শেষ পর্ব
এই মুহূর্তে আপনার একটা গল্প নিয়ে গল্প করতে বলি, কোন গল্পটাকে বেছে নেবেন?
মনি হায়দার : ‘টস’ নামে আমার একটা গল্প আছে, সেই ‘টস’কে বেছে নেবো। এই গল্পটায় তিনটি নারী চরিত্র আছে। প্রথম নারী চরিত্রটি আমার নিজের চোখে দেখা। সেই চরিত্রটাকে কেন্দ্র করে গল্পের আখ্যান বুনতে বুনতে আরও দুটি চরিত্র করোটিতে চলে আসে।
‘টস’ গল্পটা কোন বইয়ে আছে?
মনি হায়দার : ‘থৈ থৈ নোনাজল’ বইয়ে আছে। বইটা বের হয়েছিল ঐতিহ্য থেকে ২০০৬ সালে। ওই বইটায় বেশ কয়েকটি গল্প আছে, যা খুবই ভালো। কিন্তু সমস্যা হলো- গল্প খুব কম মানুষই পাঠ করে। ফলে আলোচনায় আসে না।
‘টস’ গল্পের আখ্যান শুনতে চাই।
মনি হায়দার : আগেই বলেছি, এই গল্পটায় তিনটি নারী চরিত্র আছে। প্রথম চরিত্রটি আমি বছর দশ বা বারো বছর আগে এক বৃষ্টিমুখর দুপুরে আবিষ্কার করেছিলাম। তখন আমি শাহবাগের বেতারে চাকরি করি। বিকেলে, গল্পকার ও টিভি প্রযোজক ফরিদুর রহমানের সিদ্ধেশ্বরীর অফিসে বসি। বেশ বড় অফিস। বসে লেখা যেতো, আড্ডা হতো। সেই অফিসটা এখন নেই। কালী মন্দির সোজা পার হয়ে এলে ছোট্ট চৌরাস্তার ডান পাশে ছিলো অফিসটা। এখন বড় এ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে। তো এক দুপুরে রাস্তার পাশে জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছি। তুমুল বৃষ্টি। আশপাশে ছোট দু একটা হোটেল ছিলো। অফিসটা সামনে একটা মুদি দোকানও ছিলো। হঠাৎ দেখলাম একটা মেয়ে, বয়স আনুমানিক ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে, দোহারা গড়নের, মাথায় একটা মাঝারি সাইজের পুটলি নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যাচ্ছে। মেয়েটি আমাদের অফিসের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। দাঁড়ায় আমাদের বিল্ডিংয়ের বৃষ্টির পানি পাইপ দিয়ে রাস্তার মাঝখানে পড়ছিল প্রবলবেগে। মেয়েটি সেই পতনশীল পানির সামনে দাঁড়ায়। ঘাড় ঘুড়িয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে পুটলিমা রাস্তার উপর রেখে পানির নিচে দাঁড়ায়। আমি বাকিটা গল্প থেকে বলছি-
‘মেয়েটির পরনে ময়লা একটা শাড়ি। বুকের সঙ্গে আধ ছেঁড়া লাল রঙের ব্লাউজ লেপ্টে আছে। ব্লাউজের বাঁধন ছিঁড়ে স্বাস্থ্যবান স্তনজোড়া বেরিয়ে আসতে চায়। ...শরীরে পাতলা শক্তিহীন কাপড় থাকতে চায় না। কিছুক্ষণ ভিজে সে বিপুল উৎসাহে গোসল করতে থাকে। বুকে বগলে স্তনে স্তনের নিচে পেটে তলপেটে নাভিতে নাভির নীচে শরীরের সব জায়গায় জাদুকরের মতো ঢলতে ঢলতে সে গোসল সারে। আমি পথচারীরা, দোকানের লোকেরা দেখতে থাকি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে এক অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে বজ্রপাত হলো।মেয়েটি হঠাৎ পানির প্রপাতের মধ্যে বসে পড়ে শরীর মুচড়িয়ে অদ্ভুত কৌশলে ব্লাউজটা এক টানে শিল্পিত ক্ষিপ্রতায় খুলে আনে এবং তার অমূল্য স্তন দুটিকে কৌশলে দু’হাঁটুর মাঝখানে লুকিয়ে ব্লাউজটাকে রাস্তার উপর কাচতে থাকে। পিঠের উপর গলা পর্যন্ত পরিষ্কার, ফকফকা পরিষ্কার। বৃষ্টির প্রপাতে পিঠটা সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা চরের মতো জেগে ওঠে আমার চোখের সামনে। দেখে ভীষণ ভালো লাগে কিন্তু শরীরিক কোনো সংরাগ অনুভব করি না। কেবল মনে হয়, এতটুকু জীবনে দেখা একটি জীবন্ত শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। বৃষ্টি রঙ, মেয়েটির সুঠাম শরীর- ক্যানভাস।
