উপন্যাস ধারণ করতে পারেনি।
ঊনিশ শ ঊনত্রিশ সালের একটা রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে মাল্যবান এসব কথা ভাবছিলেন। সম্ভবত বিশে অঘ্রাণ। কিছুতে ঘুম আসছে না। এই রাতে মাল্যবান জন্মেছিলেন। নিচের পলেস্তরা খসা স্যাত স্যাতে একটি ঘরে মাল্যবান ঘুমায়। দোতলার ঘরে থেকে তার স্ত্রী উৎপলা আর ন বছরী কন্যা মনু। অঘুম মাল্যবান দোতলার ঘরে উঠে আসে। হয়তো মশারিটা থুরথুরে পাড়াগাঁর পৌষরাতের নিশ্চুপ ডানার পাখির মত এসে স্নিগ্ধ নৈঃশব্দ্যে এসে জাকিয়ে বসে থাকতে চায়। কিংবা নেটের মশারি তুলতেই ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াল। উৎপলা জেগে উঠে প্রথমে খুব খানিকটা ভয় খেল, তারপর বিছানার ওপর উঠে বসে তার সুন্দর মুখের বিপর্যয়ে মুহূর্তেই সে ভাবটা কাটিয়ে উঠে মরা নদীর বালির চেয়েও বেশি বিরসতায় বললে তুমি! তারপর উৎপলার অসম্ভব সব অপ্রেমের সংলাপ। অথচ 'মাল্যবানকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রুচির বিরুদ্ধে, অপ্রেম, কামনার টানে, বেশি লালসায়, রিরংসায় উৎপলার মত একজন ভাল বংশের সুন্দর শরীরের নিচু কাণ্ডজ্ঞানের নিরস মেয়েমানুষের কাছে ঘুরে ফিরে আসতে হবে, নিজের মৃত্যু পর্যন্ত কী নিদারুণভাবে। কেমন অধমের মত, কেমন হাতে পায়ে ধরে মেয়েটির, কখনো বা ঘরে শান্তি কখনো বা বাইরের সুনাম রক্ষা করবার জন্য। কখনো বা লালসা, অতিক্বচিৎ প্রণয় এসে উৎপলার দিকে মাল্যবানকে টানছে বলে।
মাল্যবানকে স্বামী স্ত্রীর সংসারের মধ্যে অন্ত্যজ শ্রেণির মতো বাস করতে হয়। দোতলার বাথরুমে মাল্যবানকে চান পর্যন্ত করতে দেয় না উৎপলা। এই উপন্যাস থেকে এটা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। নায়ক চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহ এই উপন্যাসের প্রধান আঙ্গিক কৃতিত্ব এবং এই কৃতিত্ব পরিচ্ছন্ন রচনাশৈলীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তার স্বাধীন নিজস্ব মূল্য সংযুক্ত হয়ে উপন্যাসটিকে তার স্বাধীন নিজস্ব মূল্য দিয়েছে। অনেকেরই ধারণা ‘মাল্যবান’ জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিগত জীবনবোধ ও জীবনাত্যাচারের কাহিনি। কেউ কেউ মনে করেন উৎপলার মধ্যে লাবণ্য দাশের প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা অবশ্য তা মনে করি না। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন জাতশিল্পী। সমকালের এবং তৎপরবর্তীকালের আত্মা তিনি তার সাহিত্যকর্মে ধারণ করতে পেরেছিলেন। মাল্যবান ছাড়া বাংলা কথাসাহিত্যের আলোচনা কী করে সম্পন্ন হতে পারে তা ভাবতে কষ্ট হয়। কেবল ‘মাল্যবান’, ‘বাঁশমতির উপাখ্যান’ ‘প্রেতিনীর সংসার’, ‘বিভা’, ‘কারুবাসনা’, জীবনপ্রণালী'র মতো বিষ্ময়কর সব উপন্যাস লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ। কবি হিসেবে নয়, কথাসাহিত্যে তার মূল্য নির্ধারণের সময় এসেছে। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসে যদি কোনো শ্রেণিবিন্যাস করা হয়, তাহলে একটি শ্রেণির প্রথম এবং প্রধান প্রতিষ্ঠাতার নাম জীবনানন্দ দাশ। এমনকি বঙ্কিম-পরবর্তী প্রধান ঔপন্যাসিকদের সঙ্গে তাঁর পাঠ জরুরি।
