Advertisement

উন্মেষ

ধুয়াজারি’র প্রাণপুরুষ : পাগলা কানাই

pagla kanai, bongo weeklyunmesh.com

বঙ্গ রাখাল

পাগলা কানাই দেশে দেশে ঘুরে ঘুরে গান করে বেড়িয়েছেন। তাঁর গানে তিনি তৎকালীন সমাজকে তুলে ধরেছেন। যেখানে লালন শাহ তাঁর আখড়াতে শিষ্যদের নিয়ে গান-বাজনায় মত্ত- সে সময় পাগল তুলে ধরছেন সমাজের বর্ষার রূপ, আশ্বিনের ঝড়, কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগের কারনে মানুষের দুঃখ কষ্ট দরিদ্রতা হতাশা আর বানের অশান্ত ঢেউ, সমাজপতিদের করাল থাবা। ধুয়া জারির পদকর্তা পাগলা কানাই তিন সহস্রাধিক দেহতত্ত্ব, জারি, বাউল, মারফতি, ধুয়া, মুর্শিদী গানের স্রষ্টা। দেহতত্ত্ব কানাইয়ের গানের প্রধান উপজীব্য হলেও জনজীবন, সমাজ ও সমকালের ভাবনা তার গানে বড় জায়গা পেয়েছে।

সরকারী কর্মচারীদের নিয়ে আদালত বিচার সালিশ, থানা পুলিশ নিয়ে পাগলা কানাইয়ের অসংখ্য গান রয়েছে। যে গুলো থেকে বেরিয়ে আসে কালের ইতিহাস আর দিনকালে কথা।

পাগলা কানাইয়ের জ্ঞানের পরিমাপ করা যেত না। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনা করতে পারতেন। কোন ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখলেই গান রচনা করে ফেলতে পারতেন। গানের জন্য তিনি ঘুরেছেন দেশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। গান ছাড়া তিনি কোন কিছুই বুঝতেন না।

এই স্বভাব কবির সর্বাপেক্ষা পদচারণা ছিল ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। পরবর্তীতে তিনি ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফিরে পাবনা ও সিরাজগঞ্জে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। পাবনার বিখ্যাত ভাবুক কবি ফকির আলীমুদ্দীনের সাথে তাঁর আন্তরিক সখ্যতা গড়ে ওঠে। এ সকল অঞ্চলের বিভন্ন আসরে গান বেঁধে বিভিন্ন ভঙ্গীতে পরিবেশন করে হাজার হাজার শ্রোতাকূলকে ঘন্টার পর ঘন্টা সম্মোহিত করে রাখতেন পাগলা কানাই। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যেও রয়েছে-

‘কী মজার ঘর বেঁধেছে,
হায়রে ঘর বাইন্ধাছে দুই খুঁটির উপর।
পাগল কানাই বলে ভাই সকলে যখন আসবে ঝড়

ছয় রিপু ছেড়ে যাবে সারথী নাহি রবে
পড়ে রবে এইতো সাধের ঘড়’।

পাগলা কানাই ইসলাম ধর্ম নিয়ে যেমন অসংখ্য ধুয়াগান রচনা করেছেন তেমনি হিন্দু পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারত থেকে নানা উপমার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন তাঁর রচিত গানে। মরমীবাদ ও সুফিবাদের ভক্তি প্রকাশে পাগলা কানাই গানের মূল বাণী-

‘গেলো দিন
শুন মুসলমান মোমিন
পড় রাব্বুল আলামিন
দিন গেলে কি পাবি ওরে দিন
দিনের মধ্যে প্রধান হলো মোহাম্মদের দ্বীন’।

