জবাকে আজ বিয়ে দেয়া হবে। বড় বড় দুটো চোখ তার, যেখানে সরলতার ছাপ স্পষ্ট। বাবা মা কেন এত তাড়াতাড়ি তার বিয়ের আয়োজন করেছেন তা সে জানেনা। শুধু জানে লাল শাড়ি, চুড়ি, সবকিছু তাকে পড়ে চুপ করে মাথায় ঘোমটা টেনে বসে থাকতে হবে।
সে শাড়ি, চুড়ি, দেখে অনেক খুশি হয়েছে। দুর সম্পর্কের এক চাচী এসে তাকে কানেকানে বলে গেছেন মেয়েদের বিয়ের দিন এত খুশি হতে হয় না। বিয়ের দিন হাসে নির্লজ্জ মেয়েছেলে।
চাচীর কথা শোনার পর থেকেই সে জোর করে মুখ ভার করে আছে। তার মাথায় আসছে না এত নতুন জিনিস তাকে আজ কিনে দেয়া হয়েছে তবুও সে খুশি না হয়ে মুখ ভার করে থাকবে কেন! খানিকক্ষণ পরে সরল দুটো চোখে জবা এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। বাড়িতে মোটামুটি মানুষজনের ভিড়।
জবার বাবা রহিম শেখ মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বড় একটা খাসি জবাই করেছেন। খাসির মাংস রান্না হচ্ছে তা জবা ঘ্রাণেই বুঝতে পারছে। তার খুব খেতে ইচ্ছে করছে। কতদিন হল মাংস খায়নি সে।
তাদের অসচ্ছল সংসারে মাংস বছরে এক দুইবারের বেশি খাওয়া হয়না। এত টাকা পাবে কোথায় রহিম শেখ। গতর খেটে যতটুকু আয় হয় তা এই ভাঙ্গা বাড়িটা মেরামত করতেই চলে যায়। গেছে বছর বন্যায় ঘরে দেয়া বাঁশের খুঁটিগুলো পঁচে একেবারে নেতিয়ে পরেছে। যা ঠিক করতে গিয়ে একেবারেই এলোমেলো হয়ে গেছে ‘মাথা গোজার’ ঠাইটুকু।
মনেমনে ভেবে রেখেছিলেন এই মাসে ঘরের কাজে হাত দেবেন। তাও হলো না। মেয়ের ভালো একটা সমন্ধ এলো। অনেক বড় গেরস্থ্য বাড়ি ছেলে পক্ষের। সবসময় এমন সমন্ধ নাও আসতে পারে।
তার স্ত্রী নীলু সবসময়ই একটা কথা বলেন, মেয়ে মানুষ হইলো লাউয়ের মত। কচি না থাকলে বাজারে দাম নাই।
মাইয়্যাডা তো ডাঙ্গর কম হইলো না। এই পোলা হাত ছাড়া করোন মানে আপনে বুঝবেন না জবার বাপ। ম্যাইয়াতো আর একখান না তিন তিনডা ম্যাইয়া। আপনার গতর ঠিক থাকতে এগো বিদায় না দিতি পারলে কুত্তা বিলাইও ফুচকি দিবোনা।
রহিম শেখ তার স্ত্রীর কথা একেবারে ফেলে দিতে পারলেন না। কয়েক মাস আগেই জলজ্যান্ত একটা প্রমাণও দেখেছেন নিজ গ্রামে। গলায় দড়ি দিয়ে মরল মৌরি। কোন দোষ ছিল না মেয়েটার। দোষ ছিলো সমাজের মানুষের চোখের। শ্যাম বর্ণ হওয়ায় তার বিয়ের সমন্ধ আসতো না। সবাই বলত এই ঢিঙ্গি ম্যাইয়ারে বিয়া করব কেডায়! এমন কুচকুচা রং পুরুষ মাইনষেরে মানায়। কথায় আছেনা সোনার আংটি বেহাও ভালো। মৌরি মেয়েটা নিজের রূপ নিয়ে যতটা না অসন্তুষ্ট ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিলেন প্রতিবেশিরা। একদিনতো মৌরির মা আঁচলে মুখ চেপে বলেই ফেললেন গলায় দড়ি দিবার পারস না। তোর লাইগা আমার ছোট মাইয়্যাডাও বুইড়া হইয়া যাইতেছে।
মৌরি মায়ের কথা রেখেছিলো। সে গলায় দড়ি দিয়ে সেদিন রাতেই ঘরের পাশের ছোট্ট ঝাকরা আম গাছটায় ঝুলতে থাকে। এরপর থেকে গ্রামের সবার মনেই মেয়েদের নিয়ে এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
