মনে পড়ছে শুধু গাড়ির চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া হেড লাইটের তীক্ষ্ণ আলো তার দিকে এগিয়ে আসা, একটা বিকট শব্দ, শরীরে আঘাত, মগজে যেন একটা বিস্ফোরণ, হঠাৎ অন্ধকার… তারপরে আর কিছু মনে নেই।
যখন অনাদির জ্ঞান ফিরল, ধীরে ধীরে যখন সে জেগে উঠল, চোখ মেলেই দেখল রাস্তার পাশে গর্তটায় সে পড়ে আছে, তার কাছে দুই একজন উৎসুক পথচারীর একটা ছোটোখাটো ভিড়। দুয়েকটি ভবঘুরে কিশোর, যেন তার চেতনা ফিরে আসার জন্য তারা অপেক্ষা করছিল। উঠে বসতে গিয়ে সে বুঝতে পারল তার সমস্ত শরীরে ব্যথা, মাথায় আঘাত, হাতে ঘা, রক্ত জমাট বেঁধেছে।
-মদ খেয়ে পড়ে আছে নাকি? একজন পথচারী অন্যজনকে বলতে বলতে চলে গেল। গরম পড়েছে, মাথার ওপরে প্রখর সূর্য, চোখ খুলতে গিয়ে সে বুঝতে পারল এত আলো সে সহ্য করতে পারছে না, একটা হাত দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে সে বসার চেষ্টা করল।
-গাড়ি ধাক্কা মেরেছে নাকি? একজন বৃদ্ধ পথচারী জিজ্ঞেস করলেন, ভালো বাঁচা বেঁচে গেছ বাবা। রাস্তা ঘাটে পায়ে হেঁটে পথ চলাই কঠিন হয়ে উঠেছে। এই ট্রাক, ডাম্পার, ওভারস্পীডিং গাড়ি…
এক্সিডেন্ট? হতে পারে, সে ভাবল। হেডলাইটের আলো তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার কথা মনে পড়ল, শরীরে রক্তের ধারা, মগজে বিস্ফোরক আঘাত…হতে পারে! রাতের বেলা সে হয়তো রাস্তা দিয়ে আসছিল, ফুটপাতে মেনহোল, শ্ল্যাব ভেঙ্গে গেছে, হয়তো সে রাস্তায় নেমে গিয়েছিল, প্রচণ্ড গতিতে আসা একটা গাড়ি, ট্রাক বা ডাম্পার তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে চলে গেল। রাতটা সে রাস্তার পাশে পড়ে রইল, অচেতন বা অর্ধচেতন অবস্থায়।
দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা, সে কি নেশাযুক্ত? কোথাও সুরাপান করে এসেছিল? অচেতন হয়ে পড়েছিল রাস্তার পাশে, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল? ধীরে ধীরে সে যেন বুঝতে পারল তার স্মৃতি হারিয়ে গেছে, কিছুই মনে পড়ছে না, কোথায় গিয়েছিল, কোথায় এসেছিল, সময়-দিন-বার, স্থান-কাল-পাত্র…
সে উঠে দাঁড়াল, কিছু অস্বস্তি কিছু যন্ত্রণা, ছোটো ভিড়টা এড়াবার জন্য সে হাঁটার চেষ্টা করল। ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে উঠছে শহর, গাড়ি মোটরের আসা যাওয়া শুরু হয়েছে, নিজের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে পথচারী মানুষ, দুই একজন ভেণ্ডর চিৎকার করে করে কিছু একটা বিক্রি করছে। হাঁটতে গিয়ে সে বসে পড়ল। শরীর খুব দুর্বল। ভিড়টা তার সঙ্গ ছাড়ছে না। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, কেউ মজা পাচ্ছে, কেউ তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে।
-কী হয়েছে? কোথা থেকে খাকি পোশাক পরা একজন হাবিলদার এগিয়ে এল, সঙ্গে একজন সিপাহি-কী হয়েছে, কীসের এত হুলুস্থূল? সব সরে যান…
ছোটো ভিড়টার মাঝখান থেকে কেউ অনাদিকে দেখিয়ে হাবিলদারকে কিছু বোঝাল। পুলিশ দেখে দু একজন মানুষ নিঃশব্দে সরে গেল। শহরের ব্যস্ততা ইতিমধ্যে আরম্ভ হয়ে গেছে।
—যান যান ভিড় করবেন না। আপনারা এখন ট্রাফিক জ্যাম করবেন। পুলিশটি কর্কশ কণ্ঠস্বরে নির্দেশ দিল। তারপরে অনাদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছিল আপনার? কেন এখান পড়েছিলেন? অনাদি দিশাহারার মতো এদিক ওদিকে তাকাল। পরিবেশটাও অস্বস্তিকর। সে শুধু বলল, আমি বাড়ি যাব।
–বাড়ি কোথায়? কি নাম আপনার?