ব্লাউজটা কাচা শেষ হলে মেয়েটি বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতেই আগের মতো শরীর মুচড়িয়ে অদ্ভুত কৌশলে বসে বসেই শরীরে ঢুকিয়ে নেয়। উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি। দাঁড়িয়েই পাশে রাখা পুটলিটা একটানে হাতে নিয়ে আগের মতো রাজহংসীর মতো গর্বিত গতিতে হেঁটে চলে যায়। আমি কেবল তাকিয়ে থাকি- তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবতে আরম্ভ করি- লাইজু, শূন্যতা এবং নামগোত্রহীন মেয়েটিকে। কে কতো বড় শিল্পী? লাইজু ব্যক্তি জীবনে অভিনয় করে। শূন্যতাকে অনেক দিন দেখি না খোলা জানালায়। আজ হঠাৎ বৃষ্টি¯œাত দুপুরে রাস্তায় দেখলাম মেয়েটিকে। কে এই মেয়ে? কত বয়স ওর? ওকে কি মেয়ে বলা উচিৎ? মেয়েটি কি বিবাহিত? স্বামী সংসার নিয়ে কোনো বস্তিতে এক খুপড়ি ঘরে সাজিয়েছে বিরান সংসার? সুঠাম কলাবতী শরীরকে সে কি মেলে দেয় স্বামী নামক পুরুষের কাছে? নাকি এসব কিছুই না। কেবলই একজন নারী? যদি তাই হয়, তাহলে আমাকে, অন্যান্য বাড়ির বারান্দায়, দোকানের কার্নিশে অপেক্ষমাণ অজস্র পুরুষ নামক সারমেয়দের কাতর লালাঝরা চোখের সামনে পরম অবহেলায় নিজেকে মেলে ধরলো কোন সাহসে? এই সাহস কোথায় পেয়েছে? কী নাম এই সাহসের? মেয়েটি আমাদের উপেক্ষার ভেতর দিয়ে কি সমাজের গালে থাপ্পড় মারলো?’
গল্পটা শেষ তিনটি লইন পড়ে বলছি। কারণ, আমি এই মেয়েটিকে দেখার পর থেকেই ভাবছি ওকে নিয়ে একটা গল্প লিখবো। কিন্তু আখ্যান কীভাবে সাজাবো? ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো পথে দেখা মেয়েটির সঙ্গে আরও দুটি চরিত্র যদি জুড়ে দিই, একটা গল্পের কাঠামো পেয়ে যাই। আখ্যানের ভূগোল অনুসারে উত্তম পুরুষে গল্পটি লিখতে শুরু করি। আমি একটি নাটক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষকের কাজ করি। সেই অফিসের বসের কাছে আসে লাইজু। যে নাটকে অভিনয় করে। কিন্তু বাজার ভালো না লাইজুর। আমার বসে কাছে আসে সময় কাটাতে। যাবার সময়ে বসের নির্দেশানুসারে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। এক বৃষ্টির দিনে আটকা পড়ে লাইজু। খুলে দেয়, জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার দুয়ার আমার কাছে। লাইজুর প্রতি আমার যে বিবমিষা ছিল, মুছে যায়, মানুষ যে কত কষ্টে বেঁচে থাকে! তৃতীয় নায়িকা শূন্যতা- যাকে আমি দেখি আমার অফিস থেকে সামনের বাড়ির জানালায়। তার সঙ্গে আমার দেখা হয় কালে ভদ্রে, সে নাচে রাগসঙ্গীত গানের তালে রাজকীয় পোশাক পরে নাচে। স্থান কাল ভুলে জানালা দিয়ে তার নাচ দেখি মাঝে মধ্যে। এখন নাচের সময়ে জানালা বন্ধ করে নাচে। জানি, আমি সামান্য মানুষ। এই রাজকীয় যৌগের সঙ্গে আমার যোগযোগ হবে না, কিন্তু মন থেকে মুছেও ফেলতে পারি না। মনে মনে আমি তার নাম দিয়েছি শূন্যতা।
তিনজনকে তিন দিক থেকে গল্পে স্থাপন করে আমি গল্পকার হিসেবে যেভাবে ফিনিশিং দিয়েছি, সেটাই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখন গল্পের শেষ তিন লাইন-
প্রিয় পাঠক, আসলে এটি গল্প হয়ে উঠেছে কি না, প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন পুরুষশাসিত সমাজে এই গল্পে বর্ণিত তিনজন নারীর কোনজনের পক্ষে যাবেন আপনি?