১৯৭৩ সালে 'মাল্যবান' প্রকাশের মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম পদস্থাপন হলেও সে যাত্রা এখনও সমাপন হয়নি। আমাদের চোখের সামনে ক্রমান্বয়ে খুলে যাচ্ছে তাঁর কথাসাহিত্যের অমূল্য সব অপ্রকাশিত ভাণ্ডার এবং তা এখনো তেমন স্বীকৃত হয়নি। কেননা উপন্যাস পাঠের কষ্টকর অভিজ্ঞতা আমাদের পাঠকের তেমন নেই বলা চলে। সেক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ কবি হিসেবে এতদিনের নিজের অবস্থানটি যেভাবে সুদৃঢ় করেছেন, কথাসাহিত্যিক হিসেবে এখনও তা অনির্ণিত রয়ে গেছে। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, কবি হিসেবে জীবনানন্দ দাশ আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন, কথাসাহিত্যিক হিসেবেও তার তেমন একটা প্রাপ্য রয়ে গেছে, যা এখনও আমরা তাঁকে দিতে পারিনি। তিনি মনে করতেন, 'পরিণতিশীল জীবনকে সজাগ ও শালীন করে তোলার ভার কবিতার উপর আমার মনে হয় তেমনি উপন্যাসের উপরও। তেমনি মহৎ ঔপন্যাসিকের ভাবনা সূক্ষ্ম, হৃদয় আন্তরিক, অভিজ্ঞতা সজাগ ও চেতনা-অবচেতনা ঐকান্তিকভাবে সক্রিয়, ব্যবহারিক পৃথিবীতে ও রকম মানুষের কাছ থেকে জীবনের উন্নতিশীল ভাঙ্গা-গড়ায় কাজে শুভ ও সার্থক আত্মনিয়োগ দাবি করা যেতে পারে। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, লেখকতো দ্রষ্টা তার কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে আগামী মানুষের জন্য। অর্থাৎ উচ্চ মূল্যের সাহিত্য তার সমকালের পাঠকদের চোখের বাইরে থাকলেও আগামী পাঠকদের কাছে তা যথার্থ বলে প্রতিয়মান হয়। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অবশ্য আমরা এসব কথা অধিকাংশই জীবনানন্দ দাশের কবিতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকি। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কথাসাহিত্য যদি আরও দূর সময় এগিয়ে থাকে তাহলে কি আমাদের আশ্চর্য হবার কিছু আছে?
প্রথমেই উল্লেখ করেছি ১৯২৯ সালের মাল্যবানের এক রাত্রির জীবনানুভব ও জীবনাচরণ জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৮ সালে বিবৃত করেছেন, আর সেটি তাঁর মৃত্যুর বিশ বছর পর বই আকারে বেরুচ্ছে। কিন্তু প্রকাশক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিঃসংশয় হতে পারছেন না তার সাহিত্য মূল্য নিয়ে, বরং বিষয়টিকে তাঁরা দেখছেন একজন মহৎ কবির বিক্ষিপ্ত সৃষ্টি-প্রায়াস হিসেবে। ভূমিকাতে তো বলাই হচ্ছে, উপন্যাস হিসাবে মাল্যবান প্রচুর সম্ভাবনাময়, কখনো কখনো কৃতিত্বে উজ্জ্বল গ্রন্থটির প্রকাশকাল আরও দুই যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে, ইতোমধ্যে ঢাউস ও ক্ষুদ্রাকার আরও গোটা সাতেক উপন্যাস এবং বেশকিছু গল্প প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। কিন্তু কথাশিল্পী জীবনানন্দ দাশের প্রতিষ্ঠা কী হয়েছে? কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রায় একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ও খ্যাতি এসেছিল। রবীন্দ্রোত্তর যুগে বাংলা কবিতাতে যেমন জোয়ার এসেছিল, তেমনি কথাসাহিত্যের ভূগোলেও আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। কবিতার কথা স্বীকৃত হলেও কথাসাহিত্যের পরিবর্তনের কারিগরদেরও যে অন্যতম প্রধান জীবনানন্দ দাশ-সে কথা আমাদের জানা হয়নি। প্রথমত, তিরিশের তিন বন্দোপাধ্যয়ের সঙ্গে তার নাম উচ্চারিত হয়নি। এখন পর্যন্ত কথাসাহিত্য নিয়ে লেখা অধিকাংশ গ্রন্থে জীবনানন্দ দাশ প্রায় অনুপস্থিত। তাহলে কি জীবনানন্দ দাশ অনুপস্থিত থাকবার মত একজন লেখক না কি তাঁর প্রেমহীন, ক্ষমাহীন কঠিন উপন্যাস আমাদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। অবশ্য এর জন্য জীবনানন্দ দাশও কম দায়ী নন, তিনি তো আমাদের জানতেই দেননি তাঁর কথাসাহিত্যের এই রহস্যঘন রূপটির কথা।
জীবনানন্দ দাশ যখন উপন্যাস লেখা শুরু করেছেন, তখনও দেশের উপন্যাসে শরৎচন্দ্র প্রবল পরাক্রম বিরাজিত। এবং উপন্যাস পাঠকরা শরৎচন্দ্র-মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন। কেবল তাই নয়, আবহমান কাল থেকে বাংলার রমণীকুলের লক্ষ্মী ও কল্যাণময়ীরূপের প্রতিষ্ঠা তিনি সুদৃঢ়ভাবে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেন তিনি প্রতিষ্ঠা করেই শুরু করেছিলেন নারী মানেই সর্বংসহা মাতৃরূপিণী। তাঁর নায়িকারা মহিমা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পাঠকের অন্তরে। বিয়ে এবং প্রেম কামনার জন্য শরৎচন্দ্রের নারীরা মডেল হয়ে উঠেছিল। এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অল্পবয়স্ক কুমারী মেয়েরা নিজেদের শরৎ উপন্যাসের নায়িকাদের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করত। আর বয়স্করা, বিধবারা বড়দিদি, মেজদিদি, বিরাজ বৌ, শুভদার মতো ভাবতে ভালবাসত। শরৎচন্দ্রের যুগে অন্তত পুরুষের একটি নিশ্চিত আশ্রয় থাকত। সেই আশ্রয় মাতৃরূপিণী স্ত্রী কিংবা শ্রীকান্তের মতো স্ত্রী গলগ্রহ হয়ে পড়বে। বৌয়ের সিন্ধুক খুলে গয়না চুরি করে গাঁজা খেয়ে আসবে, জুয়ার আসরে পয়সা খুইয়ে আসবে, তারপর ফিরে আসলে শুভদার মতো স্ত্রী পরম মমতায় আঁচলের তলে টেনে নেবে। শরৎচন্দ্রের এসব স্ত্রী চরিত্র বুঝি রামায়ণের গার্হস্থ্য জীবনের মধ্য থেকে উৎসারিত হয়েছিল, মৃত্তিকাকন্যা সীতা প্রিয় চরিত্র বুঝি রামায়ণের সংস্থিতা। শরৎচন্দ্রের পরে বাংলা উপন্যাসের ধরনটি যারা পাল্টে দিয়ে ছিলেন, জীবনকে নির্মম এবং কঠোরভাব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, প্রেম-রিংরসায় নারী-পুরুষের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, জীবনের অস্তিত্বহীনতার এবং অতি সাধারণ মানুষের সংগ্রামশীলতা যারা উপন্যাসে এনেছিলেন তারাও কিন্তু নারীর সেই কল্যাণমতী রূপ খুব একটা ব্যাহত করেননি। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক সবার সম্পর্কেই এ ধরনের কথা বলা যায়। কিন্তু তাদেরই সমকালে, সকল নারীচরিত্রকে জীবনানন্দ যেন চ্যালেঞ্জ করেছেন। সকল নারীচরিত্রের সামনে যেন এককভারে উৎপলাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই আজ একটা প্রশ্নের উদয় হওয়া স্বাভাবিক স্ত্রী চরিত্রের স্রষ্টা হিসেবে কে বেশি সার্থক, জীবনানন্দ দাশ না জীবনানন্দ দাশ-পূর্ব ঔপন্যাসিকগণ?