–অনাদি চুপ করে থাকে। তার মগজে সমস্ত কিছু উলটপালট হয়ে গেছে। মুখে কোনো উত্তর আসে না। পুনরায় একবার বলে ওঠে, আমি বাড়ি যাব!
—সন্দেহজনক। হাবিলদার অস্পষ্টভাবে নিজেকে বলে। আচ্ছা বাড়িতে যাবেন, এখন থানায় চলুন! তার নির্দেশে রাস্তার পাশে থাকা পুলিশের গাড়িটা এগিয়ে এল। সিপাহিটি অনাদিকে নিয়ে গাড়ির পেছনদিকে বসল।
পুলিশ স্টেশনের ছোটোখাটো একটা ভিড়। একটা পথ দুর্ঘটনাকে নিয়ে বাদী-বিবাদীরা এসেছে। একটা মাটির লড়াইকে নিয়ে দুটি দল ভিড় করেছে। মন্ত্রীর মিটিং আছে, তার জন্য ফোর্স চাই, একজন অফিসার কর্কশ কণ্ঠে কাউকে ধমক দিচ্ছে– এখনও কেন ডিউটিতে বেরিয়ে যায়নি। আর এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে লকআপের দিক থেকে কারও চিৎকার ভেসে আসছে–স্যার,স্যার, স্যার…
কোণের দিকে একটি বেঞ্চে অনাদিকে বসিয়ে রাখা হল। কেউ তাকে গুরুত্ব দেয় না, সবাই ব্যস্ত। সামনে একজন এএসআই মোবাইল ফোনে দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বলছে, মাঝে মাঝে কণ্ঠস্বর নিচু করে গোপন কথা বলছে, তখনই তিনি তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে। তার খুব তেষ্টা পেয়েছে। আর মাথার ব্যথাটা ক্রমে অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
—এর কী হয়েছে? কতক্ষণ চোখ বন্ধ করেছিল সে বলতে পারো না। কারও কর্কশ কণ্ঠস্বরে সে চমকে উঠল।
–কী নাম? কী কেস? দুটো স্টার থাকা খাকি পোশাক পরিহিত একজন মানুষ পার হয়ে যাবার সময় তার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।
–স্যার রাস্তার পাশে পড়েছিল বারান্দার দিক থেকে সেই হাবিলদার বলে উঠল। এক্সিডেন্ট কেস হতে পারে! মদ খেয়ে পড়ে থাকতে পারে স্যার! মাথায় একটু আঘাত লেগেছে, হাতের জিনিসপত্র গুলি কেউ নিয়ে গেছে। আমি মানুষের ভিড় হবে বলে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি।
—কী নাম? কোথায় ঘর? সামনের অফিসারটি অনাদিকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল।
অনাদি দিশাহারার মতো এদিকে ওদিকে তাকায়। কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না।
—এর মেডিকেল হয়েছে কি? অফিসার পুনরায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে।
—হয়নি স্যার। হাবিলদারের উত্তর, আমাকে এখন পুনরায় মিনিস্টার স্যারের ডিউটিতে পাঠিয়েছে। কিন্তু স্যার একে ভিকটিম বলে মনে হচ্ছে!
পুনরায় অনাদির প্রতি আগ্রহ কমে যায়! জীর্ণশীর্ণ একটি ছেলে অফিসারদের টেবিলে টেবিলে চা দিয়ে যায়। চায়ের কাপ থেকে নীরবে বাষ্প উড়তে থাকে, ধীরে ধীরে সবাইকে নিঃশব্দতা ঘিরে ধরে, পুলিশগুলি হাসছে, মানুষগুলি কথা বলছে, সে শুনছে না এমনকি সিপাহিদের ভারী বুট জুতোর শব্দও অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। গাড়ির চোখের ধাঁধিয়ে দেওয়া হেড লাইটের তীক্ষ্ণ আলো তার দিকে এগিয়ে আসছে, একটা বিকট শব্দ, শরীরে আঘাত, মগজে যেন একটা বিস্ফোরণ, হঠাৎ অন্ধকার.. তারপরে তার কিছুই মনে নেই।
—কী নাম বাপ!
তন্দ্রা থেকে অনাদি মাথা তুলে তাকায়। একজন বয়স্ক খাকি পোশাক পরিহিত লোক সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
– কী নাম? পুলিশটা পুনরায় জিজ্ঞেস করে, ভুলে গেছ, কোনো আইডি আছে নাকি? কোনো কমপ্লেইন আছে? বয়স্ক মানুষটার কথাবার্তায় স্নেহের সুর। কোথায় এক্সিডেন্ট হয়েছে? বেশি ব্যথা পেয়েছ কি?
অনাদি কিছুই বলতে পারে না। সে কেবল তার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি বাড়ি যাব!
