Advertisement

উন্মেষ

ভরত রাজখোয়া-এর গল্প : একজন লজ্জাশীল মানুষ

onubad golpo weeklyunmesh.com

নতুন আঞ্চলিক দলটির জেলা সভাপতি ত্রিলোচন পাঠক পদত্যাগ করার খবরটা মানুষের মুখে মুখে বিভিন্ন মুখরোচক কাহিনির সৃষ্টি করল।
    
‘দলটির জন্য এটা ভালো লক্ষণ নয় কিন্তু খসলেই খসবে।’ কেউ একজন বলল। অন্য একজন বলল—’আমি জানি তো পাঠক এই দলে থাকলে বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না বলে ভেবেই পদত্যাগ করেছে।’ আমরা জানি পাঠকের জন্য রাজনীতি নয়।, পাঠক কথা আর কাজে এক। রাজনীতিতে কথা যদি পূর্বে, কাজ হতে হবে পশ্চিমে। ‘এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে থাকার মতো মানুষ পাঠক নয়। ‘
    
‘তিনি রেজিগনেশনে কী কারণ দিয়েছেন? ‘সচেতন মহলের দুই একজন জানতে চাইল। খোঁজখবর রাখা মহলের কোনো একজন বলল,’ ভেতরের কারণগুলো তো লিখে না। স্বাস্থ্যজনিত কারণে পদত্যাগ করেছে বলে লিখেছেন।’

হ্যাঁ ত্রিলোচন পাঠক নিজের পদত্যাগ পত্রে দলকে ভালোবাসা বা খারাপ পাওয়ার কথা লেখেননি। শুধুমাত্র লিখেছেন যে কিছু আভ্যন্তরীণ  অসুখে ভুগে থাকার জন্য তিনি দলের কাজকর্ম ভালোভাবে করতে পারছেন না এবং দলের বৃহৎ স্বার্থের খাতিরে স্ব-ইচ্ছায় পদত্যাগ করছেন।

বেশ কয়েকটি খবরের কাগজে লেখাটি প্রকাশিত হল। সাংবাদিক ছেলেগুলি খুব বুদ্ধিমান। তারা লিখেছে—’নিজের পদত্যাগ পত্রে সভাপতি ত্রিলোচন পাঠক স্বাস্থ্যজনিত কারণে পদত্যাগ করা বলে উল্লেখ করেছেন যদিও এই পদত্যাগের অন্তরালে অন্য কিছু কারণ আছে যা তিনি এখন বলতে চাইছেন না। পাঠকের মতো একজন ব্যক্তির পদত্যাগ জেলাটিতে দলের ক্ষতি করবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ সমষ্টিগুলিতে তার গুণমুগ্ধ মানুষের সংখ্যাও কম নয়।’

সাসপেন্সধর্মী খবরের সুন্দর বিবরণ। সকাল ছয়টার সময় বাজার থেকে বিভিন্ন জনের ফোন আসতে লাগল।
‘আমরা আপনার রেজিগনেশন একসেপ্ট করব না। আপনাকে উইথড্র করে নিতে হবে।’
 ‘আপনাকে কোনো কিছুর জন্য প্রেসারাইজ করা হয়েছিল নাকি?’

এই কয়েকজন  রাজ্যিক কমিটির মানুষ। নিজেদের জেলা থেকেও ফোনের সীমা সংখ্যা নেই। অবশেষে পাঠক মোবাইলটা অফ করে রেখে দিলেন। তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই সিদ্ধান্তের কখনও পরিবর্তন হবে না। পাহাড়টা দূর থেকে সুন্দর দেখায়। তিনিও দেখেছিলেন। কথাটা এতটুকুই।
     
প্রকৃতপক্ষেই ত্রিলোচন পাঠক প্রত্যক্ষ রাজনীতির মানুষ ছিলেনই না। তিনি জানতেন রাজনীতি মানেই সমাজ সেবা নয় আর সমাজসেবা মানেই কেবল সভা সমিতি নয়। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রায় মানুষগুলি নিজেকে সমাজকর্মী বলেই পরিচয় দেয়। কিন্তু নির্বাচনের ছয় মাস আগের সময়টুকুতে কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় না।