পাগলা কানাই একজন ধুয়া-জারির প্রাণ পুরুষ। কারবালার ট্র্যাজেডির করুণ মানবিক আবেদনের কারনে জাত ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকেই গভীরভাবে স্পর্শ করে থাকে। জনৈক লেখক বলেছেন- ‘মাইকেল মদুসূদন দত্ত কারবালার ঘটনা নিয়ে মহাকাব্য রচনার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। মীর মোশাররফ হোসেন রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপাখ্যানের আলোচনা প্রসঙ্গে অক্ষয়চন্দ্র সরকারও মোহাররমের ‘প্লাবনী করুণরসে,র’ কথা বলেছেন। বাংলা ভাষায় কারবালা কেন্দ্রিক এক বিশাল সাহিত্য ভা-ার গড়ে উঠেছে। লৌকিক সাহিত্যেও কারবালার ঘটনা বিশেষ প্রেরণার আশ্রয় হয়েছে। মার্সিয়া সাহিত্য ও জারিগান এ ধারার লৌকিক প্রচেষ্টা।’

ধুয়াগান আমাদের সমাজের অল্প বা অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত লোকদের সৃষ্টি গান। এই শিল্পিরা আসরে কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই রচনা করতে পারেন ধুয়াগান। এই গানে সমাজের আচার ব্যবহার, ইতিহাস, ঘটনা , দর্শন ইত্যাদি উঠে আসে এই ধুয়াগানে। ধুয়াগান মূলত দুইভাবে গীত হয়ে থাকে। এক আসরে গীত ধুয়া আর অন্যটা হল আসরবিহীন ধুয়া। ধুয়াগান হল জারি গানের অনুষঙ্গ গান। জারি গানে কোন প্রতিযোগিতা হয় না কিন্তু ধুয়াগানের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের কাছে অনেককিছুর প্রশ্ন করা হয় আবার প্রতিপক্ষ এই ধুয়ার মাধ্যমে তার জবাব দিয়ে থাকেন। এই জারির মাধ্যমে শ্রোতাদের মধ্যে এক ধরনের মাতম এবং শোকাচ্ছন্নতার সৃষ্টি হয়। লোকশিল্পীরা এই জারিকে নানা শিল্পপ্রতিভার গুনে জারিগান অনেকক্ষেত্রে হৃদয়স্পর্শী লোকশিল্পে পরিণত হয়। পাগলা কানাইয়ের জারিগানে এই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মেলে।

“আরে পুত্র লইয়া পুত্র কোলে যায় দরিয়ার কেনারে
এজিদ গোলাম তীর মারে বুকে
আবার মরা পুত্র নিয়ে দিল কদভানু বিবির কোলে
পুত্র দেখিয়া বিবিরা সব টলিয়া পড়ে
আহা দুখিনীর ধন মারলি কে?
দুখিনীর ধন মারলি এজিদ তীর মা’রে বুকে”।

প্রাবন্ধিক বঙ্গ রাখাল তার ‘জারিগানের আঙ্গিক ও পরিবেশনা রীতি’ প্রবন্ধে জারি গানের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন- ‘লোকমানসের এক ঐতিহ্যবাহী মাধ্যম জারিগান। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন লোকসংগীতের চল লক্ষ্য করা যায়।  এ সমস্ত লোক সংগীতের মধ্যে জারি এমন একটি মাধ্যম যা নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এক বাক্যে স্বীকার করবে জারিগানের আবেদনের কথা। এ এমন এক সম্মোহনী শক্তি যা মানুষের অন্তরে করুন রসের সৃষ্টি করে। জারিগান এক সময় খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কিন্তু বর্তমানে এর প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্নতর কেননা আধুনিক নগরায়ণের কালোথাবায় জারি গানের প্রয়োজনীয়তা কমলেও কিন্তু মানুষের অন্তর থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলিন হয়ে যায়নি। ১০ই মহররম মুসলিম ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। কেননা ঐ দিনটিতে ইসলাম ধর্মের শিরমণি হযরত মুহাম্মদ (স:) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা) এর সপরিবার এজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। এই করুণ কাহিনি নিয়েই মূলত জারি গানের বিষয়বস্তু রচিত হয়। অনেকে মনে করেন জারিগান শুধুমাত্র মুসলমানরাই পরিবেশন করে থাকেন কিন্তু মাঠ সমীক্ষায় দেখা যায়- উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম অঞ্চলে মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও জারি গান পরিবেশন করে থাকেন। ইমাম-হোসেনের মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে জারিগান রচিত ছাড়াও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, প্রাকৃতিক নানা বিষয় নিয়েও জারিগান রচিত হয়।

