তিনি কবি— সেই কবি— আকাশে কাতর আঁখি তুলে যিনি দেখেন ঝরা পালকের ছবি। তিনি সেই কবি যিনি মা কবি কুসুম কুমারীর ‘আদর্শ ছেলে’। যিনি ‘নির্জনতম কবি’। যিনি বনলতা সেন, সুরঞ্জনার স্রষ্টা। যিনি রূপসী বাংলার একনিষ্ঠ প্রেমিক। তিনি আর কেউ নন, তিনি কবি জীবনানন্দ দাশ। আধুনিক বাংলা কবিতার ত্রিশ দশকের পঞ্চপাণ্ডবের একজন। যার কবিতা এখনো বহুল পঠিত, আলোচিত ও নন্দিত।
কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। মা কবি কুসুম কুমারী দাশ ও বাবা সত্যানন্দ দাশ বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
তার কবিতায় বাংলাদেশের নদী, ফুল, ফল, পশু পাখি, ফল, ঋতু, রঙ, প্রভৃতি বাঙালির আত্মপরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাটির কাছাকাছি থেকে ফল ফসলের গান গেয়েছেন তার কবিতায়। বাংলার ঐতিহাসিক চরিত্রকে দিয়েছেন মাহাত্ম্য। শব্দবন্ধে জীবন ও সমাজকে আলোকিত করেছেন আধুনিক মননশীল ও নান্দনিক ভাষিক উচ্চারণে। তার কবিতা পড়লে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট কেটে যায় মুহূর্তে। পাঠক গ্লানিমুক্ত হয়, আলোকিত হয়, সম্ভাবনার বীজমন্ত্রে নিজের অজান্তেই মাথা উঁচু হয়ে যায় বাঙালির পরিচয়। কারণ,
ভাষাপ্রীতি, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা বাঙালির বীরত্বখচিত অভিব্যক্তি, বাংলা কবিতার প্রাণ- বিশেষত, আধুনিক বাংলা কবিতা-চর্চায়। চরম রবীন্দ্র-বিরোধীতায় তিরিশি বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সাফল্যস্তম্ভ নির্মিতির বেলায় পাঁচ মহাজনের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ অন্যতম।
(খোন্দকার আশরাফ হোসেন, ২০১০:৮)
কবি জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতা উপমা, চিত্রকল্প, প্রকৃতির বর্ণনা, ধরন, গরন সংবেদনশীল আত্মগরিমার প্রতিচ্ছবি। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে বাংলার অকৃত্রিম রূপটির পরিচয় পাওয়া যায়। নির্জনে নিজের থাকা না থাকা নিয়ে মানব মনে যে হতাশা, হীনমন্যতার সৃষ্টি হয় তা কবি শব্দসুষমায় নির্মাণ করেছেন।
‘আমি চলে যাব ব'লে চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে? লক্ষীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষীটির তরে?’
সমূদ্র তলদেশে যেমন মনি মুক্তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তেমন রূপসী বাংলার পরতে পরতে যে ফল ফসল প্রাণ প্রকৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা দেখেছেন কবি তার অন্তর্দৃষ্টির মহামহিমায়। প্রকাশ করেছেন কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে।
তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি হয়ে উঠেছেন তিনি তার কাব্যপ্রতিভার গুণে। জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ-এর জন্য নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়েছেন। ১৯৫৫ সালে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থ’ ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। শুদ্ধতম কবি’ জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে,
১/ রূপসী বাংলা
২/ বনলতা সেন
৩/ মহাপৃথিবী
৪/ বেলা অবেলা কালবেলা
৫/ শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি৷ তার কবিতায় পাওয়া যায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ যেমন- শিশিরের সাদা সরলতা, মৃদুভেজা নীলাকাশ, মউমাছিদের নীড়, থোড়ের মতন শাদা ভিজে হাত, নক্ষত্রের নীল ফুল, ঘাস, মউরীর মৃদু গন্ধ, হিজল জামের ডালে বাদুড়ের আসা-যাওয়া প্রভৃতি।
আকন্দ বনের দিকে-একদল দাঁড় কাক ম্লান গুঞ্জরণে
নাটার মতন রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ
দু-মুহূর্তে ভ'রে রাখে-তারপর মৌরীর গন্ধ মাখা ঘাস
প'ড়ে থাকে: লক্ষীপেঁচা ডাল থেকে ডালে শুধু উড়ে চলে যায় বনে।
রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়।
দেখেছিল: বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে-
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জোছনা যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়-
এমন বেহুলা, ইন্দ্রের সভা, শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা, মানিকমালা, বল্লাল সেন, তার ঘোড়া, রাজপুত্র, রাজকন্যা, কঙ্কাবতী, সীতারাম, রাজারাম, রামনাথ রায়,মনসা,চাঁদ সওদাগর, অর্জুন, প্রভৃতি চরিত্র তাঁর কবিতায় নবরূপে ফিরে এসেছে। তার কবিতায় পাওয়া যায় বাংলা মাস, ঋতুর বর্ণনা। যেমন,
‘যখন হেমন্ত আসে গৌড় গৌড় বাংলায়
কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায় ঝরে পড়ে’ এমন করেই হেমন্ত, নবান্ন ঋতু বার বার ঘুরে ফিরে আসে জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতার শরীর জুড়ে।
আবার আষাঢ় মাস নিয়ে বলেন,
‘হায় পাখি, একদিন কালীদহে ছিলে না কি-দহের বাতাসে
আষাঢ়ের দু-পহরের কলরব কর নি কি এই বাংলায়!’
অঘ্রাণ, পৌষ, কার্তিক, আষাঢ় প্রভৃতি মাসের রূপ ফুটে উঠেছে তার কবিতার পঙক্তিতে। উপমা ও চিত্রকল্প আশ্চর্য বিস্ময় সৃষ্টি করে পাঠকের মনে।
সোনালি ধান, অশ্বত্থ বট, বাংলার তৃণ, আমের পাতা, কাঁচপোকা যার সঙ্গী, বাসকের গন্ধ, আনারসের ফুলে উড়ে বেড়ানো ভোমরা, রোদের দুপুরে গুবরে পোকার ক্ষীণ গুমরানি প্রভৃতি যারা ভালোবাসে কবিকে, কবি ভালোবাসে তাদের। প্রকৃতি তার প্রিয় অনুষঙ্গ।
কবিতা ছাড়াও জীবনানন্দ দাশ ২১টি উপন্যাস এবং ১২৬টি ছোটগল্প রচনা করেছেন। রচনা করেছেন প্রবন্ধও। তবু কবিতা নিয়ে যত কথা, যত আলোচনা হয় গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ নিয়ে তুলনামূলক কম। তাই বলে এগুলোর মূল্য সামান্যতম কম নয়।
কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশ-এর জীবনাবসান ঘটে ১৯৫৪ সালে, ২২ অক্টোবর। আত্মমগ্ন কবির জন্মদিন আজ। রূপসী বাংলা আজ কুর্নিশ জানায় আকাশের থেকে দূর-আরো দূর-আরো দূর -নির্জন আকাশে চলে যাওয়া প্রিয় প্রকৃতি প্রেমি, সংবেদনশীল, আত্মভোলা কবিকে।
0 Comments