আর যদি কখনও কারও কাছে সহানুভূতি এবং ঘোষণা কিছু নিয়ে দাঁড়ায় ডাইনে বাঁয়ে খবরের কাগজের মানুষ নিউজ চ্যানেলের মানুষে ভর্তি হয়ে থাকে। বন্যার সময় হোক, অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় হোক  বা করোনার মতো আপদকালে হোক তিনি যে নিজে কুড়িঘর মানুষকে তিনশত টাকার কুড়িটা পুটুলি দিয়েছেন, সেই কথাটা সম্ভব হলে গোটা বিশ্বকে জানাতে হবে। এই প্রচারটার দ্বারা মন্ত্রী এমএলএ’র প্রিয় মানুষ হতে হবে বা নিজের ভবিষ্যতের জন্য যশের একটা একাউন্ট খুলতে হবে।
    
ত্রিলোচন পাঠক সেই শ্রেণির ব্যক্তি নয়। এই ধরনের মানুষকে তিনি যে শুধু  অপছন্দ করেন তাই নয় ঘৃণাও করেন। প্রচার না চেয়ে নিজের মতো করে তিনি কিছু কাজ করেন। তার নিজের গ্রাম বা পাশের গ্রামগুলির কোনো আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের ঘরে কোনো আর্থিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে কিনা, তিনি সেখানে খবর নেবার জন্য চলে যান এবং চট করে সবার অজান্তে সাধ্য অনুযায়ী এক বা দুই হাজার টাকা দিয়ে আসেন। সেই মানুষগুলোর উপাস্য দেবতা ঈশ্বর না আল্লাহ না গড সে সমস্ত তিনি বিচার করেন না। একজন সিরিয়াস রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হল গাড়ি নেই। দেরি করা সম্ভব নয় পাঠক নিজের গাড়িতে করে রোগীকে হাসপাতালে রেখে আসেন।

মেট্রিক পরীক্ষায় মেয়েটি ফর্ম ফিলাপ করতে পারছে না। দিন হাজিরা করে সংসার চালায়। পাঠক জানতে পেরে নিজে বাড়িতে গিয়ে ফরম ফিলাপের টাকাগুলি দিয়ে আসেন। পাঠক সারা জীবন এই ধরনের কাজগুলি করে এসেছে। কাউকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করার কথাটা তার মুখ থেকে কখনও প্রকাশ পায় না। যাকে সাহায্য করে তাকেও বলতে নিষেধ করে।

আজকাল প্রদর্শন কামিতা খুবই বেড়ে গেছে। কেউ যদি কখনও পথের পাশে বসে থাকা ব্যাপারীর কাছ থেকে দুমুঠো ঢেঁকি শাক, দুমুঠো কচু বা কলার গাছের মোচা একটা বেশি কিনে সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে দিয়ে দেয়। জনগণকে জানাতে হবে যে, তিনি দুমুঠো ঢেঁকি শাকের জায়গায় চারমুঠো কিনে বেপারীকে কত বড়ো সাহায্য করলেন। আজকালকার মানুষের প্রতিটি ভালো কাজের দাম চাই। পাঠক সেই ধরনের মানুষ নয়।

বকুল ফুল নিজের আনন্দে ফোটে। নিজের সুবাস নেবার জন্য কাউকে ডাকে না। আমি ফুটেছি বলে চিৎকার চেঁচামেচিও করে না। কিন্তু তার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।

ছোটোছোটো কাজগুলি মনে মনে করছিল যদিও পাঠকের সুগন্ধ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। পাশ থেকে দূরে। দূর থেকে দূরান্তে। কথাটা কানে এলে পাঠক লজ্জাবোধ করেন। তিনি মনে মনে ভাবেন কী আর এমন কাজ করেছেন।

যুবক বয়স থেকেই ত্রিলোচন পাঠকের লেখার অভ্যাস ছিল। বাস্তব ঘটনাগুলিকে তিনি সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে লেখার চেষ্টা করতেন। তার লেখাগুলি অসমের কয়েকটি পত্র-পত্রিকা যত্নের সঙ্গে ছাপিয়েছিল। সেদিক থেকেও পাঠকের একটা পরিচিতি ছিল।