—যাও বাপু! তোমার পরিচয় নেই, কমপ্লেন নেই, কেস নেই। পুলিশটা বলে ওঠে, এখানে মার্ডার, রেপ, চুরি , ডাকাতির মামলায় সবাই ব্যস্ত। এখানে তোমার জন্য কারও সময় নেই। যাও, বাড়ি যাও। পারলে রাস্তায় কোনো হাসপাতালে গিয়ে ফার্ষ্ট এড নিয়ে নিও!
থানা থেকে বেরিয়ে হাটতে গিয়ে অনাদি বুঝতে পারে, সবকিছু অস্পষ্ট ধোঁয়াশা কুয়াশা বলে মনে হচ্ছে। যেন ঘোলা জল তার মগজকে ছেনে ধরেছে। পদক্ষেপগুলি স্থলিত হয়ে পড়েছে। সেই সময় সে থানার সামনে থাকা মন্দিরটার সামনে পৌঁছে যায়। মন্দিরের ভেতরে আরতি চলছে। সামনে দীর্ঘ সারি— ভিখারি এবং ক্ষুধার্তের। দু’জন ধুতি পরিহিত মানুষ প্রসাদ এবং ভোগ বিতরণ করছে। খাদ্যের গন্ধ অনাদিকে টেনে নিয়ে যায়, বিতরণকারীদের সামনে হাত পাতে।
–কী নাম? একজন তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে। অনাদি পুনরায় থমকে দাঁড়ায়। সে মনে করার চেষ্টা করে। তারপরে স্বগতোক্তি করার মতো অলেখ আকুতির সঙ্গে বলে– খুব ক্ষুধা পেয়েছে আমার!
–কী মানুষ হে! নাম বলছে না! ভিখারিও নয়, ভদ্রলোকও নয়! মানুষ দুটি নিজেদের মধ্যে কথা বলে। তারপরে রূঢ় কন্ঠে বলে— এটা ভগবানের প্রসাদ, ক্ষুধা পেয়েছো যদি হোটেলে যাও। এখান থেকে ভাগো তাড়াতাড়ি।
সামনের রেললাইন দিয়ে একটা কামরাবিহীন ইঞ্জিন গুরুগম্ভীরভাবে পার হয়ে গেল। শুধু শরীরের এখানে সেখানে ব্যথায় নয়, সে দেখতে পেল হাতের ঘড়িটা নে্ই, পকেটে থাকা মানিব্যাগটা নে্ই, মোবাইলটা নেই, এমনকি যে সমস্ত কাগজপত্র ছিল, আইডি কার্ড ছিল, সেই সবের কিছুই নেই। খুব দিশাহারা যেন মনে হল তার। ভীষণ ক্লান্তি তাকে চেপে ধরেছে, সহজভাবে পা ফেলতে পারছিলল না, শরীরে রক্ত-ধুলো-ঘাম, রাস্তার পাশের পৌর নিগমের হাইড্রেন্ট একটা থেকে জল পড়ছিল, সে জল দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিল, মুখটা ধুয়ে নিল, চুলটা একটু ভিজিয়ে নিয়ে ঠিকঠাক করে নিল, তারপরে সে নিজেকে বলল– এখন আমি বাড়ি যাই!
কিন্তু তার বাড়ি? তার ঠিকানা? তখনই সে ভালো করে বুঝে উঠল যে তার কথাগুলি ঠিক মনে নেই, স্মৃতি তার সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা করেছে। তার অতীত বা সাম্প্রতিক অতীত যেন ধূসর কুয়াশার মধ্যে ঢেকে গিয়েছে। সে বাড়ির পথ ভুলে গেছে। নিজের শহরটাই যেন একেবারে অপরিচিত। দিকভ্রান্তের মতো সে এদিকে ওদিকে ঘুরে ফিরে তাকাল, প্রচণ্ড ক্ষুধায় পেটের মধ্যে পাক। এক কাপ চা, দুটো বিস্কুটের খুব দরকার ছিল!
–কী হল আজ এত দেরি ফুটপাতের পাশে মোটরসাইকেলে বসে হেলমেটটা পড়তে পড়তে যুবকটি বলল। অনাদি থমকে দাঁড়াল।
—স্যানাল স্যার আপনাকে খুঁজছিলেন। যুবকটি পুনরায় বলল। তারপরে অনাদিকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত নিরীক্ষণ করে যুবকটি সামনের বিল্ডিংটার দিকে দেখিয়ে বলল, থার্ড ফ্লোরে সান্যাল স্যার বসে আছেন। আপনি দেখা করে আসুন। আমার ফিল্ডে একটু কাজ আছে।
যুবকটি পুনরায় একবার তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে মোটরসাইকেলে উঠে চলে যায়। অট্টালিকাটার সামনে অনাদি দাঁড়িয়ে থাকে। তৃতীয় মহলের দিকে তাকায়। স্মৃতি বিস্মৃতি তার মগজে খেলা করতে থাকে। চৌহদটাতে ঢুকতে যেতেই সিকিউরিটির লোকটা তাকে চিনতে পারে, সালাম স্যার!