আসুন, একটা টস ধরি! কে জিতবে- লাইজু? শূন্যতা নাকি...!’
এই গল্পটা লিখতে পেরে আমি ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছিলাম।
দারুণ, দারুণ এবং দারুণ মনি ভাই। শাণিত গল্পকারের প্রথম কাজই হলো-শূন্য ক্যানভাসে গল্পের শরীর বুনে দেয়া। ‘টস’ চমৎকার একটি গল্প। আপনার আর একটি গল্প ঘাসকন্যা, এ গল্পের নামে একটা বইও আছে...।
মনি হায়দার : হ্যাঁ, ২০১৩ সালে বইটা বের হয়েছে কথাপ্রকাশ থেকে। দশটি গল্প আছে বইটিতে। আর কথাপ্রকাশ বইটির প্রোডাকশনও দিয়েছে পরিপাটি করে।
ঘাসকন্যা গল্পের পটভূমি কী?
মনি হায়দার : ঘাসকন্যা গল্পের আখ্যান খুবই চমৎকার। এটাও চোখে দেখা আখ্যানে গল্পটি লিখেছি। মনে আছে, আমি যখন বাংলা একাডেমিতে জয়েন করি, আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় টার্মে, ২০১০ সালের জুনে। তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাস উপড়ে ফেলে নতুন করে ঘাস এনে লাগানো হচ্ছিলো। আমি বরিশালের মানুষ। বাড়িতে মাঠে উঠোনে দেখেছি ঘাসের আস্তরণ। অবাক হয়ে সরকারের টাকা ধ্বংসের কাজ দেখছিলাম প্রতিদিন আসা যাওয়ার সময়ে। আর দেখছিলাম ট্রাক বোঝাই করে আনা ঘাস মাটিতে লাগাচ্ছে বেশ কয়েকজন নারী। যাদের ঘাস লাগানো কাজ পাহারা দিচ্ছে কন্টাকটরের এক টিংটিগে লোক। ওই লোকটাকে দেখে, আর অল্প বয়স্ক একটি মেয়ের দিকে তার লোলুপ চোখ দেখে, আমার মাথায় এই গল্পের আইডিয়া আসে। গল্পের ভেতরে বঙ্গবন্ধু বন্দনাও আছে। আছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নামফলকের ইতিহাস। মেয়েটি, যে এই গল্পের নায়িকা, তার পেটের ভেতরে যে জোঁকের বাসা- সেটা নিয়েছি শৈশবের একটি বাস্তব ঘটনা থেকে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে মিষ্টি আলুর চাষ হতো উঠানে। ঠিক চাষ না, দু একটা লতা রোপণ করলে, বেয়ে বেয়ে ভরে যেতো গোটা উঠান। তো বাড়ির মেয়েরা তরকারির প্রয়োজন হলে আলু শাক তুলতো। আমাদের বাড়ির এক মেয়ে, সঙ্গত কারণেই নাম বলবো না, সে আলু শাক তুলতে গেলে তার যৌনদ্বার দিয়ে চিনা জোঁক ঢুকে পড়েছিলো।
দুটো ঘটনাকে মিলিয়ে আমি ‘ঘাসকন্যা’ গল্পের খসড়া প্রস্তত করে লিখতে বসি। এবং ভাবনার সঙ্গে গল্প কাঠামোর ঐক্য অনেকটা রক্ষা করতে পেরে আমি তৃপ্তি বোধ করেছিলাম। সাধারণত একটা গল্পের আখ্যান অনেকদিন ধরে মাথার ভেতরে কাজ করে। ধীরে ধীরে গল্পটার গোটা মানচিত্র করোটির ডেস্কে লিখতে থাকি। লিখতে লিখতে যখন বুঝতে পারি, আমার কল্পিত গল্পের ডানা এখন আকাশে উড়বার মতো সক্ষম হয়েছে, তখন লিখতে বসি। দেখা যায়, কোনো কোনো গল্প তিন বছর, পাঁচ বছর এমনকি আরও অধিক বছর ধরে করোটির ভেতরে ধীরে সুস্থে বেড়ে উঠছে। এবং পরিপক্ব হওয়ার পর যখন লিখতে বসি, লেখার পর মনে হয়, এত বছর ধরে যে গল্পটাকে লালনপালন করেছি, সেই গল্পটাই হয়তো লিখেছি কিন্তু একশো পারসেন্ট নিজের মতো করে লিখতে পারিনি।
তখন কী করেন? বেদনাবোধে আক্রান্ত হন?