পাঠকের আরও একটি বড়ো গুণ ছিল। তিনি প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা নিজের সহকর্মীদের ভালো গুণটাই দেখতেন। আর অন্যের কাছে সেই গুনটা ব্যাখ্যা করে মানুষটিকে উৎসাহিত করতেন। কারও প্রতি কখনও নেতিবাচক মন্তব্য পাঠকের মুখ থেকে বের হতো না।

আজকাল ষাট বছর বয়সে মানুষ সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে। অনেকেই তখনও সুন্দর স্বাস্থ্যবান হয়ে থাকেন। অবসর গ্রহন  করেছেন বলে মনে হয় না। ত্রিলোচন পাঠকও এরকম একজন ব্যক্তি। তাই তিনি অবসরের পরেও অনেকগুলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন।

পাঠকবাবু পারিবারিক ঝামেলা থেকেও মুক্ত। প্রায় ছয় বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। দুই ছেলে। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। তারা বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। সম্মান করে। তারাই কখনও পিতাকে ভালোবাসা মিশ্রিত রাগ দেখায়। কিন্তু পাঠক ওদের প্রতি কখনও রাগ দেখানো তো দূরের কথা ভালোবাসায় কখনও কম পড়তে দেয় না।

এভাবেই ত্রিলোচন পাঠকের দিনগুলি পার হয়ে যাচ্ছিল। অনাবিল শান্তিতে।
এমনই একটি দিনে পাঠকের পরিচিত কয়েকজন মানুষ এসে উপস্থিত হল। নতুন করে গঠিত হওয়ার আঞ্চলিক একটি দলের কর্মকর্তা তারা। তারা পাঠকের সামনে একটা প্রস্তাব রাখল। নতুন আঞ্চলিক দলটির জেলা সভাপতি আসনটা তাকে অলংকৃত করতে হবে। অনেক আলোচনা–পর্যালোচনার শেষে তারা পাঠকের কাছে এসেছে।
    
–আপনারা তো জানেনই আমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানুষ।
–জানি স্যার, আপনি শুধু পদবীতে থাকুন। বাকি কাজ জনগণ করবে। পাঠক কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। সিদ্ধান্তটা আগামীকাল জানাবেন বলেই তিনি তাদের বিদায় করে দিলেন।
     
নতুন আঞ্চলিক দলের সভাপতিকে ত্রিলোচন পাঠক আগে থেকেই শ্রদ্ধা করেন। মানুষটার নিজস্ব নীতি এবং আদর্শ আছে। জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। নিজের চেষ্টায় একটা সংগঠন তৈরি করে তিনি জনগণের পক্ষে কাজ করে চলেছেন। তার আপোষহীনতার জন্য জনগণ তাকে শ্রদ্ধা করে এবং পাঠকও সেই জন্যই তাকে ভালোবাসেন।

সেদিন বিকেলে পাঠক ছেলেদের সঙ্গেও আলোচনা করলেন। সারাজীবন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা মানুষটা এখন অবসরের পরে রাজনীতি করবেন কি করবেন না সেটা লক্ষণীয় কথা। আলাদা আলাদা দলের বড়বড় নেতাদের কাণ্ডকারখানা দেখলে লজ্জা হয়। বিভীষণ একবার দল বদলেছিল। এই নেতারা কয়েকবার দল পরিবর্তন করতে পারে। এই দলে আজকে এসেই কালকে নিজের দলকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ করতে পারে।
    
সিদ্ধান্ত হল ত্রিলোচন পাঠক নতুন আঞ্চলিক দলটির জেলা সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। সভাপতির নীতি আদর্শের প্রতি আকর্ষিত হয়েই তিনি বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু এটা ঠিক যে সমস্ত কর্মী সভাপতির মতো নাও হতে পারেন। যদি ভবিষ্যতে এই দলের কর্মীদের মধ্যেও অন্য দলের মতো কামড়া-কামড়ি, টানা-হ্যাঁচড়া দেখে তখন তিনি দল থেকে বেরিয়ে যাবেন।
    
