Advertisement

উন্মেষ

সেথা পড়শি বসত করে

soib_saifi_weeklyunmesh.com

শোয়েব সাইফী

কখন যে দাজ্জাল আকড়ে ধরেছে শিরায় উপশিরায়!
আসলে কি সে?
কাজলা দিঘীর পাড়ে রাত নেমেছে, কৃষ্ণ বর্ণের রাত। যে রাতে পূর্ণী পশরের মায়া থাকে না। জোনাকির আলো জ¦লে আলো নেভে জংলায়।
দিঘীর ও’পাড়ে একলা এক বটগাছ, বৃদ্ধ বটগাছ। ওর ডালে বসে নিঃসঙ্গ ডাহুক ডাকছে। ও ডাকে কী মায়া, অচিনপুরের মায়া, প্রেমের মায়া, সঙ্গী হারাবার মায়া।
কৌশিক এক পা এগিয়ে দিঘীর জলে তাকায়। ইচ্ছে করে কাজলা দিঘীর জলে পা ভেজাতে। কিন্তু এ জলে যে নামা নিষেধ! এক রাতে কাজলা এসেছিল পা ভেজাতে। ফজরে জলে ভাসা লাশ পাওয়া যায়।
এরপর এ জলে লোক আসে না। যারা আসে ভিন্ন কেউ আসে। কৌশিক প্রায় গভীর রাতে আসে। মৃত কাজলাও আসে খয়েরী শাড়ি পড়ে। ওরা দিঘীর পাড়ে বসে রয়। মায়া প্রেমের কথা কয়, ঘর বাঁধার কথা কয়।
এভাবে রাত বয়ে যায়। মসজিদে আজান হয়, ‘আস্সালাতু খয়রুম মিনান্নাউন।’
শ্বাস নেমে যায় বুক হতে। দিঘীর পাড় হতে বাড়ির পথে পা বাড়ায় কৌশিক। ‘কাজলা আজ আসলো না, বললেই হতো! দিঘীর পাড়ে অযথা অপেক্ষা’..
বড় অভিমান হয়, রাগ হয়। সময় বয়ে যায়, রাগ ক্রমে কমতে থাকে। একসময় রাগ মায়ায় রুপান্তর হয়। কাজলার জন্য ফের মায়া অনুভব হয়।
এক বয়স্ক আসছে। মাথায় টুপি, মসজিদে যাচ্ছে। আরামের ঘুম ছুঁড়ে ফেলে মসজিদে যাচ্ছে। নামাজে দাঁড়িয়ে মায়ার স্রষ্টার সাথে কথা বলার আশায়।
কৌশিক’ও রাত জেগেছে দিঘীর পাড়ে। কাজলার সাথে কথা বলার আশায়।
ওরা দু’জনেই রাত জেগেছে। এ সংসারের অনেকে’ই জেগে থাকে। কেউ জেগে থাকে দুনিয়ার মায়ায়, কেউ দুনিয়া ভুলে জেগে থাকে জায়নামাজে, কখনো প্রদীপ জ্বেলে, দয়াময়ের মায়ায়।
এ মায়া জীবন্ত। এ মায়া বসত করে অনুভবে। অনুভবের ঘরে বসে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে। কখনো কষ্ট বাড়ায়, কখনো সুখ সাগরে ভাসায়, কখনো ভাবায়, চিন্তা করায়, হাসায়।
এ মায়া হেঁটে চলে, সপ্ন দেখায়। কৌশিক থমকে দাঁড়ায়। মায়া কি সপ্ন দেখায়?
সপ্ন তো মায়া’ই দেখায়। ভরা পূর্ণীমার রাতে প্রণয়ীর শূণ্যতা অনুভব করায়, ঘর বাঁধার সপ্ন দেখায়।
এ মায়া কথা কয়, দেহের সাথে কথা কয়।
দেহ ভাবে, ‘কথা কে কয়?’
লালন তাই না বুঝে কয়, ‘এ হলো সাঁই।’ ধ্যাণে মগ্নে বিষণ্যতায় সাঁইকে খুঁজে বেড়ায়। পয়ার বান্ধে একতারায়..

