১
জীবনানন্দ দাশকে কেন নির্জনতার কবি বলা হয়, আমার বোধে আসে না। প্রথম কে তাকে এই নামে অভিষিক্ত করেছিল, জানা নেই। একবার যখন কেউ কারো নামের আগে কোন বিশষণ যুক্ত করে দেয়, তখন সেটা যৌক্তিক কোন বিবেচনা ছাড়াই স্থায়ী রূপ পেতে থাকে। যেমন শামসুর রাহমানকে বলা হতো প্রধান কবি। কেন? কবি আবার প্রধান অপ্রধান হয় নাকি? আবার পল্লীকবি, কেন, তিনি পল্লীর জীবনকে কবিতায় বাঙ্ময় করেছেন বলে? ভাবুন তো, কবির আগে বলা হচ্ছে তিনি জাতিসত্তার কবি! মানে কি এর? কে জানে!
এগুলি এখন হাস্যকর লাগে।
২
কবি কেন, যেন শিল্পের মাধ্যমে কাজ করা ব্যক্তির দরকার নির্জনতা। একজন কবি, একজন পেইন্টার, একজন নাট্যকার কিংবা একজন সংগীতশিল্পী কি জনতা কিংবা কোলহালে গিয়ে লিখবেন, আঁকবেন কিংবা রেয়াজ করবেন, শ্রুতি লাগাবেন?
তাহলে কি বিষয়ের জন্যই জীবনানন্দকে নির্জনতার কবি বলা হয়? নাকি তিনি যে কোন আড্ডা, ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলতেন বলে?
ধরি, বিষয়বস্তুর জন্যই তাকে এমন নামে ডাকা হয়। কিন্তু আমার কাছে তাকে আদৌ নির্জনতার কবি মনে হয় না।
তিনি তার ঝরাপালকের প্রথম কবিতা 'কবি' তে বলছেন যে তিনি সেই কবি যিনি আকাশের দিকে চেয়ে ঝরাপালকের ছবি দেখছেন।
মানে কি?
এটা কি কোন নির্জন বনভূমিতে কোন বৃক্ষ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে কিংবা আকাশে উড়ন্ত কোন পাখির ডানা থেকে পালক খসে পড়ছে?
বিষয়টা তা নয়। তিনি তার সময়ের কথা বলছেন। তিনি যে সময় এই কবিতা লিখছেন তখন পৃথিবীতে চলছে একটা মন্দাবস্থা। মানুষ দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছে। জীবনানন্দ মানুষের এই অসহায়তার কথা বলছেন ঝরাপালকের প্রতীকে।
তার কবিতার প্রতিটি লাইনে ইতিহাস এবং মানবজাতির জার্নির রূপায়ন আছে। আট বছর আগের একদিন, বোধ, আমরা হেটেছি যারা, সিন্ধুসারস, নগ্ন নির্জন হাত, এমনকি বনলতা সেন কবিতাতেও কালের কথা, মানুষের সামগ্রিক জীবনবোধের কথা অসাধারণ কাব্যিকতায় বর্ণিত হয়েছে।
তিনি যে রূপসী বাংলার ছবি এঁকেছেন, তাতে বাংলার রূপের প্রতি তার যে মমতা এবং ভালোবাসা, তা জন্মভূমির প্রতি এক সহজাত প্রবৃত্তি কিন্তু তাতেও জাতীয়তাবোধের এক চরম উচ্চারণ রয়েছে। কারণ তখন তিনি পরাধীন দেশের নাগরিক।
ফলত, তার কবিতা নির্জনতা তো নয়ই, বরং পাঠ করলে ভেতরে ভেতরে কোলাহল জেগে ওঠে। এই কোলাহল ব্যক্তিক নয়, সামাজিক। সামাজিক মানেই রাজনৈতিক। জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রতিটি উচ্চারণ রাজনৈতিক।
0 Comments