অবশ্য কারো ছোটত্ব এবং বড়ত্ব খুঁজে দেখা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কেবল এ কথা বলা যায়, জীবনানন্দ দাশের ‘মাল্যবান' সমকালে এবং সীমিত চিত্রের মধ্যে আশ্চর্য শিল্পশক্তির প্রমাণ রেখেছে চরিত্রায়নে, কথোপকথনে কাহিনির গতিতে। সত্য, এ উপন্যাসে মহাকাব্যের দ্যোতনা নেই, কিন্তু একটি জীবনের অপ্রেমের অত্যাশ্চর্য অথচ আকড়া সত্য সব ঘটনা রয়েছে। তাছাড়া উপন্যাসের নায়ক মনের দিক দিয়ে অন্তত গড়পরতা বাঙালি নয়। মাটির নিচে গেড় আর কন্দ খাওয়া শুয়োরের মত (আপার গ্রেডের) অফিসারগিরিই তার সব নয়। এক জোড়া রেশমি স্টকিং, বার্ণিশ করা নিউ কীট তসরের কোট, পরিপাটি টেরি, সিগারেট কেস ও ফুটবল গ্রাউন্ডের বেঞ্চি দিয়ে নিজেকে চোখে ধরাতে সে ভালোবাসে না। এসবের চেয়ে সে আলাদা। সেই আলাদা সংস্থাপনই উপন্যাসের মূল কাহিনি। ঔপনিবেশিক আমলের একজন বি.এ পাশ কেরানি মাল্যবান। অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করবার সাধ ছিল, অনেক জিনিস শিখতে ইচ্ছে, বুঝতে ইচ্ছা ছিল। নিজের মনটা যে নেহাত কেরানির ডেস্ক আটা নিরেট নিরস কিছু নয়, মানুষকে সেটা বোঝাবার ইচ্ছা মাল্যবানের মধ্যেও ছিল। নানা রকম ইচ্ছে মনে। অনেক রকম ভাল সু-শৃঙ্খল কাঠকাঠামোর কথা জেগে ওঠে তার মনে, এসব কথা মানুষকে জানাতে ইচ্ছে করে মাল্যবানের। এক এক সময় তার মনে হয়, অফিসের কাজ ছেড়ে নিজের জীবনটাকে মহৎ কাজে নিবেশ করতে। যেমন, উত্তেজনাময় কর্মীসঙ্গের মধ্যে জীবনটাকে এরকম অফিসে চেপে সাপটে মেরে লাভ কি? তার কাছে টাকা পরিবারের সচ্ছলতা এগুলোকে ঘাসের বিচি, ধন্দুলের বিচি, রামকার্পাসের আটি বলে মনে হয় এক এক সময়। স্টিক হাতে নিয়ে গোল দীঘিতে ঘুরতে ঘুরতে এক এক সময় তার মনে হয়, একটা বড় বাজপেয়ে সভায় বেশ মার্জিত ভঙ্গিতে আবেগের বিরাট অকুল পাথারে নিজেকে আশ্চর্যভাবে নিয়ন্ত্রিত করে বক্তৃতা দেবার অদ্ভুদ ক্ষমতা আছে তার, পলিটিক্সে বাঙ্গালিরা আজকাল গুজরাটি মারাঠি মাদ্রাজি ইড-পিলনদের কাছে পদে পদে ভূঞ্জু খেয়ে ফিরছে- ভাবতে ভাবতে রক্ত কেমন যেন হয়ে ওঠে মাল্যবানের। বাঙালির মানসম্মান ফিরিয়ে আনবার জন্য বড় নয়াল আগুনের মত দাউ দাউ করে উঠতে ইচ্ছা করে তার। বিপ্লব থেকে বিপ্লবে ফ্রান্স, রুশ, স্পেন, চীন সমস্ত বিপ্লবের ইয়ে স্তনাগ্রচূড়ায় নতুন দুগ্ধের উল্লাস নবীন পৃথিবীর জন্য। তারপর ফুটবল মাঠের ঠাণ্ডা মেঝেতে বসে এসব কাল ভুলে যায় মাল্যবান। মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত বাঙালি যুবকের এই আকাড়া করুণ পরিণতি তার আগে কিংবা পরে আর কোনো উপন্যাস ধারণ করতে পারেনি।