পাঠক নিজের সম্মতির কথা আগের দিন উপস্থিত হওয়া লোক কয়েকজনকে জানিয়ে দিল। কয়েকদিন পরে জেলা গ্রন্থাগারে একটি জনসভার আয়োজন করে ত্রিলোচন পাঠককে আনুষ্ঠানিকভাবে সভাপতি নির্বাচন করা হল। উপস্থিত জনগণ বিপুল উৎসাহ দেখাল যেন তারা ত্রিলোচন পাঠকের জন্যই অপেক্ষা করেছিল। উপস্থিত জনগণের মাঝখান থেকে বেশ কিছু মহিলা উঠে এসে মঞ্চে ব্যক্তিগতভাবে পাঠককে সম্বর্ধনা জানাল। রাজনৈ্তিক জীবনের প্রথম দিনটি পাঠকের খারাপ লাগল না।

নিজের ভাষণ প্রসঙ্গে পাঠক মুক্তভাবে নিজের বক্তব্যটুকু তুলে ধরল,

‘আপনারা জানেন আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। যতটুকু পেরেছি ছাত্র-ছাত্রীকে আমার সামর্থ্য অনুসারে ভালো কথা শেখাতে চেষ্টা করেছি। এখন আপনাদের মধ্যেও আমি শিক্ষক হিসেবেই থাকব। দলের স্বার্থের খাতিরে আপনাদেরকেও কখনও বলব। আপনারা খারাপ পাবেন না। আরও একটি কথা, রাজনীতির জগতে আমি অত্যন্ত সক্রিয়। ষাট বছর পার হওয়ার পরে আমি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে এসেছি। আমারও আপনাদের শলা-পরামর্শ প্রয়োজন হবে। আমরা পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে এগিয়ে যাব। সবাইকে উৎসর্গের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। বিধান সভার নির্বাচনের আর মাত্র ছয় মাস আছে।’
পাঠকের কথায় জনগণ জোরে জোরে হাততালি দিল।
পাঠক উদাত্ত কণ্ঠে আরও একটি কথা বলেছিল, ‘আমি এখন ষাট পার করে এসেছি। কিন্তু কুড়ি বছরের যুবকের মতো আপনাদের সঙ্গে কাজ করব। আমি আপনাদের সামনে থাকব।’
    
আর সত্যি সত্যিই জেলাটির চারটি সমষ্টিতে দিন-রাত বিচার না করে ঘুরেছিল পাঠক। সংগঠনের কাজে গ্রামের অত্যন্ত গভীরে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। নতুন দলটির প্রতি জনগণ যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছিল। পাঠকের ভালো লেগেছিল। পাঠক সভাপতির পদে থাকার জন্য মানুষের আস্থা বেড়েছে বলে জনগণ জানিয়েছিল। পাঠক গৌ্রববোধ করেছিল।

সমষ্টির সভাগুলিতে ত্রিলোচন পাঠক খুব মূল্যবান দুই একটি কথা বলেছিল। আর সেই কয়েকটি কথা সমবেত জনগণকে ভালো লাগানোর জন্য মুখে বলেনি। অন্তর থেকে বলেছিল। গভীরভাবে বলেছিল।
    
এককুড়ি পনেরোটা বিভিন্ন সংগঠন একত্রিত হয়ে এই আঞ্চলিক দলটি গঠিত হয়েছিল। পঁয়ত্রিশটি সংগঠন একজোট হয়ে দলটি গঠন করেছিল। একটা সুন্দর উপমা দিয়ে পাঠক বলেছিল, মহিষাসুরের অত্যাচার যখন পৃ্থিবীতে বেড়ে গেল, তখন শক্তির আধাররূপী দুর্গা দেবীকে দেবতারা নিজের নিজের অংশ এবং শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছিল। দুর্গা দেবী একক ছিলেন না, তিনি ছিলেন দেবতাদের সমষ্টি এবং এবং সেই জন্যই তিনি অতি প্রতাপী মহিষাসুরকে সহজে কাবু করতে পেরেছিলেন। ঠিক সেভাবেই পঁয়ত্রিশটা সংগঠনের সম্মিলিত শক্তির সমষ্টি নিয়ে এই আঞ্চলিক দলটি গঠন করা হয়েছে এবং এই দলের হাতে যেকোনো রাজনৈ্তিক শক্তি পরাভূত হওয়াটা নিশ্চিত।
    