অনাদি ম্লানভাবে হাসে। তারপরে মূল দরজাটার কাছে যায়, কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে।
—স্যার আইডি কার্ড দিয়ে খুলুন। সিকিউরিটির লোকটি দরজা সংলগ্ন বায়োমেট্রিক স্ক্যানারটা দেখিয়ে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে।
—আমার কার্ড নেই। অনাদি আস্তে করে বলে, আইডি নেই!
—অফিসে ফোন করুন স্যার।
— ফোন নেই। আইডি নেই। সব হারিয়ে গেছে। আমি হারিয়ে গেছি… নিজেকে বলার মতো বলে বলে অসহায়ের মতো অনাদি রাস্তায় বেরিয়ে আসে।
মসজিদটার সামনে একটা ছোটো ভিড়। সাদা টুপি পরিহিত, শুভ্র দাড়ির কয়েকজন মানুষ খাদ্য বিতরণ করছে। বুভুক্ষ মানুষগুলি হাত মেলে দিয়েছে। গালে হাত বুলিয়ে অনাদি দেখল তার মুখে দুদিনের না কামানো দাাড়ি, পোশাক অপরিচ্ছন্ন, ভিড়টার মধ্যে সে মিলে যাবার চেষ্টা করে–হাত মেলে দেয়। খুব ক্ষুধা লেগেছে তার!
কী নাম? তবু মসজিদের মানুষ দুটি তাকে ধরে ফেলে। হতাশ অসহায় ভঙ্গিতে অনাদি দাঁড়িয়ে যায়। সমস্ত এলোমেলো হয়ে যায়!
–নামাজ পড়েছে? টুপি পরিহিত মানুষ দুটি তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করে, দোয়া করেছে?
অনাদির ওপরে তাদেরও সন্দেহ হয়। নিজেদের মধ্যে কথা বলে। তারপরে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে তাকে বলে—যান যান, এখান থেকে চলে যান।
এদিকে ওদিকে ঘুরে ফিরে একটা সময় শহরের সুদৃশ্য মলের ভেতরে সে ঢুকে যায়। আসলে ভেতরের এয়ারকন্ডিশনের শীতলতা তাকে আকর্ষণ করে আনে। মলটার ভেতরে মায়াময় পরিবেশ, চারপাশের রঙ্গিন গ্লাস, সুউচ্চ সিলিং থেকে ঝুলছে বিশাল স্যান্ডেলিয়ার, মলটার ভেতরে মানুষের আসা যাওয়া, শুধু ভেসে আসছে মৃদু কথোপকথন, কলকল হাসির শব্দ। নাতিশীতোষ্ণ বাতাসের মধ্যে মলটার বিশাল হলটিতে অনাদি উদ্দেশ্যহীনভাবে বসে থাকে। ক্লান্তি আছে, এক ধরনের অবসাদ ঘিরে ধরে তার শরীর, সে বুঝতে পারে তার খুব ক্ষুধা পেয়েছে, অনেকক্ষণ ধরে কিছু খায়নি, শ্রান্তিতে তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে… তখনই সে তাকে দেখে, লাস্য ভঙ্গিতে সে তার দিকেই তাকিয়ে থেকে, পাতলা নীল চুড়িদার তার তন্বী শরীরে, খোলা চুল, ঠোঁটে লিপস্টিকের আভাস, একজন সুন্দর চেহারার পুরুষ তার পাশাপাশি হেঁটে চলেছে, খুব সপ্রতিভ, দুজনেই বিভোর হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, মেয়েটির এক হাতের আঙ্গুল পুরুষের হাতের মুঠোতে, যেন এক কর্তৃত্ব সহকারে নিজস্ব করে রাখা হয়েছে মেয়েটিকে। এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল–এত পরিচিত মুখ, কে মেয়েটি?
–তুমি? মেয়েটি থমকে দাঁড়াল কী করছ এখানে?
-এমনিতেই আছি অনাদি হাসার চেষ্টা করে, এখানে ঠান্ডা বাতাস, বাইরে বড্ড গরম।
–কী অবস্থা করেছ নিজের? সে কিছুটা কর্তৃত্বের সুরেই বলে, আবার ড্রিঙ্ক করেছ?
–না সে মাথা নাড়েই কিন্তু আপত্তিও করে না শুধু উচ্চারণ করে ওঠে অনেক কষ্ট…।
সঙ্গী পুরুষটিকে দেখিয়ে বলে– ও হল বিবেক!