জারি অর্থ: জারি পয়ার ছন্দের একটি কাহিনি নির্ভর গান। কোলকাতা সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত ও শ্রী জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস সম্পাদিত ‘বাঙালা ভাষার অভিধান’ গ্রন্থে জারি গান সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘জারি হচ্ছে পূর্ববঙ্গের প্রসিদ্ধ গ্রাম্য গানের সুর।’ কারবালায় নিহত (শহীদ)দের অবলম্বন করিয়া রচিত করুন রসাত্মক গীত মহরমের সময় বহু স্থানে গীত গান।১ ঐ অভিধানেই জারি সম্পর্কে পাঁচটি সমার্থক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- প্রচলিত, জাহির, সূত্রপাত, প্রচার ও কার্যে পরিণত। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি’ থেকে প্রকাশিত “বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান” ‘জারি’ সম্পর্কে বলা হয়েছে- বিলাপ গান বিশেষ। আবার ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি’র ব্যবহারিক অভিধানে বলা হয়েছে- ১. দুঃখ, কান্না, শোক ২. কারবালার শোকাবহ ঘটনামূলক গাঁথা ৩. শোকগীতি ৪. মুসলমানদের ধর্মীয় কাহিনি নির্ভর গান বিশেষ বা শোকগাঁথা মূলক গান। সুকুমার সেন লিখিত ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ ২য় খ- গ্রন্থে জারি সম্পর্কে বলা হয়েছে পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে ‘জারি’ গান প্রচলিত আছে। শব্দটি ফারসী, অর্থবিলাপ করুণাত্মক গান ও কবিতায় ‘জারি’ নাম মুসলমান লেখকেরা দিতেন। করুণানিধান বিলাসে বৈষ্ণবপদাবলীর বিরহ গীতিও এই নামে উল্লিখিত হইয়াছে, বৈষ্ণব পদাবলীতে এমন গান ‘শোচক’ নামে পরিচিত ছিল। নয়া দিল্লিতে সাহিত্য অকাদেমী প্রকাশিত শ্রী হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গীয় শব্দ কোষ’ প্রথম খ--ওও অ-ন যার ভূমিকা লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের মহারাজা কবিগুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে। এ গ্রন্থে ‘জারি’ সম্পর্কে বলা হয়েছে- শোক, মহরম পর্বের শোকের যাত্রা। ফার্সি বাংলা- ইংরেজি অভিধানে ‘জারি’ অর্থ বলা হয়েছে ক্রন্দন, বিলাপ, মিনতি বা প্রার্থনা। সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের লোকসংগীত পরিচিতি’ গ্রন্থে ‘জারি’ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘জারি’ মাতমের গান। উর্দূতে যা ‘মর্সিয়া’, বাংলায় তা ‘জারি’।