জনগণ পাঠকের মন্তব্যে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জানিয়েছিল। তিনি ডেভিড এবং গোলিয়াথের উদাহরণ দিয়েছিলেন। বিশাল বপুর গোলিয়াথ যুবক ডেভিডের হাতে পরাজিত হয়েছিল। ডেভিডের সাহস, দেশপ্রেম এবং বুদ্ধিমত্তাই হল এই জয়ের মূল কারণ। পাঠক দলের কর্মকর্তাদের ডেভিডের মতো হওয়ার জন্য আহ্বান করেছিল।
    
বাড়িতে হোক বা বিদ্যালয়ে হোক, ব্যক্তিগত হোক বা সামাজিক হোক প্রতিটি কাজই ত্রিলোচন পাঠকের মনোযোগের সঙ্গে করার অভ্যাস। এখন তিনি সংগঠনের কাজেও একই ধরনের মনোযোগ দিতে শুরু করেছেন। একজন ড্রাইভার নিয়ে সারাদিন গাড়িটা নিয়ে দৌড়ে বেড়ান। বাবার চরিত্রটা জানে বলে ছেলেমেয়েরাও খারাপ পায় না। রাতে এসে ঘরে ঢুকে। পরের দিন চায়ের টেবিলে আগের দিনের ভালোলাগা কথাগুলি বলেন। বৌমা মজা করে-বাবা না হলে এমএলএ হওয়ার ভোটে দাঁড়াক। ধ্যাৎ! তিনি হাসেন।
    
পর্যায়ক্রমে জেলার কয়েকজন কর্মী তার অতি বিশ্বস্ত হয়ে পড়ল। তার ওপরে জেলার মানুষ কতটা আস্থা রেখেছে সেই কথাও এই কয়েকজনের মাধ্যমে পাঠক জানতে পারেন।

এই সভাপতি পদটির জন্যও দুয়েকজন মনে একটা আশা রেখেছিল। সেই কয়েকজন এখন ভেতরে ভেতরে বিসম্বাদী। নিজে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না থাকলেও রাজনীতি জগতের ভেতরের খবরাখবর পাঠক জানেন। তাই কোনো দুয়েকজন সভাপতি হওয়ার ইচ্ছা পুষে রাখা কথাটায় তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না।

রাজ্য কমিটি থেকে জেলা সভাপতিদের কাছে নির্দেশ এল নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে সমষ্টি কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, বুথ কমিটিসমূহ গঠন করতে হবে। তিনি জেলার সংগঠক এবং সম্পাদকদের সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটসএপ যোগে জানিয়ে দিলেন। আর বিশেষ কয়েকজনকে ফোনও করলেন।
    
প্রবল উৎসাহে সমষ্টি কমিটি চারটে গঠন করা হল। পাঠকের জেলাটিতে সমষ্টির সংখ্যা চারটি। সমষ্টি কমিটিসমূহে আলাদা আলাদা সভাপতি, উপ সভাপতি, সম্পাদক থেকে শুরু করে সদস্য পর্যন্ত নির্বাচিত করা হল। কমিটির সম্ভাব্য তালিকা পাঠকের হাতে এল।
    
সমষ্টি কয়টিতে সম্ভাব্য প্রার্থী। কয়েকজন সংগঠনের কাজে নেমে পড়ল। টাকা-পয়সাও খরচ করছে। মিটিংগুলির সম্পূর্ণ খরচ তারাই বহন করছে। মানুষের মধ্যে জাগরণ আনার জন্য তাঁরা সমর্থ হয়েছে।

ধীরে ধীরে পাঠক অনুভব করতে আরম্ভ করলেন দলীয় কাজ-কর্মে যেন স্থবিরতা এসেছে। কোথাও কিছু বিসঙ্গতি হয়েছে। তিনি সমষ্টির কোনো একজন কর্মকর্তাকে অগ্রগতির বিষয়ে জানার জন্য ফোন করলেই তারা স্পষ্টভাবে কোনো কিছু বলতে চায় না। কেউ ফোন করে বলে, সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট তাদের টাকা-পয়সা দেয়নি। কীভাবে কাজ করবে।
    
তারা সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট, টিকেট না পেতেও পারে। এখনই তারা এত টাকা-পয়সা কীভাবে খরচ করবে। সভাপতির মর্যাদা রেখে পাঠক নিজের পকেট থেকে দুই-চার হাজার টাকা খরচ করে কয়েকটি সভার আয়োজন করলেন। পাঠক ধৈর্য হারালেন। বিশাল দলগুলি সমষ্টিতে খরচ করতে দেওয়ার জন্য এই দলটিও নিচের কর্মকর্তাদের পকেট গরম রাখতে হয়। সেবার মনোভাবে কেউ নেই। বুথ কমিটি পাতার জন্য এক হাজার করে টাকা পেলে তারা কাজ করতে পারবে। নাহলে তারা বিকল্প ব্যবস্থা নেবে।
    