স্মার্ট মানুষটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। সে কী করবে ভেবে পায় না, নিষ্পৃহ মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপরে তার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমাকে একটা কথা বলার আছে।
—হুম! সে অপ্রস্তুত হয়। একটু সরে আসে।
–আমার কিছু কথা আছে, প্লিজ! সে পুনরায় বলে।
–আমাদের মধ্যে এখন আর কিছু নেই। মেয়েটি ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, সেই সব কবেই শেষ হয়ে গেছে।
–ভুল! সে বলে ওঠে, তুমি ভুল বুঝেছ। আমি…
—যাও। মেয়েটি প্রত্যাখ্যানের ভঙ্গিতে সরে যেতে চায়, আমাকে ভুলে যাও! আর টেক কেয়ার…
—আমি বলতে চাইছি…হঠাৎ অনাদি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, পরের মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়না, আমি বলতে চাইছিলাম আমার ক্ষুধা পেয়েছে, ভীষন ক্ষুধা পেয়েছে। কাতর ভঙ্গিতে সে তার হাতটা খামচে ধরে, আমাকে কিছু টাকা দাও! মেয়েটি অবাক হয়ে যায়, হাতের ব্যাগটি থেকে দ্রুত কিছু টাকা তার হাতে গুঁজে দেয়।
—চল অলি। তার সঙ্গী পুরুষটা পরিস্থিতিটা থেকে দূরে সরে যেতে চায়। অনাদির দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভ ভাবে বলে, বাই ইয়ংম্যান! হ্যাভ এ গুড ডে!
অনাদির কোনো অপমানবোধ হয় না। মেয়েটি হাতে দেওয়া টাকাগুলি নিয়ে সে মলের বাইরে বেরিয়ে আসে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান একটাতে দাঁড়িয়ে কয়েকটি বিস্কুটের সঙ্গে এক কাপ লাল চা খায়। আঃ যেন কিছুটা আরাম পেল। তারপরে মহানগরের অবিন্যস্ত ট্রাফিকের মধ্য দিয়ে অনাদি যেতে থাকে। চারপাশে বিশৃঙ্খলা, গাড়ি বাইক রিক্সা পথচারীর সম্মিলিত কোলাহল। কোথাও লাউডস্পিকারে কিছু একটা অস্পষ্ট ঘোষণা, দূরের মন্দির থেকে উড়ে আসা প্রার্থনার বিক্ষিপ্ত সু্র, রাস্তার নির্মীয়মান কালভার্টের পাশে একটা কংক্রিট মিক্সচার মেশিন ঘর্ঘর শব্দে চলছে…মাথার ব্যথাটা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। লাল চা টা খেয়ে কিছুটা ভালো লেগেছিল, এখন পুনরায় মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে কিছু একটা ভেদ করে যাওয়া বলে মনে হচ্ছে।
দিকভ্রান্ত মানুষের মতো অনাদি যেতে থাকে, পার হয়ে যায় একটি স্কুল, একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, একটা সরকারি কার্যালয়ের সামনে একদল মানুষের বিক্ষোভ, প্লেকার্ড, ব্যানার, স্লোগান…। একটা সময় অনাদির পদক্ষেপ শ্লথ হয়ে আসে, সে কিছু একটা গন্ধ পায়–ফিনাইল, জীবানুনাশক, মেডিসিনের মিশ্রিত গন্ধ, যেন তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় কাজ করতে শুরু করে, হাসপাতালের বিশাল গেটটার কাছে অনাদি দাঁড়ায়–ইস মাথাটা যেন ফেটে যাবে।
—কিছু ছিল নাকি? একজন মানুষ এগিয়ে আসে। হনূ বেরিয়ে থাকা গালে হাত পাকা দাড়ি, চোখ দুটো ধূর্ত, মুখে কড়া তামাকের গন্ধ। কিছু লাগবে?
অনাদি নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকায়। অন্য দুটি মানুষ এগিয়ে আসে। এইবার প্রথমে দেখতে পাওয়া মানুষটি অনাদির হাত খামচে ধরে, ব্লাড দেবে? কী গ্রুপ? আমি ভালো রেট দেব। মানুষটা তার হাত ধরে একপাশে টেনে নিয়ে যায়। বাকি দুজনের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। অনাদির শার্টের ভেতর একটা পাঁচশত টাকার নোট গুঁজে দেয়। জানিনা আমার কিছুই নেই।
অনাদির করার কিছুই ছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে মানুষটার সঙ্গে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে যায়।
—আমার ক্লায়েন্ট, ডিস্টার্ব করবি না! মানুষটা অন্য দুজনকে চিৎকার করে বলে। তারপরে পুনরায় অনাদিকে জিজ্ঞেস করে, দাদা ব্লাড গ্রুপ কি?
অনাদি অসহায় ভাবে মাথা নাড়ে, জানিনা!