রহিম শেখের ইচ্ছা ছিলো জবাকে পড়ালেখা শেখাবেন। নিজের যতই কষ্ট হোক। কারন মেয়ে যখন শিক্ষিত হবে তাদের সব অভাব দূর হবে। সবাই তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলবে। পাশের গ্রামের মিতু মেয়েটাকে সবাই কত ভালোবাসে। তরতর করে মেয়েটার বড় হওয়া চোখের সামনেই তো দেখেছে। আশেপাশের সব গ্রাম মিতুকে চেনে। কিন্তু মৌরির ঘটনাটা তার ভাবনার অন্যদিকে মোড় দিয়েছে।
যার কারনে মেয়ের সমন্ধ আসার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেছেন তিনি। মেয়ে জবাকে রহিম শেখের কাছে লাল শাড়ি পরায় টকটকে রক্ত জবার মতই লাগছে আজ। তবে ভেতরে খানিকটা চাপা কষ্টের ভিড় জমেছে রহিম শেখের। কতো ইচ্ছে ছিল জবা উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে কোন একটা সরকারি কলেজে ভর্তি হবে। কিন্তু তা আর হলো কই! গরীব মানুষের সব শখ পূর্ণ হতে নেই। সব শখ পূর্ণ হলে চোখের কোনের খাঁটি মুক্ত দেখার সুযোগ অনেক আগেই প্রকৃতি হারিয়ে ফেলতো! তাই তিনি নিজের অনুভূতির পায়ে শেকল টেনে ধীর পায়ে একেবারে মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
তারপর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, তোর কপাল ভাল। তা না হইলে কী তোর এত বড় ঘর থেইকা সমন্ধ আসত!
বাবার কথায় জবার মুখে কোন প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠে না। প্রসস্ত সরল দুটো চোখে শুধু বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে জবা। যার অর্থ রহিম শেখের জানা নেই। বাবা মেয়ের ভাবনার মাঝখানে কেউ একজন উঠোনের কোনের ছোট্ট জটলা থেকে বলে উঠলেন, বরযাত্রী আইয়া পড়ছে।
রহিম শেখ মেয়ের পাশ থেকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। বর পক্ষের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। নিজের সাধ্যমত সবার খাতির যত্ন করতে লাগলেন। এক সময় আরিফের সাথে বিয়ে পড়ানো হলো জবার।
ছেলে দেখতে মোটামুটি ধরনের। গায়ের রং ঝিমকালো। পুরুষ মানুষের আবার রং কি! একটা চোখ কিঞ্চিত ট্যেরা। তবুও রহিম শেখ বেজায় খুশি। সামান্য সমস্যা না থাকলে তাদের সাথে নিশ্চয়ই আত্নীয় করতে আসতেন না। মনে মনে তাই ছেলের এই সামান্য সমস্যাকে জবার জন্য আশীর্বাদ মনে করলেন।
দুরত্ব বেশি হওয়ায় ছেলে পক্ষ খুব বেশিক্ষণ দেরি করলেন না। জবাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে চলে গেলেন। নতুন শাড়ি চুরি দেখে জবা যতটা খুশি হয়েছিল সেটা মিলিয়ে গেলো নিজের উঠোনের গন্ডি পেরুতেই। আপন মানুষগুলোকে ছেড়ে যাবার তীব্র ব্যাথায় নির্বাক হয়ে রইল সে। সবকিছু বুঝে উঠবার আগেই অজানা আতঙ্ক নিয়ে পৌঁছে গেলো শ্বশুরবাড়ি। পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে অনেক রাত হলো তাদের।
রাতের কালিগোলা অন্ধকারে আরিফের দিকে চোখ পড়তেই জবার মনে হলো কালো কোন দৈত্য চোখ পিটপিট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে বড় একটা ধাক্কা খেলো সে।
