রবিউল ইসলাম
হারিয়ে গেছে দুর্বাঘাসের সেই দিনগুলি। চিকচিকে রোদ ঠিকরে পড়ে বিন্দু বিন্দু শিশিরকণায়। চুয়ে চুয়ে পড়া সেই শিশিরকণায় জড়িয়ে যায় মায়াবি আবেশ। শীতল হাওয়ায় মনের রেখায় উড়ে উড়ে ভেসে বেড়ায় ভালোবাসা-মায়ার আল্পনা। একটি টাকায় তিনটি হরিণ। শিংওয়ালা ছিপছিপে কী দারুণ হরিণগুলো। কীভাবে এরা টাকার পাতায় এলো? আমাদের ভাবনায় কতশত প্রশ্ন। জল্পনা। ঘোর। চারটি লজেন্স দিয়ে টাকা নেয়া সেইসব দোকানি কত কঠিন। টাকার সাথে তারা হরিণগুলোও নিয়ে নেয়! চকলেটগুলো নিয়ে টাকা না দিয়ে দৌড় দিলে কেমন হয়? এটা কী বলো? এটা করা যায়? দোকানির নালিশ পেয়ে বাবা আমাদের ছাড়বে? বন্ধুদের এমন সব ভাবনা কখনো ঠিক, কখনো ভয়, কখনো মনে হতো লজ্জার। এমনটা কখনো ঘটেনি। সুখের বিষয় চার চারটি লজেন্স পেলে মনটা ভরে যেত। দুঃখের বিষয় হরিণের টাকাগুলো দোকানি নিয়ে যেত!
আমাদের শৈশবে উচ্ছ্বল-তরঙ্গে রিমিঝিমি বৃষ্টি-হাওয়ার দোলাচল। কাকডাকা ভোর সকাল হয়ে আসে। বয়ে যায় মিষ্টি রোদের জোয়ার। পাশের বাজারে সমাগম। ক্রেতা-বিক্রেতার গমগম আওয়াজ। এ গ্রাম; সে গ্রামের কত ব্যবসায়ী দিনের শুরুতেই এসে যান তালবাড়িয়া বাজারে। কদু-কুমড়ো-চাল-ডাল-মাছের বাজার। স্মৃতির বাজার। সেই বাজার গড়েছে আরও তিনটি বাজার। নাড়ার চালের নিচে আদরে গড়ে তোলা মাটির চুলা। রান্নায় ব্যস্ত আমার মা। ফজরের নামাজের পর উঠান ঝাড়ু দিয়ে শুরু হয় দিন। আমার মায়ের কাজ যেন শেষ হয় না। লিকলিকে কাঠের নীলাভ ধোঁয়ার ফর্সা আগুন। কালো কড়াইয়ে তেলের জমিনে পেঁয়াজ পোড়ার সে কী গন্ধ! কড়াই থেকে নারকেলের আচায় করে নামাতে দেরি, মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে খেতেই হবে। মা আমার তরকারি রান্না করবে কীভাবে? পাতলা ঝোলের এই ফোড়ানি আমার বড় প্রিয়। প্রিয়তার সাথে সারাজীবন থাকা যায় না। এখন যেমন নেই। ইট-পাথরের বদ্ধ জীবন হরহামেশা আমাদের বিষিয়ে তোলে। অথচ সকালের সেই ফোড়ানি খেয়ে আমরা উধাও। উত্তরপাড়ায় গাছে ভরা বাগান। দিনের আলোয় অন্ধকার চারদিক। বাগানে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা ছোট্ট সরু কাঁচা সড়ক। বালুময় মিহি। কৈশোরে ভরা কত কত ছেলে। সবার হাতভর্তি সেই লজেন্সের খোসা। চাড়া খেলা। আমাদের গাঁয়ের ছোট্ট সময়ের খেলা। এ খেলায় পরে লজেন্সের খোসাগুলো টাকায় পাল্টে গেছে। আমাদের ছেড়ে আসা এই খেলাগুলো পরে রূপ নিয়েছে জুয়ায়। কী ভয়ঙ্কর!
সকাল গড়িয়ে দুপুর; বিকেলের কাঁধে সন্ধ্যের সম্ভাষণ। কোথায় নাওয়া; কোথাও খাওয়া- কে রাখে তার হিসেব। সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরতে হবে। গোসল না করলেও হাতমুখ ধুয়ে বসতে হবে বই নিয়ে। সন্ধের আগে বাড়ি না ফিরলে বাবার কাছে মায়ের নালিশ। বাবা আমার বসে যান শাসনের আসনে। আমার দুঃখী মন। কী আর করা। তালপাতার চাটখোল। বই হাতে শুধু নাড়াচাড়া। ছবি দেখা কাজ। টিপটিপ হারিকেন-কুপির আলো। হারিকেনের স্টিয়ারিং ঘোরাতেও সেই মজা! বাতাসে নিভে নিভে যায় কুপির আলো। জোরে জোরে পড়া এলাকার অভ্যাস। চুপিসারে পড়া নাকি ফাঁকিবাজদের কাজ। আঁকিবুকি এই সেই; রাতের খাবার, কোথায় পড়ালেখা? বসে থাকতেই হয়। পড়ালেখা নাকি দেখানোরও বিষয়! দিঘলিয়ার বড় বাজার থেকে বাবা আসেন রাত মাথায় করে। ঝিঝি পোকার কিচকিচ-ঝিকঝিক ডাক। গাঢ় কালো অন্ধকার। মাঝে মাঝে পিলে চমকে দেয় কুকুরের ঘেও-ঘেও-উ-উ ডাক। ঘরে না ফেরা অসহায় পাতিহাঁস খালের পাড়ে একাকী ডাকে প্যাক প্যাক। শেয়াল, ঘড়িয়াল বা সাপের হাঁকে খোপের মুরগিগুলোর সে কী করুণ সুর। আহা! সন্ধ্যেই যেন গভীর রাত। কোথায় পড়ালেখা। সকালের অপেক্ষা। কে দেবে তিন হরিণের একটি টাকার নোট। গুনে গুনে কিনতে হবে লজেন্স। খোসা নিয়ে যেতে হবে উত্তরপাড়ার বাগানে। খেলতে হবে চাড়া। আমার সেই টাকা। হরিণের টাকা। এক একটি টাকা। কেউ দেয় না এখন!
0 Comments