জারিগানের উদ্ভব ও বিকাশ: হিজরী ৩৫২ অব্দে বাদশাহ্ খইজ উদ্দিনের রাজত্বকালে প্রথম ইমাম হোসেনের বিয়োগান্ত কাহিনি নিয়ে বাগদাদে মহরমের দশম দিবস নিয়ে শোক, তাপ, বিরহ গাথায় আনুষ্ঠানিক উদযাপন ঘটে।২ এদেশে জারি গানের উদ্ভব বা বিকাশ নিয়ে বিভিন্ন গবেষকের বিভিন্ন মত রয়েছে কিন্তু ‘জারি’ যে মুসলমানদের একান্ত সম্পদ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। গবেষক ড. এনামুল হক বলেন, বাংলা সাহিত্যে শোকাত্মক কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া গান বা কাব্য রচনা করার রীতি ষোড়শ (ইং) পর্যন্ত প্রবর্তিত হয় নাই।৩  কিন্তু সৈয়দ জামিল আহমেদ প্রণিত “হাজার বছর: বাংলাদেশের নাটক ও নাট্য কলা” গ্রন্থে দাবি তুলেছেন ‘জারি’ গান পরিবেশনার উদ্ভবসূত্র আবিস্কার করা যায় আনুমানিক পঞ্চদশ শতকের বৈঠকী রীতির ‘জঙ্গনামা’ পরিবেশনায়। ‘জঙ্গনামা’ বৈঠকী রীতির পরিবেশনা থেকে বিবর্তনের পথ ধরে অবশেষে ‘জারি গান’  (শোক সঙ্গীত) নামে বাংলাদেশের স্থানীয় জনসমাজে প্রভূত খ্যাতি লাভ করে। ৪ আবার মুহাম্মদ আবদুল সাত্তার তাঁর ‘বৃহত্তম ময়মনসিংহের লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন- ষোড়শ শতাব্দির প্রথম দিকেই জারি গানের প্রচলন হয়েছে। তবে গবেষণায় জানা যায় ষোড়শ শতাব্দিতে শেখ ফয়জুল্লাহ রচিত ‘জয়নবের চৌতিশা’ নামে যে একটি বাংলা কাব্য রচনা করেন এটাই জারিগানের প্রাচীনতম নিদর্শন। ‘জয়নবের চৌতিশা’ ছাড়াও অজ্ঞাত কবিগণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পুঁথি রচনা করেছেন। যেগুলো বিভিন্ন আসরে নাচ এবং সুরসহ গাওয়া হতো। যেমন-সখিনার চৌতিশা, সখিনার বিলাপ ইত্যাদি। এরই পথ ধরে কবি মুহম্মদ খান রচনা করেন- ‘মোক্তার হোসেন’ কবি হামিদ রচনা করেন- ‘সংগ্রাম হমন’ ও হায়াত মাহমুদ রচিত ‘জঙ্গনামা’ পাঁচালি আঙ্গিকে রচিত হয়েও জারিগান হিসেবে বিভিন্ন আসরে পরিবেশিত হতো।

জারিগান সম্পর্কে নানা মতামত: নওরোজ কিতাবিস্তান ও গ্রিন বুক হাউজ লিমিটেড, ঢাকার যৌথ প্রয়োজনায় প্রকাশিত ‘বাংলা বিশ্বকোষে’ জারি গান বিষয়ে লেখা হয়েছে- মুসলমানগণ মহরম মাসের ১০ তারিখে দেশব্যাপি শোকসভা পালন করিয়া থাকেন। সাধারণত এই মহরম মাসে কারবালায় করুন কাহিনিকে অবলম্বন করিয়া যে সব গান করা হয় তাহা ‘জারি গান’ নামে পরিচিত। ‘জারি’ শব্দটি যার অর্থ শোক শব্দ হইতে আসিয়াছে। ‘বাংলাদেশের লৌখিক ঐতিহ্য’ গ্রন্থে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আবদুর হাফিজ ‘জারিগান’ সম্পর্কে বলেছেন- “মুসলিমদের জারিগান সমগ্র বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ব্যাপ্তি প্রচলিত। ময়মনসিংহ জেলা বোর্ড প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে আবদুর রাজ্জাক উল্লেখ করেন- জারিগানের বিষয় বস্তুতে রয়েছে কারবালার নির্মম কাহিনি। বীরত্ব সেখানে ষড়যন্ত্রের শিকার অমানবিকতার হিং¯্র থাবায় সেখানে শিশু, নর-নারীর জীবন বিপন্ন। সেই আর্তির সঙ্গে ঐক্যবোধ, সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঘৃণার জাগরণ’। সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী ‘বাংলাদেশের লোকসংগীত পরিচিত’ গ্রন্থে ‘জারি গান’ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন- ইহার (জারিগান) মানবীয় আবেদন একান্ত ভাবেই করুন রসাত্মক। ‘জারি’ শুধূ দুঃখের গান আর বেদনার সুর নহে, ইহা বীরের গান, বীরত্বের ঝংকার, সবল, সমুন্নত- ইহার পাখা। ইহাতে আছে সত্য, ন্যায়, ধর্ম, প্রভৃতি উচ্চতর মানবীয় গুণের সংরক্ষণ ও স্থায়িত্ব আনয়নের জন্য স্বভাব দত্ত বীররসের সংযত প্লাবন, আত্মবিসর্জনের উদাত্ত আহ্বান।