এমন সময় শ্বাশুড়ি জবার কাছে এসে নিচু অথচ কঠিন স্বরে বললেন, দেখিতো মা তোমার চাঁদ বদন খানা? যদিও এই বাড়ির বৌঁ হবার কোনো যোগ্যতা বিচার করে তোমাকে আনা হয় নাই। তাও শুধুমাত্র পায়ের নিচে যাতে থাকতে পার তাই তোমাকে আনা। মাথায় উঠে বসার চেষ্টা করবা না ভুলেও। সব কিছু আগেই বলে নেয়া ভাল। এসব কঠিন কথায় জবার চোখ টলমল করতে লাগল। আরিফের জবার জন্য মায়া হচ্ছে। মায়ের মুখের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। শুধু অন্ধকারে জবার একটা হাত আলতো করে চেপে ধরল সে। জবার কাছে দৈত্য মনে হচ্ছিল যাকে তাকে এই মুহুর্তে একমাত্র নিরাপদ আশ্রয় মনে হচ্ছে। মানুষ নিজের জন্য নিরাপদ আশ্রয় চিনতে কখনো ভুল করে না। তাই আরিফকে চিনতে জবারও ভুল হলনা। রাত হয়ে যাওয়ায় সবাই ঘুমাতে চলে গেলন। আরিফের সাথে জবাকেও পাঠানো হলো বাসরঘরে।
জবা গরীব ঘরের মেয়ে তাই বাসর ঘরের কোন সজ্জা নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায়নি। একটা বিছানায় শুধু দুটো বালিশ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। আগে থেকেই হয়তো দুটো বালিশ'ই ছিল। দেয়ালে একটা ঘরি টানানো। দুজনই নীরব থাকায় ঘরিটার টিপটিপ শব্দ বোঝা যাচ্ছে।
নিরবতা ভঙ্গ করে আরিফ প্রথমে বলে উঠল, জবা?
জবা কোন উত্তর দিল না। মাথা নিচু করেই বসে রইল। আরিফ আবার ডাকল, জবা?
জবা এবার মাথা তুলে আরিফের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
আরিফ কোন রকম ভনিতা না করেই বলল, ‘তোমার মন খারাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। আমি কুৎসিত একজন মানুষ। তোমার চেয়ে বয়সেও অনেক বড়। তবে তুমি চাইলে আজ থেকে আমি তোমার ভাল একজন বন্ধু হতে পারি। আর এই বন্ধুত্বের দাবি নিয়েই আমার কাছে কিছু একটা চাও তুমি’।
আরিফের কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসেই রইল সে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবা ভয়ে ভয়ে বলল, আমি আমি.. পড়ালেখা করতে চাই। মিতু আপার মতো হতে চাই।
-সে আবার কে?
-আমাদের পাশের গ্রামের। খুব ভালো রেজাল্ট আপার। সবাই তাকে কত্ত আদর করে।
কথা বলতে বলতে জবার চোখ দুটোয় লাজ নম্রতার এক আলো খেলে গেলো। আরিফ মুগ্ধ হয়ে জবার মায়াময় চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর চোখ নামিয়ে নিল নিচের দিকে।
আরিফ কিছুক্ষণ ভেবে অবাক হয়ে বলল, ‘এত পড়ালেখা করে কী হবে জবা? কতো বড় গেরস্থ্য বাড়ির বৌঁ হয়ে এসেছ তুমি। চার চারটা কাপড়ের দোকান আমাদের। তুমি খাবা ঘুমাবা এত কষ্ট করতে হবে না। বিয়ের রাতে কেউ এমন আবদার করে! বোকা মেয়ে। অন্য কিছু চাও’।
-জবা আরিফের কথার কোন জবাব দিলোনা। কান্না পেলো তার। আর কিছুদিন পরেই এইচএসসি পরিক্ষা জবার। এই পর্যন্ত আসতে কতো কষ্ট করতে হয়েছে। যা কেউ অনুমান করতে পারলেও আঁচ করতে পারবে না। গ্রামের নানা জনে নানান রকম কথা বলেছেন। কেউ কেউ এও বলেছেন এহ্ ফুটানি। ‘ভাত পায় না, চা খায়’। কারো কথা কানে তোলেননি রহিম শেখ। নিজের সাধ্যমত মেয়েকে আগলে রেখেছেন। কিন্তু হঠাৎ করে জবার মায়ের আপত্তি ও যুক্তি তর্কের সাথে তিনি পেরে উঠেননি। সবকিছু এই মুহুর্তে জবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
জবা চুপ হয়ে আছে দেখে আরিফ আবার বলল, কী হলো কিছু বলছো না যে?
