হাসান আজিজুল হক-এর জন্ম ০২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯ সনে। ষাটের দশকে আবির্ভূত এই যশস্বী কথাসাহিত্যিক সুঠাম গদ্য এবং মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধ। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষের কথকতা তার গল্প-উপন্যাসের প্রধানতম অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ তার অনেক গল্পের পটভূমি। তাকে চিহ্নিত করা হয় ‘গল্পের রাজপুত্তর’ হিসেবে।
হাসান আজিজুল হক-এর উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- গল্পগ্রন্থ : সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭), বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)। উপন্যাস : আগুনপাখি (২০০৬), সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩), শামুক (২০১৫)। উপন্যাসিকা : বৃত্তায়ন (১৯৯১), শিউলি (২০০৬)। নাটক : চন্দর কোথায় (জর্জ শেহাদের নাটকের ভাষান্তর)। প্রবন্ধ : চালচিত্রের খুঁটিনাটি, একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা, কথাসাহিত্যের কথকতা, অপ্রকাশের ভার, অতলের আধি, সক্রেটিস, কথা লেখা কথা, লোকযাত্রা আধুনিকতা ও সংস্কৃতি, ছড়ানো ছিটানো, কে বাঁচে কে বাঁচায়, বাচনিক আত্মজৈবনিক, চিন্তন-কণা। শিশুসাহিত্য : লালঘোড়া আমি (১৯৮৪ সালে প্রকাশিত কিশোর উপন্যাস), ফুটবল থেকে সাবধান (১৯৯৮ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গল্প)। আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকথা : ফিরে যাই ফিরে আসি (১ম অংশ), উঁকি দিয়ে দিগন্ত (২য় অংশ), এই পুরাতন আখরগুলি (৩য় অংশ)।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরস্কার। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭০ সনে, ১৯৯৯ সনে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়াও পাওয়া পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), ডি-লিট ডিগ্রি (আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১২), বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কাজী মাহবুবউল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার (১৯৯৪), খুলনা সাহিত্য মজলিশ সাহিত্য পদক (১৯৮৬), রাজশাহী লেখক পরিষদ পদক (১৯৯৩), সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৭), দিবারাত্রির কাব্য সাহিত্য পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৯৭), শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৯), রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, (২০০২), আব্দুর রউফ স্মৃতি পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার (হবিগঞ্জ, ২০০৩), ক্রান্তি পদক (২০০৪), অমিয়ভূষণ সম্মাননা (জলপাইগুড়ি, ২০০৪), গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান সম্মাননা (২০০৬), প্রথম আলো বর্ষসেরা বই, (২০০৭), মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার, (২০০৭), জেমকন কথাসাহিত্য পুরস্কার (২০১৩)সহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন মৃত্তিকালগ্ন এ কথক।
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক-এর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শফিক হাসান। হাসান আজিজুল হক-এর জন্মদিনে উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীর পাঠকদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকারের সম্পূর্ণ অংশ নিচে হুবহু তুলে দেয়া হলো।
শফিক হাসান : আপনাকে অভিধা দেওয়া হয় ‘গল্পের রাজপুত্তর’ হিসেবে। উপাধিটির উৎপত্তি কবে, কীভাবে?
হাসান আজিজুল হক : ভালোবেসে কয়েকজন গুণগ্রাহী উপাধিটি দিয়েছে। এটা তো সরকারি-বেসরকারি কোনো উপাধি নয়। আমিও এটাকে প্রশ্রয় দিই- তোমরা করো, বলো, যাও! এটাকে আর কী বলবো। এটা তো আমাকে খুশি করার বিষয় নয়- কেউ কেউ বলে। সবাই বলে না। কেউ বলে কিংবদন্তি শিল্পী, কেউ বলে সব্যসাচী। এটা তো ব্যবহার করার জিনিস নয়। অন্যরা এটা ব্যবহার করবে কেন!
শফিক হাসান : আপনার গল্প লেখার শুরু কখন, কীভাবে?
হাসান আজিজুল হক : ১৯৬০ সালে প্রথম গল্প লিখি। গল্পের নাম ‘শকুন’।
শফিক হাসান : কী ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
হাসান আজিজুল হক : যে বিষয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি সেটাই লিখি। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করলে লিখিই না। তবে খুব উচ্চবর্গের মানুষ নিয়ে আমি তেমন লিখিনি। নগরজীবন নিয়েও তেমন লেখা নেই আমার।
শফিক হাসান : পাঠকদের ওপর আপনার গল্পের প্রভাব কেমন?