বিকল্প ব্যবস্থা নেবে বলে ভয় দেখানোরও কারণ ছিল। সমসাময়িকভাবে আরও একটি রাজনৈ্তিক দলের উত্থান ঘটেছিল। সেই দলটিও সরকার গঠন করবে বলে হম্বি-তম্বি করছিল। তাই পাঠক সভাপতি হয়ে থাকা দলটির কিছু কর্মী সেই দলটিতে যোগদান করবে বলে ভয় দেখাচ্ছিল। ইতিমধ্যে দুয়েকজন চলে গেছে।
পাঠক দেখল এদের নীতি-আদর্শ কিছুই নেই। আগে যেরকম ছিল এখনও তাই। তারা যখন নিজের নিজের সংগঠনে ছিল তখন নিজের সংগঠনের নীতি মতে চলছিল। কিন্তু প্রত্যেকেই মিলে একটা আঞ্চলিক রাজনৈ্তিক দল গঠন করার পরে, দলের একটি সংগঠন থাকার পরে  তারা আগের মতো কাজ করতে চাইলে কীভাবে হবে? না এই কথাটা পাঠক কাউকে বোঝাতে পারলেন না। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতে চলতে চায়।
    
এমনকি সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিও বিভিন্ন মানুষের পেছনে দৌড়ে বেড়াতে লাগল। নিজে নিজে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে লাগল। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে সভাপতির অনুমতি ছাড়া আপনি কেন এই কাজটা করছেন, তার উত্তরে হয়তো বলেছে এই ধরনের সভাপতি না হলেও হবে। সেই মন্তব্যটা পুনরায় আবার পাঠকের কানে পৌছে দেবার মতো লোকও তাদের মধ্যেই আছে।
    
রাজপথে শোভাযাত্রা বের করা, ধর্ণা দেওয়া, পথ বন্ধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা, অনশন করা প্রস্তাবগুলি পাঠক নাকচ করে দিল। আঞ্চলিক দলটির কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতিটি সভায় শাসনাধিষ্টিত সরকারকে গালিগালাজ দিয়ে নিজের ভাষণটা আরম্ভ করতে চায়।যা পাঠক কঠোরভাবে বাধা দিল।

দলটির কল্যাণ কামনা করা ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে পাঠক নিজের জেলার কয়েকটি সমষ্টিতে তৃণমূল পর্যায়ে দলের কাজ করে থাকা দুয়েকজন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করল। পাঠের বিশ্বাস ছিল সমষ্টির জন্য টিকেট দেওয়ার সময় রাজ্যিক সমিতি জেলা কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করবে। তাই পাঠক প্রতিটি সমষ্টিতে এই ধরনের কাজ করা মানুষের এগিয়ে দেবার কথা মনে মনে ভাবলেন। সেই ব্যক্তিরাও আগ্রহী। পাঠক জানে নির্বাচনে জিততে না পারলেও এই কয়েকজন অন্তত ভালো পজিশন দখল করতে পারবে, এটা দলের পক্ষে শুভ লক্ষণ হবে।

নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসছে। পাঠক বিশ্বস্ত ব্যক্তির মাধ্যমে সব জানতে পারছেন। দলের কয়েকজন সদস্য নিজের মতো করে অতিগোপনে কিন্তু গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পেরে, নিজের পছন্দের সম্ভাব্য প্রার্থীকে নিয়ে দলের সভাপতির আড়াল করেও এই ধরনের কাজ করতে পারে তিনি কখনও ভাবেননি। এখন না ভাবাটাই হল।