—ড্রাইভিং লাইসেন্স এমপ্লয়ই কার্ডে ব্লাড গ্রুপ কী লেখা আছে?
–জানি না। আমার কিছুই নেই!
মানুষটা এক মুহূর্তের জন্য উনাদের দিকে তাকায়। তারপরে আলগোছে তার কাঁধে হাত রেখে হাসপাতালের একটা ঘরের দিকে নিয়ে যায়, ঠিক আছে , আমি টেস্ট করে বের করে নেব।’
ব্লাড ব্যাংক থেকে হাসপাতাল কর্মী, রোগীর অভিভাবক, নার্সের ব্যস্ত আসা যাওয়া। মানুষটা স্বচ্ছন্দ, একে অপরকে হাত নেড়ে নির্ভরতা জানাচ্ছে, তাকে যেন হাসপাতালের প্রত্যেকই চেনে।
—বর্মন দা, নিউ বিল্ডিং এ নেগেটিভ ব্লাড চাইছে। একজন কর্মচারী মানুষটাকে বলল, ড’নার আছে নাকি?
দেখছি। আমার নাম্বারটা দিয়ে রাখবে। মানুষটা আশ্বস্ত করল, এ নেগেটিভ পাওয়া একটু অসুবিধাজনক, আচ্ছা আমি মেনেজ করে দেব।
ভেতরের ছোটো একটি রুমে বেডে অনাদিকে বসতে দেওয়া হল, দরজা-জানালার পর্দা সবুজ, মেডিসিনের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, ঘর্ঘর শব্দ করে মাথার ওপরে প্রাচীন একটা ফ্যান ঘুরছে।
বিছানায় বসে, দেওয়ালে পিঠ রেখে অনাদি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। অস্বচ্ছ কাচে বাইরের ধোঁয়াশা-কুয়াশায় আচ্ছন্ন আকাশটা দেখা যাচ্ছে, কয়েকটা হোর্ডিং অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, আর তার মধ্য দিয়ে উঁকি মারছে বহু বিশৃঙ্খল বিদ্যুৎ তাঁর, স্যাটেলাইট ডিস্ক আর উদ্ধত মোবাইল টাওয়ার…
দুজন নার্স এসে তার ব্লাড নিয়ে গেল। সঙ্গে বর্মন নামের সেই মানুষটা। হাসপাতালের শীতল বাতাসে অনাদির চোখ বুজে আসছিল। কত সময় পার হয়ে গেল সে বুঝতেই পারল না। হঠাৎ অনাদি দেখে সে প্রত্যেকের মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে পড়েছে। কী হল?
হাসপাতালের দুজন মানুষ তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গে নার্স।
–আপনার নাম? ফুল নেম?
অনাদি উত্তর দেয় না। শূন্য দৃষ্টিতে সে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
–আপনার কোনো অভিভাবক? ফ্যামিল? নিকট আত্মীয়?
সে মাথা নাড়ে। মানুষ দুটি বিরক্ত হয়-ওকে ন ইস্যু। একজন এবার নার্সের দিকে তাকিয়ে বলে, ইনি নিজের পরিচয় দিতে চাইছেন না। আমি একে মিস্টার এক্স হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করাব! ঠিক আছে মিঃএক্স? ফাইন?
—আমি আপনাকে একটা কথা জানাতে চাইছি। হাসপাতালের অফিসারটি বলল, আমরা আপনার কিছু টেস্ট করব। ব্লাড নেব। এর সমস্ত খরচ আমাদের হাসপাতাল বহন করবে। আপনি শুধু আমাদের একটু সাহায্য করুন। তার জন্য… এইবার মানুষটি একটা ফর্ম এগিয়ে দিয়ে অনাদিকে বলে, এখানে আপনি সই করুন। অনাদি চুপ করে অপেক্ষা করে। অফিসার দুজন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, কিছুটা যেন অধৈর্য। তারপরে একজন অনাদির হাতটা ধরে বুড়ো আঙুলটাতে স্টাম্পপেডের কালি লাগিয়ে ফর্মটাতে চেপে ধরে।
—দেটস ইট! নার্স, একে হালকা খাবার দিন। একটু দুর্বল বলে মনে হচ্ছে। ডাক্তারের কাছ থেকে ডায়েট নিয়ে নেবেন! ডাক্তার বেজবরুয়া আর প্যাথলজির টিমটা আসছে।
তারপর অনাদির দিকে ঘুরে তারা খুব শান্তভাবে বলে, কংগ্রাচুলেশন মিঃএক্স! আপনার জন্য একটা ভালো খবর আছে। আপনার শরীরে গোল্ডেন ব্লাড মানে সোনালি রক্ত পাওয়া গেছে। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে একজন-দুজনের এই ব্লাড গ্রুপ থাকে। আপনি ভাগ্যবান। আপনাকে কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে। আমাদের হাসপাতালে, ইউ ডোন্ট নীড টু পে এনিথিং…