হাসান আজিজুল হক : বহু লোক আমার নাম জানে, আমার সাথে কথা বলতে আসে, আমার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে, ছবি তোলে। এত পরিচিত লোক আসে, এত লোক- এত জায়গা থেকে। যখন কাউকে জিজ্ঞেস করি আমার কোনো লেখা পড়েছো কিনা- অফ হয়ে যায়!
শফিক হাসান : প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজে গল্প পাঠের প্রাসঙ্গিকতা কী?
হাসান আজিজুল হক : গল্পের কোনো সীমারেখা নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প লিখতে হয়। কখনো অতীত নিয়ে লিখবো, কখনো বর্তমান নিয়ে লিখবো। বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে অসংখ্য গল্প লিখেছি।
শফিক হাসান : গল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
হাসান আজিজুল হক : ওসব নিয়ে ভাবি না, আলাদা করে ভেবে লাভ নেই। আদৌ লোকে পড়ছে কিনা তাও বুঝতে পারি না। দেখার দরকার হলে কেউ ফেসবুক দেখেছে, পড়ার দরকার হলে ইন্টারনেটে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে কী পড়া হচ্ছে না হচ্ছে, কী পড়ছে না পড়ছে আমি কিচ্ছু বলতে পারবো না।
শফিক হাসান : বিশ্বসাহিত্যে বাংলা গল্পের অবস্থান কোথায়?
হাসান আজিজুল হক : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- অসাধারণ সব গল্প আছে এদের। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস- এদের গল্প বিশ্বমানের। রবীন্দ্রনাথ যে শেষ হয়ে গেলেন তাও নয়। লেখক তার ক্ষমতা অনুযায়ী লিখবেন। তবে এটা ঠিক, আমারদের গল্পের ভালো অনুবাদ হয়নি। আমাদের গল্প উপেক্ষিত হয়েছে।
শফিক হাসান : আপনার গল্প লেখার প্রেরণা কী?
হাসান আজিজুল হক : প্রেরণা বলতে এখানে তো দৈববাণী গোছের কিছু নয়। একেজন একেক রকম কাজ করবে। সবাইকে কি তোমরা জিজ্ঞাসা করতে যাও! একটা মানুষ থেকে আরেকটা মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা। লেখকও তেমনই। কেউ হয়তো একই সাথে ব্যাংকার ও কবি। শুধু লেখালেখি করে বাংলাদেশে জীবিকা অর্জন করা কঠিন। এটা বোধহয় হুমায়ূন আহমেদই পেরেছিলো। আর তো তেমন কেউ নেই।
শফিক হাসান : আমাদের ছোটগল্পে বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থিতি কি সন্তোষজনক?
হাসান আজিজুল হক : এভাবে প্রশ্ন করলে তো মুশকিল! রাশিয়া আক্রমণ করেছিলো নেপোলিয়ন, তার কত বছর পর টলস্টয় লিখেছেন ‘ওয়ার এ্যান্ড পিস’। সেটা কি স্বপ্ন ছিলো। বলা মুশকিল। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য বড় একটা ঘটনা। যা নির্মম, বিপুল। বিপুল যে ঘটনা ঘটে, এরকম ঘটনা তো বেশি নেই। পুরো পৃথিবীতেই এমন ঘটনা কম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তেমন একটা জিনিস। এটা নিয়ে মানুষ বারবার লিখবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জানি না কী কারণে অসাধারণ লেখা খুব একটা নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কবিতার ফোয়ারা, অনেক গল্পের ফোয়ারা, অনেক উপন্যাসের ফোয়ারা বয়েছে কিন্তু মানসম্মত লেখা তেমন নেই। হাতেগোনা। এটা আমার মত।
শফিক হাসান : জনপ্রিয় ধারা, অজনপ্রিয় ধারার নিরিখে বাংলাদেশে ‘বাজারি লেখক’ বলে একটা স্ল্যাং চালু আছে। বিষয়টিকে কীভাবে বিবেচনা করেন?