ঊনিশ শ ঊনত্রিশ সালের একটা রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে মাল্যবান এসব কথা ভাবছিলেন। সম্ভবত বিশে অঘ্রাণ। কিছুতে ঘুম আসছে না। এই রাতে মাল্যবান জন্মেছিলেন। নিচের পলেস্তরা খসা স্যাত স্যাতে একটি ঘরে মাল্যবান ঘুমায়। দোতলার ঘরে থেকে তার স্ত্রী উৎপলা আর ন বছরী কন্যা মনু। অঘুম মাল্যবান দোতলার ঘরে উঠে আসে। হয়তো মশারিটা থুরথুরে পাড়াগাঁর পৌষরাতের নিশ্চুপ ডানার পাখির মত এসে স্নিগ্ধ নৈঃশব্দ্যে এসে জাকিয়ে বসে থাকতে চায়। কিংবা নেটের মশারি তুলতেই ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াল। উৎপলা জেগে উঠে প্রথমে খুব খানিকটা ভয় খেল, তারপর বিছানার ওপর উঠে বসে তার সুন্দর মুখের বিপর্যয়ে মুহূর্তেই সে ভাবটা কাটিয়ে উঠে মরা নদীর বালির চেয়েও বেশি বিরসতায় বললে তুমি! তারপর উৎপলার অসম্ভব সব অপ্রেমের সংলাপ। অথচ 'মাল্যবানকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রুচির বিরুদ্ধে, অপ্রেম, কামনার টানে, বেশি লালসায়, রিরংসায় উৎপলার মত একজন ভাল বংশের সুন্দর শরীরের নিচু কাণ্ডজ্ঞানের নিরস মেয়েমানুষের কাছে ঘুরে ফিরে আসতে হবে, নিজের মৃত্যু পর্যন্ত কী নিদারুণভাবে। কেমন অধমের মত, কেমন হাতে পায়ে ধরে মেয়েটির, কখনো বা ঘরে শান্তি কখনো বা বাইরের সুনাম রক্ষা করবার জন্য। কখনো বা লালসা, অতিক্বচিৎ প্রণয় এসে উৎপলার দিকে মাল্যবানকে টানছে বলে।
মাল্যবানকে স্বামী স্ত্রীর সংসারের মধ্যে অন্ত্যজ শ্রেণির মতো বাস করতে হয়। দোতলার বাথরুমে মাল্যবানকে চান পর্যন্ত করতে দেয় না উৎপলা। এই উপন্যাস থেকে এটা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। নায়ক চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহ এই উপন্যাসের প্রধান আঙ্গিক কৃতিত্ব এবং এই কৃতিত্ব পরিচ্ছন্ন রচনাশৈলীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তার স্বাধীন নিজস্ব মূল্য সংযুক্ত হয়ে উপন্যাসটিকে তার স্বাধীন নিজস্ব মূল্য দিয়েছে। অনেকেরই ধারণা ‘মাল্যবান’ জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিগত জীবনবোধ ও জীবনাত্যাচারের কাহিনি। কেউ কেউ মনে করেন উৎপলার মধ্যে লাবণ্য দাশের প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা অবশ্য তা মনে করি না। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন জাতশিল্পী। সমকালের এবং তৎপরবর্তীকালের আত্মা তিনি তার সাহিত্যকর্মে ধারণ করতে পেরেছিলেন। মাল্যবান ছাড়া বাংলা কথাসাহিত্যের আলোচনা কী করে সম্পন্ন হতে পারে তা ভাবতে কষ্ট হয়। কেবল ‘মাল্যবান’, ‘বাঁশমতির উপাখ্যান’ ‘প্রেতিনীর সংসার’, ‘বিভা’, ‘কারুবাসনা’, জীবনপ্রণালী'র মতো বিষ্ময়কর সব উপন্যাস লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ। কবি হিসেবে নয়, কথাসাহিত্যে তার মূল্য নির্ধারণের সময় এসেছে। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসে যদি কোনো শ্রেণিবিন্যাস করা হয়, তাহলে একটি শ্রেণির প্রথম এবং প্রধান প্রতিষ্ঠাতার নাম জীবনানন্দ দাশ। এমনকি বঙ্কিম-পরবর্তী প্রধান ঔপন্যাসিকদের সঙ্গে তাঁর পাঠ জরুরি।
0 Comments