কিছুক্ষণ পরে সৌ্ম্যদর্শন দুজন ডাক্তার অনাদির বেডের কাছে আসে। সঙ্গে তিনজন জুনিয়র ডাক্তার। খুব ভদ্র বিনীতভাবে তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনার কোনো মেডিকেল হিস্ট্রি আছে নাকি? অনাদি উত্তর দিতে পারে না। ডাক্তার দুজনের পরিপাটি পোশাক, গলায় ঝুলে থাকা স্টেথস্কোপ্টা তার ভালো লাগে। তারপরে দেওয়ালের দিকে নীরবে আনমনা ভাবে তাকিয়ে থাকে।
একজন ডাক্তার অনাদির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। অসহায়ের মতো অনাদি অপেক্ষা করে। থ্যাঙ্ক ইউ মিঃএক্স! সিনিয়র ডাক্তারটি হেসে বলল, ডোন্ট ওরি ইউ উইল বী ফাইন। অলস ইউ উইল বী মেকিং হেডলাইনস সুন! আধপাকা চুলে মুখে অভিজ্ঞতার ছাপ থাকা ডাক্তারটি জুনিয়র ডাক্তারদের বোঝাল–গোল্ডেন ব্লাড! মানে আর এইচ লাল রক্ত! এটা একটা রেয়ার সিম্পল! যে ব্লাডে একটাও আর এ এন্টিজেন থাকে না। এবসলিউট নীল!
–স্যার এটাইতো ইউনিভার্সেল গ্রুপ তাই না একজন তরুণী চিকিৎসক আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
—এক্সাক্টলি। অভিজ্ঞ ডাক্তার ঠিক বলে যেতে লাগলেন, গোল্ডেন ব্লাড। সোনালি রক্ত। এই ব্লাডের জীবনের শক্তি অনেক। মেডিকেল সাইন্সে এই বিরল গোল্ডেন ব্লাডকে সবচেয়ে দামি রক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৬১ সনে অস্ট্রেলিয়ার একজন আদিবাসী মহিলার দেহে প্রথম এই রক্ত পাওয়া যায়। পৃথিবীতে মাত্র ৪৩ জনের শরীরে এই গোল্ডেন ব্লাড পাওয়া গেছে।
তারপরে ডাক্তারের দলটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। হাসপাতালের অফিসাররা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
—গোল্ডেন ব্লাড থাকা মানুষকে কিন্তু দরকার হলেও অন্য গ্রুপের ব্লাড দিতে পারে না। তাই কেয়ারফুল। আর পৃথিবীতে এই মুহূর্তে মাত্র সাতজন গোল্ডেন ব্লাড ডোনার আছে।
—বিফোর সামওয়ান ইন্টারফেয়ার্স… হাসপাতালের একজন অফিসার নিম্ন স্বরে বলল আমরা ব্লাড নিতে আরম্ভ করি। একে আমরা সাত তলার আইসোলেশন রুমে নিয়ে যাই।
—ডাইরেক্টর স্যার বাকিটা এরেঞ্জ করছে। অন্যজন বলল, আমাদের হাসপাতালে একটি ইন্টারন্যাশনালি ইম্পোর্টেন্ট ঘটনা হয়ে গেল। আন বিলিভেবল।
—মাইনাস ৮০ ডিগ্রীতে নাইট্রোজেন ভর্তি কনটেইনারে এই ব্লাড রাখতে হবে। যখন দরকার হয়, তখন সেই কন্টেইনার থেকে ফ্রোজেন ব্লাড লিকুইডাতেশন করে কালেক্ট করা যাবে…!
তারপরে কিছু সময় চারদিকে ব্যস্ততা। লিফট খোলা এবং বন্ধের শব্দ। বেডে পড়ে থাকা অবস্থায় ঊর্ধ্বমুখী দৃষ্টিতে অনাদির সামনে বিভিন্ন ছবি পার হয়ে যায়—এসির ভেন্টিলেটর, মাখন রংয়ের সিলিং, ঘূর্ণায়মান ফ্যান, দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা মানুষের বিভিন্ন অঙ্গের ছবি। গাড়ির হেডলাইটের তীক্ষ্ণ আলো তার দিকে এগিয়ে আসে, বিকট শব্দ, শরীরে আঘাত, মগজে যেন একটা বিস্ফোরণ, হঠাৎ অন্ধকার…
চেতন এবং অর্ধচেতন অবস্থায় সে শুধু বুঝতে পারে, একটা সুদৃশ্য শীতলকক্ষে সে শুয়ে আছে, কাছেই কিছু অস্পষ্ট অবয়বের আসা-যাওয়া, তার শরীরে সিরিঞ্জের খোঁচা…
—কিছুটা ডিমেনসিয়া ডেভলপ করেছে বলে মনে হচ্ছে। কোনো একজন বলছে। এমআরআই রিপোর্ট দেখতে হবে!