হাসান আজিজুল হক : এসব আমি জানি না। বাজারি লেখক বলে কোনো কিছু আছে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। শুধু জানি দুইটি বিষয়- আমার লেখা হয় অথবা হয় না, সাহিত্য হয় অথবা হয় না। এই দুই ভাগে লেখক বিভক্ত। বাজারি লেখক, জনপ্রিয় লেখক বুঝি না। বহু জনপ্রিয় লেখক দুর্বল লেখক। আবার বহু অসাধারণ তেমন লেখক জনপ্রিয় হয়নি। তাদের বই-টই তেমন বিক্রি হয় না। এসব কোনো ধর্তব্যের বিষয় নয়। বাংলাদেশে এসব আলোচিত হয়, কারণ এখানে পাঠকসংখ্যা জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। কাজেই এই নগণ্য সংখ্যক পাঠক নিয়ে কিছু বলারও নেই। এদের সামান্য একটা অংশ পড়াশোনা করে। এখন আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে। আধুনিক প্রযুক্তি এসে লেখা-পড়ার ধরন পাল্টে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে অন্য জায়গা থেকে সব পাওয়া যায়। ইনফরমেশন বেড়ে গেছে। ইন্টারনেট ঘাটলে সবকিছু পাওয়া যায়। নলেজ বাড়–ক আর না বাড়–ক, খবর বেড়ে গেছে। এখন সাহিত্যের পাঠই কমে গেছে। প্রকাশকরা ছোটগল্পের বই প্রকাশ করতে চান না। গল্পের পাঠক কম। প্রকাশকদের সাথে কথা বলে জেনেছি, তারা ঢাউস ঢাউস উপন্যাস বের করতে চান। এগুলো বিক্রি হয়। ছোটগল্প আলাদা করে পড়া হয় না। শুনেছি ছোটগল্পের বাজার খুব খারাপ। আন্তর্জাতিক বাজারেও দেখা যায়- কবিতার বই নেই। কবিতার বইও বিক্রি হয় না। তবু কবিতার দাম একটু বেশি।
শফিক হাসান : বর্তমানের লিটল ম্যাগাজিন চর্চা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
হাসান আজিজুল হক : লিটলম্যাগের ঝাঁঝালো একটা সময় ছিলো। বড় বড় প্রতিষ্ঠান যখন সমস্ত কিছু গ্রাস করছিলো, বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি- তখন লিটলম্যাগের বিদ্রোহ করার একটা জায়গা ছিলো। একদম বুক উঁচু করে দাঁড়ানোর। আমার মনে হয় না লিটলম্যাগের এখন সেই ভূমিকাটা আছে। এখন সাধারণ লেখাই লিটলম্যাগে ছাপা হচ্ছে। সেই তীব্র বিদ্রোহ, নতুন ধারণা নেই- আগে দেখতাম। এখন বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন প্রচুর- যেভাবে পারে বিজ্ঞাপন নিয়ে মোটা, ঢাউস ঢাউস একটা একেকটা সংখ্যা হচ্ছে। নিয়মও কিছু নেই। অনেকে লেখা একসঙ্গে করে সাধারণ লেখাই লিটলম্যাগে ছাপা হচ্ছে। বড় লেখকদের যে ধরনের লেখা বড় কাগজে ছাপা হচ্ছে, সেগুলোও লিটলম্যাগে ছাপা হচ্ছে। এ দুয়ের পার্থক্য কী- বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি। লিটলম্যাগ প্রচুর লেখক তৈরি করেছে, বহু বিষয় তৈরি করেছে। অনেক জিনিস ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন যদি বিজ্ঞাপন টিজ্ঞাপন এটা ওটা নিয়ে লিটলম্যাগ প্রকাশ করা হয়- তার মানে নানান জায়গায় আপস করেই লিটলম্যাগ হচ্ছে। লিটলম্যাগের আগেকার সেই চরিত্র আর থাকছে না, জোয়ারটা থাকছে না।
শফিক হাসান : আপনার দৃষ্টিতে এসময়ের সম্ভাবনাময় গল্পকার কারা?
