শিক্ষক
সব শিক্ষকই মন্দিরে বাস করে
সব শিক্ষকই ছাত্রকে আঙ্গুলে ধরে পার
করায় রাস্তা,
আর প্রাতঃকালের ঘন্টা বাজায়
অ-আ শেখায়
ক-খ শেখায়
মুখস্থ করায় নামতা
শ্রুতলিপি দেয়, শুদ্ধ করায় বানান
যাতে আমরা ভুল না করি শুদ্ধ করে লিখতে নিজের নাম,
আর শুদ্ধ করে আমাদের সই করা
হাজিরা বই নতুবা চুক্তিপত্রে
তিনিই শেখান আমাদের
একের সঙ্গে এক যোগ দিলে দুই
দুই থেকে দুই বিয়োগ করলে শূন্য।
তিনিই শেখান আমাদের– শূন্যের কী অসীম মূল্য,
শূন্যের কী নিদারুণ হাহাকার।
তিনিই শেখান আমাদের
সারাজীবন যোগ- বিয়োগ করতে
শূন্যের হাত থেকে বাঁচতে!
সেই শিক্ষকই শেখান আমাদের
ভূগোলের ক্লাসে ম্যাপ আঁকতে,
আঁকাবাঁকা ম্যাপ থেকে দেশটাকে বাঁচাতে।
ইতিহাসের ক্লাসে তিনিই শেখান–
পুরোনোর সঙ্গে যোগ দিতে বর্তমান
বর্তমানের সঙ্গে যোগ দিতে ভবিষ্যৎ।
তিনিই রচনায় রচনা করতে শেখান– জীবনের লক্ষ্য,
পরীক্ষার খাতায় নম্বর পাওয়া নয়
স্থির করতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন…
তাই শিক্ষক দেখলে সমস্ত ছাত্রই
সাইকেল থেকে নামে,
যেভাবে মন্দির দেখলে সমস্ত মানুষের
মাথা নত হয়ে আসে।
একদিন একজন শিক্ষক বলেছিলেন–
ওই পাহাড়টি দেখ, পাহাড় আমার সহকর্মী শিক্ষক।
একদিন সেই শিক্ষকটি বলেছিলেন–
ওই বৃষ্টির ঝাঁক দেখ, বৃষ্টি আমার সহকর্মী শিক্ষয়িত্রী।
একদিন সূর্যকে দেখিয়ে শিক্ষক বলেছিলেন–
সূর্য আমার সহকর্মী শিক্ষক,
চাঁদ আমার সহকর্মী শিক্ষয়িত্রী।
আর আকাশকে দেখিয়ে বলেছিলেন–
এই আকাশ তোমাদের ব্ল্যাকবোর্ড…
সেদিন বুঝেছিলাম
কোনো শিক্ষকই বাস করে না মন্দিরে,
সব শিক্ষকই মানুষ ।
কেবল তাঁর দৃষ্টি অনন্য,
যে দৃষ্টি মানুষকে আঙ্গুলে ধরে
পার হতে শেখায় জীবনের কন্টকাকীর্ণ পথ…
যে আমাদের শেখায় জীবনের এই ধরনের কঠিন মন্ত্র,
সেই শিক্ষকের কাছে আমি মাথা নত করছি
সেই শিক্ষকের কাছে আমি মাথা নত করছি!
যাত্রা
অন্ধকার হওয়ায় লঙ্গর ফেলে আমরা নৌকায়
বসেছিলাম। হাতের মুঠোতে ছিল আমাদের জীর্ণ হয়ে যাওয়া
পান্ডুলিপি। ডানা ঝাপটে ধপ ধপ করে উড়ে গিয়েছিল ধূসর পাখিটা।
প্রত্যেকেই বোবা, নিথর এবং অন্ধকার হয়ে পড়েছিলাম
হাতের রেখায় ভবিষ্যৎ দেখব বলে একে অপরের হাত তুলে নিয়েছিলাম।
শীর্ণ হাতগুলি স্পর্শ করেই বুঝতে পেরেছিলাম শকুনেরা নেমে আসবে।
আমাদের সঙ্গের কার ও একজন স্ত্রী এই দুর্যোগের সময়ে
একটি সন্তান প্রসব করেছিল। কেউ একজন
বড় আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল 'এটাই সূর্য'!
কয়েকজন ক্লান্তিতে অসংলগ্ন দৃশ্যের স্বপ্ন দেখে বিড়বিড় করছিল।
সোঁ সোঁ করে বইতে থাকা বাতাসে, কোনোমতে প্রদীপ একটা জ্বালিয়ে
ক্ষীণ আলোতে বাইরে তাকিয়ে দেখেছিলাম
রক্তে মাখামাখি অনেক মানুষের জীবনের পান্ডুলিপি ভেসে গেছে।
শেষ বারের জন্য আমরা প্রদীপের সামনে মেলে ধরেছিলাম আমাদের মুখগুলি
গাল দিয়ে গড়িয়ে আসা চোখের জল কোনোমতে সম্বরণ করে
আমরা পুনরায় হাতে হাতে তুলে নিয়ে ছিলাম বৈঠা।
ভয়ার্ত নৈঃশব্দের মধ্যেও জল ভেদ করে করে
শব্দ করে করে এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের নৌকা
অবশেষে তুফান বৃষ্টি না হওয়া উপত্যকাটির
নীল পতাকা আমাদের চোখে ঝলসে উঠেছিল।
কবি পরিচিতি : সাম্প্রতিক অসমের জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত কবি নীলিম কুমার ১৯৬১ সনে অসমের পাঠশালায় জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় চিকিৎসক। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘অচিনার অসুখ’, ‘স্বপ্নর রেলগাড়ি’, ‘জোনাক ভালপোয়া তিরোতাজনী’, ‘নীলিমকুমারের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি। আজ পর্যন্ত হাজারেরও বেশি কবিতা লিখেছেন। জীবনের ৩৫ বছরেরও অধিককাল কবিতা লেখার সঙ্গে জড়িত থেকে অসমিয়া কাব্য সাহিত্যকে শুধুমাত্র সমৃদ্ধ করাই নয়, নতুনত্বও প্রদান করেছেন। আধুনিক জীবনের জটিলতাকে সহজ-সরল ভাবে প্রকাশ করে তিনি অসমিয়া কবিতায় শব্দচয়নে চমৎকারিত্ব এবং বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় দান করেছেন। সুন্দর ব্যঞ্জনা, কম কথার মধ্য দিয়ে অনেক না বলা কথার আভাস, কাহিনি ধর্মী কথন কৌশল, অর্থের গভীরতা, আবেগময় অথচ নিরলঙ্কার ভাষা, গভীর আত্মজিজ্ঞাসা নীলিম কুমারের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লোক জীবন থেকে কুড়িয়ে নেওয়া উপাদানসমূহের যথোচিত উপস্থাপনা নীলিমের কবিতাকে একটি ভিন্ন মাত্রা দান করেছে। নীলিমের কবিতা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুথির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা-চব্বিশ।
0 Comments