মনি হায়দার : বেদনাবোধে আক্রান্ত না হয়ে উপায় আছে? এক একটি গল্প কতো দিনরাতের সাধনার পর দুনিয়ায় আসে, সেই গল্পটা যদি সফল না হয়, একজন শিল্পী হিসেবে কষ্ট হবে না? খুব কষ্ট হয়। কষ্ট এবং অতৃপ্তি একজন লেখকের বড় সম্পদও বটে।
মনি ভাই, ‘ঘাসকন্যা’ গল্পের শেষটা তো ভয়ংকর-
মনি হায়দার : ভয়ংকর? না, আমি মনে করি আমাদের জটিল এবং সর্বনাশা সমাজে একটি মেয়ের শারীরিক এবং মানসিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য তার শরীরের কোষে কোষে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের কোনো অর্গান থাকার দরকার ছিলো। যেমন ধরুন, শুনেছি বনে এক ধরণের প্রাণী আছে, যাদেরকে শত্রু আক্রমণ করলে মুখ থেকে এক ধরনের লালা নিক্ষেপ করে, যে লালায় থাকে তীব্র বিষ। শত্রুর শরীরে পড়লে বিষাক্রান্ত হয়। আবার বন্ধু বা প্রেমিক হলে সে অন্যধরনের লালা নিক্ষেপ করে, যাতে থাকে আমন্ত্রণ। কেন এই প্রসঙ্গ আনলাম, মেয়েদের বিপদ হলো, প্রকৃতিগতভাবে যৌনাঙ্গের ভেতর দিয়ে পুরুষের কামরস ধারণের একটা প্রকৌশল আছে তাদের। কামতাড়িত বর্বর পুরুষেরা কামরস ছেড়ে দিয়ে চলে যায় কিন্তু বিপদে পড়ে মেয়েরা। আমার প্রশ্ন, কেন নিরপরাধ মেয়েরা এই বিপদের বা সর্বনাশের রস বহন করতে বাধ্য হবে, যদি না সে বা তারা নিজের আগ্রহে সঙ্গমে না আসে? সেই ধারণাবোধ থেকে, আমি মনে করি নারীর শরীরে কলকব্জার মধ্যে কোনো না কোনো প্রকারের প্রতিরোধ থাকা দরকার। প্রকৃতি, নারীর প্রতি এই ক্ষেত্রে চরম অন্যায় করেছে। অবিবেচকের পরিচয় দিয়েছে। আমি সামান্য মানুষ- প্রকৃতির বিরুদ্ধে তো দাঁড়াতে পারবো না, তাই গল্পের ভেতর দিয়ে আমার চিন্তাকে প্রসারিত করেছি মাত্র। গল্পে ম্যাজিক রিয়ালিজমেরও একটা ব্যাপার আছে, আমার মনে হয়, ‘ঘাসকন্যা’ ম্যাজিক রিয়ালিজমের চরম প্রকাশও । অবশ্য পাপিষ্ঠ জ্ঞানীরা কী বলে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
গল্পের শেষটা বলবেন?
মনি হায়দার : আগ্রহী হলে শোনাতে আপত্তি নেই। ‘ঘাসকন্যা’ গল্পের শেষটা বলার আগে গল্পের শুরুটা সামান্য বললে ভালো হবে। তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভের কাজ চলছে। পুরোনো ঘাস তুলে নতুন ঘাস লাগানো হচ্ছে। অনেক মেয়ের সঙ্গে বরিশাল থেকে আসা এক মেয়ে জরিনা। যে জরিনা ছোটবেলায় আলুক্ষেতে আলুশাক তুলেছিলো এবং ওর ভেতরে চীনা জোঁক প্রবেশ করেছিলো। জরিনা চাচাতো দুলাভাই কাদেরের হাত ধরে ঘাস লাগাতে আসে উদ্যানে। জরিনার শরীর কাঠামো বেশ আকর্ষণীয়। কন্টাকটরের শ্যালক চিনটুর মনে ধরে। এবং চিনটু হাত করে কাদেরকে। কাদের টাকার লোভে নানাভাবে ফুসলিয়ে জরিনাকে একদিন পৌঁছে দেয় চিনটুর ফ্লাটে। এবং যা ঘটে- তা গল্পের শেষে, ‘বাঘের ক্ষিপ্রতায় চিনটু দুহাতে জাপটে ধরে জরিনাকে। সঙ্গে সঙ্গে জরিনা খিলখিল করে হাসতে শুরু করে। জরিনার খিলখিল হাসিতে চিনটুর শরীরে ক্রোধ জেগে ওঠে। সে মুহূর্তে জরিনাকে বিছানায় ছড়িয়ে দেয় মেলা থেকে কেনা দুই পয়সার বাতাসার মতো। জরিনার কাপড় সরে গিয়ে জোঁকের প্রবেশ পথ বেরিয়ে গেছে। কিন্ত জরিনা নির্বিকার। শরীর দুলিয়ে হাসছে খলিসা মাছের মতো। দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে প্রস্তুত জরিনা। প্যান্ট খুলে প্রস্তুত চিনটু। অভুক্ত রাক্ষসের শরীর নিয়ে এগিয়ে যায় জরিনার দিকে। রাগে ক্রোধে চিনটু এখন অগ্নিসিন্ধু।