হাসান আজিজুল হক : আমি নির্দিষ্ট করে কারো নাম বলবো না। অনেকেই ভালো লিখছে, আবার বেশিরভাগই খারাপ লিখছে।
শফিক হাসান : নবীন গল্পকারদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
হাসান আজিজুল হক : লেখালেখিতে চর্চার কোনো বিকল্প নেই, কারো সাথে কোনো আপস নেই। সেই সঙ্গে সঙ্গে জীবনকে গভীরভাবে দেখার দৃষ্টি দরকার। সিমপ্যাথিটা এমন হওয়া উচিত যাতে করে সেটা সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। একজন লেখক হয়তো বাংলাদেশের মানুষ। তার গল্প যদি পৃথিবীর মানুষের বৃহত্ব ধারণ করতে পারে তবে সেটা বিশ্বমানের গল্পও বটে।
হাসান আজিজুল হক-এর উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- গল্পগ্রন্থ : সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭), বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)। উপন্যাস : আগুনপাখি (২০০৬), সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩), শামুক (২০১৫)। উপন্যাসিকা : বৃত্তায়ন (১৯৯১), শিউলি (২০০৬)। নাটক : চন্দর কোথায় (জর্জ শেহাদের নাটকের ভাষান্তর)। প্রবন্ধ : চালচিত্রের খুঁটিনাটি, একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা, কথাসাহিত্যের কথকতা, অপ্রকাশের ভার, অতলের আধি, সক্রেটিস, কথা লেখা কথা, লোকযাত্রা আধুনিকতা ও সংস্কৃতি, ছড়ানো ছিটানো, কে বাঁচে কে বাঁচায়, বাচনিক আত্মজৈবনিক, চিন্তন-কণা। শিশুসাহিত্য : লালঘোড়া আমি (১৯৮৪ সালে প্রকাশিত কিশোর উপন্যাস), ফুটবল থেকে সাবধান (১৯৯৮ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গল্প)। আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকথা : ফিরে যাই ফিরে আসি (১ম অংশ), উঁকি দিয়ে দিগন্ত (২য় অংশ), এই পুরাতন আখরগুলি (৩য় অংশ)।
সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরস্কার। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭০ সনে, ১৯৯৯ সনে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়াও পাওয়া পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), ডি-লিট ডিগ্রি (আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১২), বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কাজী মাহবুবউল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার (১৯৯৪), খুলনা সাহিত্য মজলিশ সাহিত্য পদক (১৯৮৬), রাজশাহী লেখক পরিষদ পদক (১৯৯৩), সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৭), দিবারাত্রির কাব্য সাহিত্য পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৯৭), শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৯), রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, (২০০২), আব্দুর রউফ স্মৃতি পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার (হবিগঞ্জ, ২০০৩), ক্রান্তি পদক (২০০৪), অমিয়ভূষণ সম্মাননা (জলপাইগুড়ি, ২০০৪), গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান সম্মাননা (২০০৬), প্রথম আলো বর্ষসেরা বই, (২০০৭), মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার, (২০০৭), জেমকন কথাসাহিত্য পুরস্কার (২০১৩)সহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন মৃত্তিকালগ্ন এ কথক।
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক-এর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শফিক হাসান। হাসান আজিজুল হক-এর জন্মদিনে উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীর পাঠকদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকারের সম্পূর্ণ অংশ নিচে হুবহু তুলে দেয়া হলো।
শফিক হাসান : আপনাকে অভিধা দেওয়া হয় ‘গল্পের রাজপুত্তর’ হিসেবে। উপাধিটির উৎপত্তি কবে, কীভাবে?
হাসান আজিজুল হক : ভালোবেসে কয়েকজন গুণগ্রাহী উপাধিটি দিয়েছে। এটা তো সরকারি-বেসরকারি কোনো উপাধি নয়। আমিও এটাকে প্রশ্রয় দিই- তোমরা করো, বলো, যাও! এটাকে আর কী বলবো। এটা তো আমাকে খুশি করার বিষয় নয়- কেউ কেউ বলে। সবাই বলে না। কেউ বলে কিংবদন্তি শিল্পী, কেউ বলে সব্যসাচী। এটা তো ব্যবহার করার জিনিস নয়। অন্যরা এটা ব্যবহার করবে কেন!
শফিক হাসান : আপনার গল্প লেখার শুরু কখন, কীভাবে?
হাসান আজিজুল হক : ১৯৬০ সালে প্রথম গল্প লিখি। গল্পের নাম ‘শকুন’।
শফিক হাসান : কী ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
হাসান আজিজুল হক : যে বিষয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি সেটাই লিখি। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করলে লিখিই না। তবে খুব উচ্চবর্গের মানুষ নিয়ে আমি তেমন লিখিনি। নগরজীবন নিয়েও তেমন লেখা নেই আমার।
শফিক হাসান : পাঠকদের ওপর আপনার গল্পের প্রভাব কেমন?