জারি গানের অঞ্চল: লোক সংগীত সাধনায় বিশেষ করে বলা যায় ধুয়া জারির জন্য যশোর, ঝিনাইদহ জেলা বিশেষ গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারি। সতীশচন্দ্র মিত্র (১৮৭১-১৯৩১) প্রণিত “যশোর-খুলনার ইতিহাস” গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই- প্রায় ১৫০ বৎসর ধরিয়া যশোর জেলায় জারি চলিতেছে। এই গানের উৎপত্তিস্থান বলিয়া যশোহর যশস্বী। যদিও সনাতন ও রামচাঁদ প্রভৃতি দুই চারিজন হিন্দু বয়াতির নাম শুনতে পারি। তবুও বলিতে পারি সাধারণ মুসলমানগণই এই গীতের পালক, গায়ক, রচক ও প্রচারক। জারি গীতের প্রধান প্রবর্তক দিগের মধ্যে পাগলা কানাই প্রথম ও ইঁদু বিশ্বাস দ্বিতীয় স্থানের অধিকারি। যশোহরের উত্তরাংশ অর্থ্যাৎ ঝিনাইদহ ও মাগুরা মহকুমা জারিগানের পীঠ স্থান।৬ ষোড়শ শতকে জারিগান শুরু হলেও কিন্তু বিকাশ লাভ করে ঊনবিংশ শতকের মধ্য পদ থেকে বিংশ শতকের ষাটের দশকে। যশোর-ঝিনাইদহ-মাগুরা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জারি গানের প্রচলন ছিল। বর্তমানেও এর ধারা কিছুটা হলেও বিদ্যমান। যেমন- বৃহত্তম ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, চব্বিশ পরগণা, মুর্শিদাবাদ জেলায় অনেক জারির দল ছিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, ধূয়া জারি গানের জন্য একসময় বৃহত্তম যশোর (বর্তমান ঝিনাইদহের) পাগলা কানাই সারা বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গে সুপরিচিত লাভ করেন।’

বিবি ফাতেমার পুত্র শোককে তুলনা করেছেন কৃষ্ণজননী দৈবকীর সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছেন এক সম্প্রীতিরবন্ধনের কথা-

‘ও যেমন দৈবকীনীর কৃষ্ণহারা
ও দুঃখে মায় পাগলপারা
ও চক্ষে না রয় ধারা,
ও গোপাল উদরে রাখলাম
ও চন্দ্রমুখ না দেখিলাম
ও প্রাণ থাকতে থাকতে পাষাণের গায় জ্যান্ত মরা
ও বুঝি সে দশা আমার হলো,
কেন ইমাম ছেড়ে গেল
ইমাম শোক, আগুন র’লো মায়ের বুকে পুরা।।’

এই ধুয়া গান আবার নবীতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, ইমামবিচ্ছেদ, পাটনীর ধুয়া, লীলাকারি ইত্যাদি নানা ভাগে বিভক্ত।

‘সালাম সালাম সালাম রাখি দেশের পায়।
পয়লা সালাম করি আমি খোদার দরগায়
তারপর সালাম করি নবীজীরে
যিনি শোয়া আছেন মদিনায়
ওরে সালাম করি ওস্তাদের আর সালাম পিতা-মাতার
অধম আমি পাগলা কানাই এলাম চাঁদ সভায়
আল্লা তরাও হে আমায়।’
ধুয়ার একটি বিশিষ্ট পর্ব লীলাকারী ধুয়া। রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলাই মূলত এর উপজীব্য।

‘পাগলা কানাই বলে- প্রেম বিচ্ছেদে প্রেমের জ্বালায়
সখি রে আমার প্রাণ তো বাঁচে না।
আসি বলে গেল মথুরায় আর তো ফিরে এলোনা।
আমার প্রাণে প্রবোধ মানেনা।’