জবা ফুপিয়ে উঠল।
আরিফ কিছু বুঝতে না পেরে বলল, কান্নাকাটি করছো কেন? বাড়ির কথা মনে পরেছে?
- না। আমি বাড়ির জন্য কান্না করছি না।
- তাহলে আবার কী হলো? খারাপ লাগছে? বলো না আমাকে। কেন কান্না করছো?
- আমি পড়ালেখা করতে চাই। আমার অন্যকিছু চাইনা।
- বেশ খানিকক্ষণ ভেবে আরিফ বলল, আচ্ছা কালকে মায়ের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে দেখি। মা রাজি হলে আমার কোন আপত্তি নেই।
সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে এখন ঘুমানো প্রয়োজন। বেশ রাত হয়েছে।
এক বুক কষ্ট চেপে একসময় জবা ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙলো জবার। ঘুম থেকে জেগেই দেখলো জবার পাশে আরিফ অনেকগুলো বেলীফুল হাতে বসে আছে। জবা খানিকটা অবাক হলো। এত সকালে ফুল পেলো কোথায়! রাতের অন্ধকারে যাকে কালো দৈত্যর মতো মনে হচ্ছিল। ভোরের নরম আলোয় তাকে খুব মিষ্টি লাগছে। গতকাল রাতে আরিফকে ভালোমত খেয়াল করেনি জবা। শুনেছে ছেলের এক চোখ ট্যারা কিন্তু তেমন কিছুই জবার চোখে পরছে না। তাই বেশ হবাক হলো সে। তার অবাক হওয়া দেখে আরিফ বলল, কী ভাবছো এতো?
- আপনার না এক চোখ ট্যারা?
- হা হা
- ওটা ইচ্ছে করেই করেছিলাম। দেখো এইভাবে। বলেই আরিফ চোখ নাকের ডগায় বাঁকা করে তাকাতেই আবার ট্যারা হয়ে গেলো।
- কেমন চমক দিলাম?
- আপনি মানুষ হিসেবে ভালো না।
- হ্যাঁ, আমি তা জানি।
তবে শুনেছি তুমি অনেক শান্ত এখন তো বাকপটু মনে হচ্ছে। অবশ্য ভালোই হয়েছে তোমার কথা শুনেশুনে আমার অলস সময়গুলো ভালোই কাটবে।
হাত আগাও। তোমার জন্য বেলীফুল নিয়ে এসেছি। আমার গাছের। খুশি হওনি?
জবা ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। তার আতঙ্কের কারণ শ্বাশুড়ি। কারণ গতকাল যে রূপ দেখিয়েছেন তা ভাবতেই ভীষণ হতাশ লাগছে জবার। যদি ছেলের মুখে শোনে জবা পড়তে চায় তাহলে নিশ্চিত একটা গন্ডগোল বাঁধিয়ে ফেলবেন।
ভয়ে নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসলো তার। কারণ জবা খুব নিরীহ ধরনের মেয়ে। তবে আরিফের সাথে সহজেই এত কথা বলতে পারবে সেটা ভেবে নিজেই অবাক হচ্ছে।
জবাকে চুপ থাকতে দেখে আরিফ মৃদু একটা ধাক্কা দিল। তারপর মিষ্টি হেসে বলল, কী ভাবছো এতো?
- কই কিছু নাতো।
- তুমি কিন্তু বেলী ফুলের মতই শুভ্র সুন্দর। এটা জানো?
- মানুষ কখনো ফুলের মতো হয়?
- অবশ্যই হয়। যেমন আমার বৌঁ।
বলেই জবার হাতে ফুলগুলো দিয়ে বলল, চলো মায়ের রুমে যাই। জবা ভয়ে ভয়ে সম্মতি জানালো। মায়ের রুমে গিয়ে আরিফ আমতা আমতা করে বলতে লাগলো মা জবা পড়ালেখা করতে চায়।
তুমি কী বলো?
- এই জন্য এত সকালে মেয়েটাকে ঘুম থেকে উঠায় নিয়ে আসছিস?