বলে কি মাগী! চিনটুকে ভয় পায় না? দ্যাখ মাগী ভয় কাকে বলে- পলকমাত্র, জরিনার ভেতরে চিনটু প্রবিষ্ট হতে না হতেই জরিনার জোঁক প্রবেশের সুড়ঙ্গ তীব্র ঝংকারে খুলে যায়। অসম্ভব ক্রোধে ট্যাপের নলের মতো বের হয়ে আসতে থাকে টাটকা রক্ত, টাটকা রক্তের সঙ্গে শত শত ছোট ছোট চিনা জোঁক আর সবুজ টুকরো টুকরো ঘাস। রক্তে, ঘাসে আর জোঁকে চিনটুর শরীর লেপটে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব চিনটু। বিস্মিত চিনটু। বিমূঢ় চিনটু। দ্রুত সরে আসে রুমের এক পাশে। কী হচ্ছে এসব? কোত্থেকে আসছে এতোসব জোঁক রক্ত আর সবুজ টাটকা ঘাস? জরিনার ছোট্ট চকমকে শরীরের কাঠামোয় এসব আসবে কোত্থেকে? জরিনা এইকইভাবে শুয়ে আছে বিছানার উপর। দুদিকে ছড়ানো দুটি নধর চকচকে থাই, দুই থাইয়ের মাঝখান থেকে বেরুচ্ছে প্রবলবেগে টাটকা রক্ত, জোঁক আর সবুজ ঘাস। ক্রমশ বাড়ছে গতি বাড়ছে ঘাস, রক্ত আর জোঁকের। ভয়াবহ দৃশ্য। পাশবিক দৃশ্য।
ভয়ে চিৎকার করে চিনটু, এসব কী হচ্ছে? থামাও এসব। আমার ঘর নষ্ট হচ্ছে।
ঘর নষ্ট হচ্ছে! জরিনা খিলখিল হাসছে। রক্ত ঘাস আর জোঁকে ঘরটা ভরে যাচ্ছে। টাটকা রক্তের ভেতরে জোঁকগুলো জরিনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাসছে আর কিলবিল করছে। রক্তে জোঁকে আর ঘাসে ঘরটা ইতিমধ্যে এক বিঘত ভরে উঠেছে। গা ঘিনঘিন করছে চিনটুর। বমি আসছে। ভয়ে বিহ্বলতায় দরজা খুলতে যায়, দরজা খুলছে না। দরজা বন্ধ। কে বন্ধ করেছে দরজা? চিনটু এবার প্রচ- ভয় পায়। ত্রাসে তার কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। রক্তের ভেতর সন্তরণশীল জোঁকগুলো সারিবদ্ধভাবে ওর দিকে ধেয়ে আসছে। চিনটু প্রাণপণে দরজা কুলতে চেষ্টা করছে। দরজা খুলছে না। ধীরে ধীরে ঘরটা রক্তে ঘাসে আর জোঁকে ভরে উঠছে। শ্বাস নেয়ার জন্য হা করছে চিনটু। বাতাসেও রক্ত জোঁক আর ঘাস। ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করতে শুরু করে সে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁটু অবধি উঠে এসেছে রক্ত. ঘাস আর জোঁক। একটু হাওয়া একটু নির্মল বাতাস বড় দরকার চিনটুর। অসহ্য! চিৎকার করছে চিনটু- বাঁচাও বাঁচাও...।
ঘাসকন্যা জরিনা বিছানায় দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে পরম সুখে। মুখে বিদ্যুৎ হাসি। মনে হচ্ছে ওর শরীর শরীরের কোষে কোষে নেমে আসছে সুখের মধুর ঘ্রাণ। আপন মনে তারিয়ে তারিয়ে দেখছে, নিজের সুড়ঙ্গ থেকে প্রবহমান রক্ত জোঁক আর পাষাণ ঘাসের রোদন। অমিত বিস্ফোরণ। কোমর পর্যন্ত রক্ত চিনটুর। দরজায় মাথা ঠুকতে ঠুকতে রক্তাক্ত হচ্ছে। রুমটার অর্ধেক ভরে গেছে রক্তে, জোঁকে আর ঘাসে। খুব দ্রুত গোটা রুমটা ভরে যাবে রক্তে, ঘাসে আর কিলবিল করা জোঁকে।
ভয়াবহ বললেও কম বলা হবে আপনার ‘ঘাসকন্যা’ গল্প। শুরুতে আপনি যে প্রকৃতির প্রতিশোধের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তার সঙ্গে এই গল্পটি একেবারে মিলে যায়। শেষের চিত্রকল্প শুনে তো আমার শরীর শিউরে উঠেছে।
মনি হায়দার : কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কি জানেন? গল্প তেমন কেউ পাঠ করে না আজকাল। এমনকি আমাদের বন্ধুরাও পড়ে না। ফলে, অনেক ভালো গল্প পাঠকের অগোচরে থেকে যাচ্ছে।
গল্প লেখা কি থেমে যাবে?