দেহ কেবা উঠায়, কেবা জাগায়, কে নিদ্রা যায়, কে কথা কয়
আবার কার বা দেহ কে চালায়
লালন দরবেশে বলে, এই মানব জনম যায় গো বিফলে
হারামণি
৫ম খন্ড, পৃ. ১২

খঞ্জনি বাঁজছে বৃদ্ধ বটতলায়, দিঘীর ও’পাড়ে। সাদা শাড়ি পড়া নারী দেখা যাচ্ছে বটতলায়। ওরা উলু দিচ্ছে। বৃক্ষ দেবতার পূঁজো করছে সূর্যোদয়ে। গেরুয়া পোষাকে ঋষি মনিষী দেখা যাচ্ছে। ধুতি পড়া লোক মনিষীর পায়ে লুটিয়ে পরছে। সেজদা দিচ্ছে ভক্তিতে।
কৌশিক ভাবে, দু’জনেই মানুষ ওরা। এক মানুষ অন্যজনের পায়ে কেন সেজদা দেবে? পূণ্যের আশায়?
জগৎে পাপ পূণ্যের কি ভিত্তি আছে? পাপ পূণ্য হলো পয়সা বিনিময়ের মতন। পূঁজোয় পূণ্য, পূঁজো না করায় পাপ..
দয়াময় যেদিন তলব করবেন, ও’দিন সূর্য থাকবে মাথার এক বিঘে উপরে। মানুষ হবে একজনমের তৃষ্ণার্ত। জল হাতে একদল ‘আলো’ ঘুরে বেড়াবে। ওরা বলবে, পূণ্যের বিনিময়ে এ জল পান করতে পারো।
জনমের জমানো পূণ্যের বিনিময়ে মানুষ জল পান করবে। অতঃপর মানুষ কি নিয়ে দয়াময়ের সামনে যাবে? পূণ্যের থলি যে শূণ্য!
পাপ পূণ্য এক খেলা মাত্র। খেলা বীণে ভিন্ন কিছু নয়।
দুরদর্শী মানুষ মাথা নোয়ায় না। মাথা নোয়ায় ¯্রষ্টার কাছে। সঙসার যখন ঘুমিয়ে যায়, গভীর রাতে, চোখের জলে ওরা যন্ত্রণার কথা কয়, ‘সেদিন তুমি পাশে থেকো দয়াময়, যেদিন তুমি বিণে অন্য কেউ পাশে থাকবে না।’
খঞ্জনির শব্দ থেমে গেছে। পূঁজো সমাপ্ত। ঋষি মনিষী দেখা যাচ্ছে না। বটতলায় শুধু ধোঁয়া উড়ছে, ধূপদানি হতে সাদা ধোঁয়া উড়ছে। মনে হলো ধোঁয়ার পেছনে কেউ বসে আছে। খয়েরি শাড়ি দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার আড়ালে। ‘কে বসে ওখানে, কাজলা?’
কৌশিক মূর্তি বনে যায়, অচিন মায়ায় ডুবে যায়।
পিরিত এক অদ্ভুত জাদু। যে জাদু মানুষকে মুর্তি বানিয়ে দেয়, থামিয়ে দেয়, স্তব্ধ করে দেয়। অন্য এক জগৎে তখন দিন কাটে, রাত পোহায়।
কাজলা বলে এ জগতের নাম ‘মায়া জগৎ।’
এ মায়া জগতের মায়ায় কেউ দুনিয়া ভুলে যায়, কেউ ভুলে যায় আখেরাত। কেউ প্রণয়ীকে কাছে পায়, কারো আঙুলের ঈশারায় চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়।
কেউ বাসর করে, কেউ ধ্যাণ করে গুহায়।
এ মায়া জগৎ এমন’ই।
বাস্তবতা মায়ায় ভাসায় না। নরকের আগুনে পোড়ায়, দাজ্জালের উপসনা করায়। ‘গাধার কানের নিচে’ দাজ্জাল বাদ্যের ব্যবস্থা করে। সে বাদ্যের তালে সর্গের আমোদে বিভর হয় মানুষ, ডুবে যায় অন্ধকারে, অবচেতনে, অবলীলায়। কৌশিক জানে, এ কথা নয়, মহাকালের গল্প। দাজ্জাল যখন দড়জায় টোকা দেবে, সে শব্দ কেমন হবে!
দাজ্জালের এ গল্প’ও শেষ হবে। শুরু হবে অন্য গল্প। যে গল্পে থাকবে অন্য মায়া। সে মায়ায় ফের কেউ অবগাহন করবে, দয়াময়কে ডাকবে, দেখার জন্য আকুল হবে। ঝাপ দেবে উত্তপ্ত আগুনে। একসময় সে আগুন’ও শীতল হবে.. তাঁর মায়ায়।

Post a Comment

0 Comments