আসরের শেষ পর্যায়ে গীত হয় প্রশ্নমূলক ধুয়া। আসীম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী কানাইয়ের সেসব ধুয়ার জটিল ধাঁধার ভেদ ভেঙ্গে প্রতিপক্ষকে গলদঘর্ম হতে হতো। এইভাবে পাগলা কানাই নিজেকে ধুয়া-জারির অপ্রতিদ্বন্দ্বী রূপকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। পাগলা কানাই ধুয়া-জারির প্রবর্তক এবং এই  গীতধারাকে তিনি যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যান সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

পাগলা কানাইয়ের শিল্প শক্তি ও তত্ত্বজ্ঞানের প্রতিফলন দেখা যায় তার দেহতত্ত্বের অনেক গানে। তিনি যে দীক্ষিত বাউল কিংবা সমধর্মী কোন মরমী লোক-সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তার হদিস ও মেলেনা। তার দেহতত্ত্বের পদের ভূমিকায় গুরুর উল্লেখ নেই। তবে তার এই পর্যায়ের গান গুলো বিশ্লেষণ করলে অনুভব করা যায়, কোন মরমী প্রেরণা ব্যতীত এমন উচ্চাঙ্গের তত্ত্বকথার উপলদ্ধি ও প্রকাশ সম্ভব নয়।

পাগলা কানাইয়ের গুরুতত্ত্বের পদের সংখ্যাও কম নয়। অনেক গানেই আছে গুরু মাহাত্ম্য, মুর্শিদ বন্দনা। যেমন-

‘ভবপারে যাবি রে অবুঝ মন, আমার মন রে রসনা,
দিন থাকিতে সাধন ভজন করলে না।’

আবার

‘মুক্তি কিসে হবে গো জীবের ভক্তি বিহনে
ভক্তি হইছে অমূল্য ধন গুরুর কাছে লও গা জেনে।
গুরু হয় জ্ঞানের দাতা, সে জানে মর্মব্যথা
গুরু বিনে আর কে জানে ?’...

‘কত ফকির বৈষ্ণব আছে রে ভাই সেই ঘরের ভিতর
পাগল কানাই বসে বাংলা ঘরে সদায় করে ভয় আমার।
সে ঘরের সারথীর নাম মন পবন তাই শুনিলাম।
ঘরের মধ্যে ষোলজনা করতেছে কারবার।’...

আমার এই দেহ নদী।
মজার ঘর বেঁধেছে।

পাগলা কানাই দেহতত্ত্বের গান করে জীবনের গুহ্য সত্যকে অনুসন্ধান করে গেছেন যার প্রমাণ তাঁর গান। তত্ত্বকথা কিংবা আধ্যাত্মিক বা জীবন রহস্যের জন্যই তাঁর গান করা। জীবনের ভেদ জানায় একজন সাধক পুরুষের সারাজীবনের সাধনা। এই সাধন ভজন তো মানুষকে ঘিরেই। মানুষকে জানলে সব জানা যাবে-যেকথা পাগলা কানাইয়ের সসসাময়িক আরেক সাধক লালন শাহ বলেছেন-মানুষ ভজলেই সোনার মানুষ হওয়া যায়। মানুষের মাঝেই লুকিয়ে থাকে ঈশ্বর-ভগবান।

তথ্যসূত্র :
১. বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি- মুহাম্মদ আবদুস সাত্তার, বইপত্র প্রকাশনি, ১ম প্রকাশ-আগষ্ট ২০০৪, ভাদ্র ১৪১১, ঢাকা।
২. পূর্বোক্ত।
৩. ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’, ড. এনামুল হক, পৃষ্ঠা ১১৪-১৫।
৪. ‘বাংলাদেশের লোকনাটক বিষয় ও আঙ্গিক বৈচিত্র,’ সাইমন জাকারিয়া-, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ-বৈশাখ ১৪১৫-এপ্রিল ২০০৮।
৫. মুহাম্মদ আব্দুল সাত্তার-পূর্বোক্ত।
৬. ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’, সতীশচন্দ্র মিত্র, ২য় খ-। দ্বি-স কলিকাতা জুন ১৯৬৫ পৃষ্ঠা ৮৮০।

Post a Comment

0 Comments