মনি হায়দার : প্রশ্নই আসে না। গল্প লেখা অবিরাম চলতে থাকবে। যতদিন মানুষ থাকবে, মানুষের গল্পও থাকবে। এবং গল্প লেখাও চলবে। গল্প ছাড়া কি মানবসভ্যতা চলে? সভ্যতার প্রথম চরিত্র- গল্প। গল্পের ভেতরে মানবযাত্রার ইতিহাস যেভাবে এসেছে, পৃথিবীর অন্য কোনো সাহিত্যে তেমনভাবে আসেনি। আমি বাংলা ভাষার গুটিকয়েক গল্প ও গল্পকারের নাম বলছি- রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ এবং ‘মহানগর’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অতসী মামী’. জগদীশ গুপ্তের ‘শঙ্কিত অভয়া’, সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’ ‘অযান্ত্রিক’- এইসব গল্পের আখ্যানে যেমন মানুষের সর্বনাশ এসেছে, তেমন এসেছে লড়াইয়েরও ইতিহাস। সুতরাং সভ্যতা পাঠ মানে গল্প পাঠ। গল্পের বিকাশ মানে- গল্পের বিকাশ। গল্প ছাড়া অচল পৃথিবী।
২০১৫ সালের বইমেলায় আপনার আর একটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে, নামটা একেবারেই অন্যরকম। ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ ও অন্যান্য গল্প। নামের পেছনে কি কোনো ইতিহাস আছে?
মনি হায়দার : অনিবার্যভাবে ইতিহাস আছে। ‘১০ জানুয়ারী ১৯৭২ সাল’- বাঙালির জীবনে আর একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৬ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলো, পাকিস্তানি ৯৩ হাজার হায়েনা সৈন্যদের প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বাঙালির সেই স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ। কারণ, আমরা তখন পতাকা পেয়েছি, নির্দিষ্ট ভূখ-ও পেয়েছি, কিন্তু স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ, তার চির আরাধ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে নেই। তিনি বন্দি পাকিস্তানের কারাগারে, লায়ালপুরে। তিনি ছাড়া স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় কী করে? যদিও দেশের মানুষ সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বন্দিদশা থেকে মুক্ত, সারা দেশে উঠেছে লাল সবুজের পতাকা, কলকাতা থেকে স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে এসেছেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যরা, দেশের মানুষ জয়বাংলা শ্লোগানে শ্লোগানে ছাপান্ন্ হাজার বর্গমাইল মুখরিত করে রাখছে, কিন্তু সবার একটাই প্রশ্ন তিনি কোথায় আছেন? বেঁচে আছেন তো? নাকি রক্তপিপাসু জেনালের ইয়াহিয়া তাকে হত্যা করেছে?