- হ্যাঁ মা। তোমার অনুমতি ছাড়া কখনো তো কিছু করিনি।
- এহ্ কী ভালো ছেলে আমার। তোদের মতো ছেলেদের জন্যই প্রত্যেকটা বৌঁ শ্বাশুড়িকে খারাপ মনে করে।
এখন থেকে তোদের দুইজনের মাঝখানে আমাকে ডাকবি না। তোদের দুই জনের যেটা ভালো মনে হয় করবি।
আমিও এক সময় জবার মতো ছোট বয়সে বৌঁ হয়ে আসছিলাম। কিন্তু তোর বাপের স্বভাবের জন্যই আমাকে বেশি কাঁদতে হইছে।
এই মেয়ে খালি হাতে ফুল নিয়ে দাড়ায় থাকলে হবে। হাত দাও তো দেখি বলেই জবার শ্বাশুড়ি হাত থেকে স্বর্ণের বালাজোড়া জবার হাতে পরিয়ে দিলেন।
জবার হাতে হাত লাগতেই জবার মনে হলো শ্বাশুড়ির শরীর জ্বরে পুরে যাচ্ছে। জবা ভড়কে গিয়ে বলল, মা আপনার তো অনেক জ্বর।
- হ্যাঁরে মা। শরীরটা ভালো যায় না আজকাল। তাইতো অনেক খোঁজ খবর নিয়ে তোর মতো একজন লক্ষি খুঁজে এনেছি।
গতকালের কথায় কিছু মনে করিস না মা। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে প্রথম দিন ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন। আমি কোন প্রতিউত্তর করিনি। আমি চেয়েছিলাম তুই প্রতিবাদ করবি। কিন্তু না তুই আরেকটা গাধী।
শরীরটা বেশি খারাপ থাকায় তোর রুমটা কাউকে দিয়ে সাজানোর ব্যবস্থাও করতে পারিনি।
একটা কথা মনে রাখবি আত্নসম্মান ছাড়া কখনো মন বেঁচে থাকে না। তাই কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করবি না। আর অবশ্যই পড়ালেখা করবি। নিজেকে মূল্যায়ন না করলে জগত সংসার কেউ তোকে মূল্য দেবে না।নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বললাম কথাগুলা।
এই সংসারে খাটতে খাটতে এই পর্যন্ত আসছি নিজের কতো ভালোলাগা খারাপলাগা বিসর্জন দিতে হইছে। তাও কথায় কথায় শুনতাম এই সংসারের জন্য কী করছো। কামাই করার কষ্টতো বোঝনা।
কিন্তু দেখ একটা মেয়ে বাইরে যখন কাজ করে তখনো সবকিছু সামলে তাকে কাজে যেতে হয়। হাজারটা বাঁধা পেরুতে হয়। যে কোন ক্ষেত্রেই মেয়েরা এত বেশি করে যার কারনে সবাই মনে করে এগুলো মেয়েদেরই কাজ। ব্যাতিক্রম আছে তবে খুব কম।
সারাজীবন যে সংসারের জন্য নিজের সব বিসর্জন দিবি সেই বাড়িটাও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনো মেয়েদের থাকার নিরাপত্তা দেয় না। নিজের একটা ঘর থাকা জরুরি। যেখান থেকে কেউ তোকে পান থেকে চুন খসলেই তাড়িয়ে দেবার হুমকি দিতে পারবে না।
বাবার বাড়ি স্বামীর বাড়ির চাইতে একান্তই নিজের একটা কুঁড়ে ঘর থাকাও ভালো। এসব এমনি এমনি তোকে কেউ করে দেবে না। এর জন্য দরকার অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বি হওয়া। নিজের ভিত্তি মজবুত করার জন্য পড়ালেখার কোন বিকল্প নাই। নিজের পায়ের মাটি শক্ত করে যার জন্য যত ইচ্ছা কর।
তবে নিজেকে কখনো মূল্যহীন করে না। কথাগুলো মনে রাখিস মা।
শ্বাশুড়ির কথা শুনে জবা শ্বাশুড়ির বুকে মুখ লুকালো। সবকিছুই কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
আরিফ কিছুক্ষণ চুপচাপ সব দেখে হাসতে হাসতে বললো আম দুধ এক হলো আর আঁটি গেলো ঝোরে।
সবাই আরিফের কথায় এবার হো হো করে হেসে উঠলো। হাসির রেস মিলিয়ে না যেতেই জবার দু চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু মুক্তর মতো গড়িয়ে পরতে লাগলো। যেটা আনন্দের।
0 Comments