রাজ্যিক কার্যালয়ে ইচ্ছুক প্রার্থীর আবেদন চেয়ে সভাপতিকে চিঠি পাঠাল। সার্কুলারটাতে একটা কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা রইল যে, প্রতিটি আবেদন সভাপতির মাধ্যমে রাজ্যিক কার্যালয়ে জমা করতে হবে। সময় মাত্র দুদিন। পাঠক যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে কাজ করে নির্দিষ্ট তারিখে ইচ্ছুক প্রার্থীর আবেদনসমূহ রাজ্যিক কার্যালয়ে গিয়ে জমা দিলেন। কিন্তু পাঠক আশ্চর্য হলেন, জেলা সভাপতি হিসেবে কোনোকালেই নাম না শোনা দুজনকে যখন দুটো সমষ্টিতে টিকেট দেওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে বলে তিনি জানতে পারলেন।
    
আরও সাংঘাতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। জেলা সভাপতি ত্রিলোচন পাঠককে ঠেলা মেরে ফেলে দিয়ে বেশিরভাগ টিকেটের ব্যবসায় নেমে পড়ল। কয়েকটি সংগঠন একত্রিত হয়ে এই দলটি গঠন করা হয়েছিল।প্রত্যেকেই এই দলের সংবিধান মেনে চলার কথা ছিল।
    
কিন্তু এখন দাবিগুলি আলাদা হয়ে গেল। আমরা অমুক সংবিধানের মানুষ, আমাদের মতে এটা হতে হবে, আমরা তমুক সংবিধানের মানুষ, আমাদের মতে সেটাই হতে হবে।

কিছু লোক তাকে ফোন করে বলে, ’আপনি নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন কেন, এভাবে করুন, সেভাবে করুন, পরামর্শ নয় নির্দেশ।’ পাঠক বুঝতে পারল, জোড়া-তালি দিয়ে নির্মাণ করা এই গাড়ি তিনি চালাতে পারবেন না। গাড়িটা চলতে শুরু করলেই পার্টসগুলি কিছু অদ্ভুত চরিত্র প্রদর্শন করে।
    
অসময়ে হর্নটা বাজে, এসিটা অন্ধকারে আরম্ভ হয়ে যায়। স্টিয়ারিংটা পাঠকের হাত দুটি টেনে নিতে চায়। মোটকথা গাড়িটা নিয়ন্ত্রণে আসে না। ত্রিলোচন পাঠক বুঝতে পারলেন এই গাড়ি চালানোর যোগ্যতা তার নেই। তিনি পারেন না। দলের নেতাকে পাঠক ভালোবাসতেন। তার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার একটা আশা রেখেছিলেন কিন্তু রাজ্যিক কার্যনির্বাহের অফিসারদের পাঠকের ভালো লাগল না।

পাঠকের জেলার দুটি সমষ্টিতে দল টিকেটই দিল না। একটা সমষ্টিতে দেহে-মনে কাজ করা টিকেট প্রত্যাশী মানুষ থাকতেও ওপর থেকে ফেলে দেওয়ার মতো আকস্মিক একজন প্রার্থী দিয়ে দিল। একটি সমষ্টির দলীয় প্রার্থীকে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে টিকেট জোগাড় করতে হল।

আর পুরো প্রক্রিয়াটিতে জেলা সমিতি বা সভাপতিকে অবজ্ঞা করা হল। একটা ফোন করে পরামর্শ করা দূরের কথা তাদের সিদ্ধান্তটিকে জানানোর মতো ন্যূনতম সৌজন্য কোনো রাজ্যিক অফিসার দেখাল না।

জেলাটির কোনো একজন কর্মচারী পাঠককে এই সম্পর্কে দুই একটি কথা জিজ্ঞেস করলেও পাঠক উত্তর দিতে পারলেন না। ত্রিলোচন পাঠক সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। আত্মমর্যাদা লাঘব করাকে যদি রাজনীতি করা বলে, তাহলে সেই রাজনীতি পাঠক করেন না।

দলের ক্ষতি হতে পারে বলে নির্বাচনের আগে পাঠক পদত্যাগ করলেন না। ফলাফল খারাপ হওয়ার জন্য পদত্যাগ করা বলে কেউ সমালোচনা করে বলে ফলাফল ঘোষণা করার পরে সঙ্গেসঙ্গে পদত্যাগ করলেন না।

আর অবশেষে, স্বাস্থ্যজনিত কারণে ত্রিলোচন পাঠক নতুন আঞ্চলিক রাজনৈ্তিক দলটির জেলা সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলেন।

Post a Comment

0 Comments