এই তিনি বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা, রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে ছাড়া এই স্বাধীনতা ফ্যাকাসে। রক্তহীন। দিকে দিকে একই চিন্তা তাকে নিয়ে। পৃথিবী তোলপাড় তাকে নিয়ে। পৃথিবীর নানা দেশের নেতাদের চাপে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানের অসামরিক কিন্তু সামরিক প্রেসিডেন্ট মি. ভুট্টো। অনেক টালবাহানার পর ভুট্টো ১৯৭২ সালের আট জানুয়ারি মধ্যে রাতে লন্ডনগামী একটি বিমানে উঠিয়ে দিলে, নয় জানুয়ারি সকালে তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন মুক্ত মানুষ হিসেবে। নয় জানুয়ারি তিনি লন্ডনে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে পরের দিন, দশ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে দুপুরের পরে তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবতরণ করেন। বাংলার মাটিতে তাঁর পবিত্র পা দুখানি রাখার সঙ্গে সঙ্গে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অর্জিত স্বাধীনতা পায় পূর্ণতা। স্বাধীনতা পায় মহাকাব্যিক চরিত্র। বাঙালির ঠিকানা একজন শেখ মুজিব ধারণ করেছিলেন তাঁর নীলকণ্ঠে। নেতার আগমনের সংবাদে ছুটে আসে জনতা। চারদিকে মানুষ, মানুষ আর মানুষ। লাখ লাখ মানুষ। নেতা, প্রাণের নেতা ফিরে এসেছেন। তাঁর ফিরে আসার জন্য অনেক মা রোজাও রেখেছিলেন। নেতা খোলা একটি জিপে চড়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে লেগেছিলো তিন ঘণ্টা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার সামনে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, কান্নামাখা কণ্ঠে- ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিলো। আমার চোখের সামনে আমার কবর খুঁড়েছিলো। আমি বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান- মরলে একবারই মরে, বারবার মরে না। আমি হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে যাবো তবুও তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। আমার বাঙালিকে ছোট করবো না। শুধু একটাই অনুরোধ, আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে পৌঁছাইয়া দিও...। এমন ঘটনা, পৃথিবীর স্বাধীনতার ইতিহাসে বিরল। আমি দেখলাম- অনন্য ইতিহাসের ঘটনা নিয়ে কোনো গল্প নেই, এমনকি আমাদের পত্রপত্রিকাও খুব একটা গুরুত্ব দেয় না দিনটিকে। আমি মনে করি- বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার এই দিনটি ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, ৭ মার্চের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ সেভাবে কোনো আলেখ্য নেই সাহিত্যে। সেই চিন্তা থেকে আমি ‘১০ জানুয়ারী ১৯৭২’ গল্পটি ভাবলাম এবং লিখলাম। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার দিনটি নিয়ে আমিই প্রথম গল্প লিখলাম। সেই দিন এবং গল্পটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বইটিরই নাম রাখলাম- ‘১০ জানুয়ারী ১৯৭২ ও অন্যান্য গল্প’।
সাড়া কেমন পাচ্ছেন গল্পটির?
মনি হায়দার : এক কথায় অসাধারণ। ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে বইটি বের হয় বইমেলায়। আমার এক শুভানুধ্যায়ী পাঠক বইটি কিনে নিলেন। কয়েকদিন পরে তিনি আমাকে ফোন করলেন। আমাকে জানালেন, গল্পটি পড়তে পড়তে এক জায়গায় এসে তিনি থমকে যান। তার গলা ভারী হয়ে আসে। চোখে আসে জল। জায়গাটা গল্পের একটা চরিত্র খোকন, তরুণ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, যুদ্ধে যেতে চায়, কিন্তু পারছে না। কারণ, পাকিস্তানি আর্মি বাসায় এসে জানিয়ে গেছে, বাসায় এসে খোকনকে না পেলে ওর বাপ আলী আমজাদকে নিয়ে যাবে। পিতার জীবনের জন্য খোকনকে বাসায় থাকতে হয় দাঁত কামড়ে। সেই খোকন একদিন মসজিদ থেকে এসে জানায়-
“‘মা, আমি যুদ্ধে যাবো। পাড়ার শামীম ভাই সোহেল ভাই, দীপঙ্করদা, মজনু ভাই সবাই চলে গেছে।’
‘কোথায় গেছে?’
ক্ষেপে ওঠে খোকন, ‘তুমি জানো না বাঙালি ছেলেরা এখন কোথায় যায়? সবাই যুদ্ধে গেছে।’
‘যুদ্ধটা হচ্ছে কোথায়?’ ঢোকেন আলী আমজাদ।
‘যুদ্ধ কোথায় হচ্ছে না এখন, যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং দরকার। সেই ট্রেনিং নিতে সবাই ভারতে যাচ্ছে। ভারত সরকার বাংলাদেশের যোদ্ধাদের ট্রেনিং দিচ্ছে। আসামে, পশ্চিমবঙ্গে, আগরতলায়, ত্রিপুরায়- সব জায়গায় ট্রেনিং ক্যাম্প হয়েছে। হাজার হাজার তরুণ ট্রেনিং নিচ্ছে। দুই একদিনের মধ্যে আরও অনেকে যাবে।’ পা জড়িয়ে ধরে খোকন, ‘আমাকে যেতে দেবে মা?’
‘তোকে এসব কে বললো?’
‘আমার ক্লাসমেট রফিক।’
‘বললো কখন?’
‘নামাজে আমরা যখন সেজদায় যাই, তখন আমাদের মধ্যে এইসব কথা হয়েছে। আমরা এক সারিতে ছিলাম। আমি কিসলু রফিক আর ফারুক। ওরা চলে যাবে দু এক দিনের মধ্যে।’
বিস্মিত আফসানা খানম, ‘তোমরা সেজদায় গিয়ে যুদ্ধের কথা বলেছো?’