হাসান আজিজুল হক : বহু লোক আমার নাম জানে, আমার সাথে কথা বলতে আসে, আমার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে, ছবি তোলে। এত পরিচিত লোক আসে, এত লোক- এত জায়গা থেকে। যখন কাউকে জিজ্ঞেস করি আমার কোনো লেখা পড়েছো কিনা- অফ হয়ে যায়!
শফিক হাসান : প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজে গল্প পাঠের প্রাসঙ্গিকতা কী?
হাসান আজিজুল হক : গল্পের কোনো সীমারেখা নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প লিখতে হয়। কখনো অতীত নিয়ে লিখবো, কখনো বর্তমান নিয়ে লিখবো। বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে অসংখ্য গল্প লিখেছি।
শফিক হাসান : গল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
হাসান আজিজুল হক : ওসব নিয়ে ভাবি না, আলাদা করে ভেবে লাভ নেই। আদৌ লোকে পড়ছে কিনা তাও বুঝতে পারি না। দেখার দরকার হলে কেউ ফেসবুক দেখেছে, পড়ার দরকার হলে ইন্টারনেটে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে কী পড়া হচ্ছে না হচ্ছে, কী পড়ছে না পড়ছে আমি কিচ্ছু বলতে পারবো না।
শফিক হাসান : বিশ্বসাহিত্যে বাংলা গল্পের অবস্থান কোথায়?
হাসান আজিজুল হক : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- অসাধারণ সব গল্প আছে এদের। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস- এদের গল্প বিশ্বমানের। রবীন্দ্রনাথ যে শেষ হয়ে গেলেন তাও নয়। লেখক তার ক্ষমতা অনুযায়ী লিখবেন। তবে এটা ঠিক, আমারদের গল্পের ভালো অনুবাদ হয়নি। আমাদের গল্প উপেক্ষিত হয়েছে।
শফিক হাসান : আপনার গল্প লেখার প্রেরণা কী?
হাসান আজিজুল হক : প্রেরণা বলতে এখানে তো দৈববাণী গোছের কিছু নয়। একেজন একেক রকম কাজ করবে। সবাইকে কি তোমরা জিজ্ঞাসা করতে যাও! একটা মানুষ থেকে আরেকটা মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা। লেখকও তেমনই। কেউ হয়তো একই সাথে ব্যাংকার ও কবি। শুধু লেখালেখি করে বাংলাদেশে জীবিকা অর্জন করা কঠিন। এটা বোধহয় হুমায়ূন আহমেদই পেরেছিলো। আর তো তেমন কেউ নেই।
শফিক হাসান : আমাদের ছোটগল্পে বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থিতি কি সন্তোষজনক?
হাসান আজিজুল হক : এভাবে প্রশ্ন করলে তো মুশকিল! রাশিয়া আক্রমণ করেছিলো নেপোলিয়ন, তার কত বছর পর টলস্টয় লিখেছেন ‘ওয়ার এ্যান্ড পিস’। সেটা কি স্বপ্ন ছিলো। বলা মুশকিল। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য বড় একটা ঘটনা। যা নির্মম, বিপুল। বিপুল যে ঘটনা ঘটে, এরকম ঘটনা তো বেশি নেই। পুরো পৃথিবীতেই এমন ঘটনা কম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তেমন একটা জিনিস। এটা নিয়ে মানুষ বারবার লিখবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জানি না কী কারণে অসাধারণ লেখা খুব একটা নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কবিতার ফোয়ারা, অনেক গল্পের ফোয়ারা, অনেক উপন্যাসের ফোয়ারা বয়েছে কিন্তু মানসম্মত লেখা তেমন নেই। হাতেগোনা। এটা আমার মত।
শফিক হাসান : জনপ্রিয় ধারা, অজনপ্রিয় ধারার নিরিখে বাংলাদেশে ‘বাজারি লেখক’ বলে একটা স্ল্যাং চালু আছে। বিষয়টিকে কীভাবে বিবেচনা করেন?