‘উপায় কী মা? চারদিকে পাকিস্তানি আর্মি নয়তো জামায়াতের চর। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বললে যদি ওরা সন্দেহ করে, তাই আমরা সেজদায় গিয়ে বলেছি। মা, আল্লাহ সব জানেন। দেশের জন্য যুদ্ধ করাও ইবাদত। মা, এখন বলো, আমাকে যেতে দেবে?’”
তিনি এটুকু পাঠ করে বললেন, আপনি মুক্তিযুদ্ধকে কতখানি ধারণ করেন, সেজদায় গিয়ে যখন আপনার চরিত্র যুদ্ধে যাওয়ার প্রসঙ্গ আনে, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়। ভাই, আপনাকে লাল সালাম। একজন গল্পকার হিসেবে একজন পাঠকের কাছ থেকে পাওয়া এই অভিমত আমার এতোদিনের অর্জন।
গল্পটা পড়া নেই, কিন্ত আপনার কাছ থেকে যেটুক বুঝতে পারলাম, তুলনারহিত গল্প। এখন জানতে চাইছি আগামীতে কি কি প্রকাশনা আসছে?
মনি হায়দার : গোটা পাঁচেক বইয়ের পরিকল্পনা আছে। আমি অনেক দিন ধরে বাচ্চাদের জন্য একটা সিরিজ লিখছি- পাতলাদা, সেই পাতালাদার একটা বই বের হবে, নাম ‘দড়ির উপর পাতলাদা’ নয়তো ভ্যানিস পাতলাদা। এছাড়াও বাচ্চাদের গল্পের আরও দুটি পাণ্ডুলিপি আছে। একটি পান্ডুলিপি আছে ‘পরিবেশ ও প্রকৃতির গল্প’ নামে, আর একটি আছে ‘বঙ্গবন্ধু ও রাসেলের গল্প।’ এদের দুজনকে কেন্দ্র করে আমার বিশটি গল্পের একটি পান্ডুলিপি আছে। বড়দের গল্পের একটি পান্ডুলিপি আধা তৈরি আছে। গত মেলার পর এ পর্যন্ত আটটি গল্প লিখেছি। আর চার পাঁচটা গল্প লিখলে একটি ছোটগল্পেরও পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে যাবে। দুটি দৈনিকে দুটি উপন্যাস যাবার কথা ঈদসংখ্যায়, প্রকাশের জন্য সে দুটিও প্রস্তত থাকবে। আরও নানা রকমের পাণ্ডুলিপি তৈরি আছে। ‘বারবনিতাদের গল্প’ নামে গত চার পাঁচ বছর ধরে একটি পান্ডুলিপি তৈরি করেছি- হয়তো সামনের মেলায় এটাও আসতে পারে। আরও একটি সম্পাদিত বইয়ের পরিকল্পনা আছে, বাংলাদেশের খ্যাতিমান ছয় সাতজন কথাাসিহত্যিকদের সাক্ষাৎকার নিয়ে।
বই নিয়ে আপনার অনেক পরিকল্পনা!
মনি হায়দার : সারাদিন এই নিয়েই থাকি তো, তাই আর কি!
মৃত্যকে কীভাবে প্রত্যাশা করেন?
মনি হায়দার : মৃত্যুর মতো। যেহেতু পৃথিবীতে প্রাণী হয়ে জন্মেছি, মৃত্য অনিবার্য। আমি মৃতুকে প্রিয়তমা প্রেমিকার মতো আলিঙ্গন করতে চাই চুম্বনের মতো। মৃত্যুর কাছে একটাই প্রার্থনা, মৃত্যু আপনি আসুন আমার জীবনে কোনো দুঃখ নেই। পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষের কাছে যা পেয়েছি, তার তুলনা নেই। হয়তো আরও পাওয়ার ছিলো, পাইনি, দুঃখবিলাস নেই। সুস্থ সবল দেহে যেন মৃত্যুবরণ করি। কারো করুণা, কারো কাঁধে হাত রেখে ধুঁকে ধুঁকে মরতে চাই না... আমার মনে হয় না মহামান্য মৃত্যুর কাছে আমি বেশিকিছু চেয়েছি।
মৃত্যুর পরের জীবন-
মনি হায়দার : ওই জীবন নিয়ে এক মুহূর্তও ভাবি না, কারণ, ওই জীবনে আমি বিশ্বাস করি না।
মৃত্যুর আগে, অন্তিম ইচ্ছে?
মনি হায়দার : আমার কোনো অন্তিম ইচ্ছে নেই। যতদিন বাঁচবো, লেখার সঙ্গে, গল্পের সঙ্গে যেন বাঁচি আর বাংলাদেশটা যেন রাজাকারমুক্ত হয়, এইটুকুই চাওয়া।
0 Comments