হাসান আজিজুল হক : এসব আমি জানি না। বাজারি লেখক বলে কোনো কিছু আছে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। শুধু জানি দুইটি বিষয়- আমার লেখা হয় অথবা হয় না, সাহিত্য হয় অথবা হয় না। এই দুই ভাগে লেখক বিভক্ত। বাজারি লেখক, জনপ্রিয় লেখক বুঝি না। বহু জনপ্রিয় লেখক দুর্বল লেখক। আবার বহু অসাধারণ তেমন লেখক জনপ্রিয় হয়নি। তাদের বই-টই তেমন বিক্রি হয় না। এসব কোনো ধর্তব্যের বিষয় নয়। বাংলাদেশে এসব আলোচিত হয়, কারণ এখানে পাঠকসংখ্যা জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য। কাজেই এই নগণ্য সংখ্যক পাঠক নিয়ে কিছু বলারও নেই। এদের সামান্য একটা অংশ পড়াশোনা করে। এখন আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে। আধুনিক প্রযুক্তি এসে লেখা-পড়ার ধরন পাল্টে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে অন্য জায়গা থেকে সব পাওয়া যায়। ইনফরমেশন বেড়ে গেছে। ইন্টারনেট ঘাটলে সবকিছু পাওয়া যায়। নলেজ বাড়–ক আর না বাড়–ক, খবর বেড়ে গেছে। এখন সাহিত্যের পাঠই কমে গেছে। প্রকাশকরা ছোটগল্পের বই প্রকাশ করতে চান না। গল্পের পাঠক কম। প্রকাশকদের সাথে কথা বলে জেনেছি, তারা ঢাউস ঢাউস উপন্যাস বের করতে চান। এগুলো বিক্রি হয়। ছোটগল্প আলাদা করে পড়া হয় না। শুনেছি ছোটগল্পের বাজার খুব খারাপ। আন্তর্জাতিক বাজারেও দেখা যায়- কবিতার বই নেই। কবিতার বইও বিক্রি হয় না। তবু কবিতার দাম একটু বেশি।
শফিক হাসান : বর্তমানের লিটল ম্যাগাজিন চর্চা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
হাসান আজিজুল হক : লিটলম্যাগের ঝাঁঝালো একটা সময় ছিলো। বড় বড় প্রতিষ্ঠান যখন সমস্ত কিছু গ্রাস করছিলো, বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি- তখন লিটলম্যাগের বিদ্রোহ করার একটা জায়গা ছিলো। একদম বুক উঁচু করে দাঁড়ানোর। আমার মনে হয় না লিটলম্যাগের এখন সেই ভূমিকাটা আছে। এখন সাধারণ লেখাই লিটলম্যাগে ছাপা হচ্ছে। সেই তীব্র বিদ্রোহ, নতুন ধারণা নেই- আগে দেখতাম। এখন বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন প্রচুর- যেভাবে পারে বিজ্ঞাপন নিয়ে মোটা, ঢাউস ঢাউস একটা একেকটা সংখ্যা হচ্ছে। নিয়মও কিছু নেই। অনেকে লেখা একসঙ্গে করে সাধারণ লেখাই লিটলম্যাগে ছাপা হচ্ছে। বড় লেখকদের যে ধরনের লেখা বড় কাগজে ছাপা হচ্ছে, সেগুলোও লিটলম্যাগে ছাপা হচ্ছে। এ দুয়ের পার্থক্য কী- বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি। লিটলম্যাগ প্রচুর লেখক তৈরি করেছে, বহু বিষয় তৈরি করেছে। অনেক জিনিস ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন যদি বিজ্ঞাপন টিজ্ঞাপন এটা ওটা নিয়ে লিটলম্যাগ প্রকাশ করা হয়- তার মানে নানান জায়গায় আপস করেই লিটলম্যাগ হচ্ছে। লিটলম্যাগের আগেকার সেই চরিত্র আর থাকছে না, জোয়ারটা থাকছে না।
শফিক হাসান : আপনার দৃষ্টিতে এসময়ের সম্ভাবনাময় গল্পকার কারা?
হাসান আজিজুল হক : আমি নির্দিষ্ট করে কারো নাম বলবো না। অনেকেই ভালো লিখছে, আবার বেশিরভাগই খারাপ লিখছে।
শফিক হাসান : নবীন গল্পকারদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
হাসান আজিজুল হক : লেখালেখিতে চর্চার কোনো বিকল্প নেই, কারো সাথে কোনো আপস নেই। সেই সঙ্গে সঙ্গে জীবনকে গভীরভাবে দেখার দৃষ্টি দরকার। সিমপ্যাথিটা এমন হওয়া উচিত যাতে করে সেটা সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। একজন লেখক হয়তো বাংলাদেশের মানুষ। তার গল্প যদি পৃথিবীর মানুষের বৃহত্ব ধারণ করতে পারে তবে সেটা বিশ্বমানের গল্পও বটে।
0 Comments