—সেই সব আমরা পরে দেখব, এখন যতটা সম্ভব ব্লাড সংগ্রহ করতে বলুন! হঠাৎ একটা হুলুস্থুল। মিডিয়াকে কে খবর দিল? কী কান্ড! হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একজন অফিসার প্রবেশ করল, সঙ্গে একজন সিনিয়র ডাক্তার, আইসোলেশন ওয়ার্ডে আসার জন্য মিডিয়াকে কে আসতে দিল?
—আপনি একটু সাহায্য করতে পারবেন কি? হাসপাতালের অফিসারটি অনাদিকে অনুরোধ করল। অনাদি মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল, শূন্য দৃষ্টিতে যেন জিজ্ঞেস করতে চাইল, কী ?
—মিডিয়ার মানুষ অপেক্ষা করছে। খুব প্রেসার দিচ্ছে। আপনি পাঁচ মিনিটের জন্য মিডিয়ার মুখোমুখি হোন। অফিসারটি অনুনয় বিনয় করে বলল, সিস্টার প্রেসের মানুষদের দূর থেকে জিজ্ঞেস করতে দেবেন, পেশেন্টের বেডের কাছে আসতে দেবেন না।
অনাদির কেবিনের বাইরে কোলাহল। হাসপাতালের সিকিউরিটি কারও সঙ্গে তর্ক করছে। বহুলোকের পদশব্দ, হঠাৎ হঠাৎ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠছে। একজন নার্স ভেতরে এসে উত্তেজিতভাবে বলল– প্রেসের মানুষ ঘিরে ধরেছে। নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টারও এসেছে।
–আপনি জানেন কি আপনার শরীরে গোল্ডেন ব্লাড পাওয়া গেছে। একজন রিপোর্টার চিৎকার করে উঠল, পৃ্থিবীর তেতাল্লিশজন মানুষের মধ্যে আপনি একজন! কীরকম অনুভব করছেন?
—আপনি এই বিরল গ্রুপের ব্লাড বিক্রি করার জন্য কোনো হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করতে আগ্রহী নাকি? না কি কোনো মেডিকেল কোম্পানির সঙ্গে কথা বলবেন?
অনাদির নীরবতায় সাংবাদিকরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। রিপোর্টার,ক্যামেরা পার্সনরা তার দিকে এগিয়ে আসতে চায়। দরজার সামনে থেকে প্রশ্নের পরে প্রশ্ন উড়ে আসে। ফ্ল্যাশবাল্বগুলি জ্বলে উঠে।
অনাদি বিতত হয়ে পড়ে। এত আলো, এত প্রশ্ন তার সহ্য হয় না। সে বেড থেকে উঠে এদিকে ওদিকে তাকায়… হুড়মড় করে রিপোর্টাররা ভেতরে চলে এল, টিভি ক্যামেরা ফ্ল্যাশ জ্বলল বারবার।
–আপনার পরিচয়? কোনো একজন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, আপনার ঠিকানা? অনাদি মূক হয়ে তাকিয়ে থাকে, উত্তরহীন।
-আপনার পরিচয় দিনতো। উদ্যত ক্যামেরার সঙ্গে মাইক একটা তার দিকে এগিয়ে পুনরায় একটা প্রশ্ন ছিটকে এল।
আশ্চর্য! আমি কে? অনাদি বিড়বিড় করে নিজেকে জিজ্ঞেস করে, কী আমার পরিচয়?
— ঠিকানা কী? বাড়ি কোথায়? পুনরায় ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন এল, আপনি কেন নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখছেন?
আমি… কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে ভাবে, কে আমি! পরিচয় নেই, ঠিকানা নেই, আইডি নেই, আধার প্যান কার্ড নে্ই, কী আমার পরিচয়? কে আমি?
সাংবাদিকরা এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে। নামহীন পরিচয়হীন মানুষটাকে নিয়ে কী করবে ঠিক বুঝতে পারে না। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠে বারবার, ভিডিও ক্যামেরাগুলি অ্যাঙ্গেল পরিবর্তন করে।
— আপনার এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ চাই। কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে, আমি তার জন্য আপনাকে ভালো রেমুনারেশন দেব!
হঠাৎ সে সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাত থেকে ক্যাথেড্রাল টেনে খোলে, তার পরনে হাসপাতালের সবুজ গাউন!
রিপোর্টাররা, ক্যামেরা পার্সনরা যেন দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে উঠল। ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন আসতে থাকে। ক্যামেরার সাটারের শব্দ বেড়ে যায়। টিভি ক্যামেরাগুলি নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি আরম্ভ করে। ঠেলাঠেলিতে ছিটকে পড়ে ডাক্তার নার্স হাসপাতালের কর্মী।
— আপনি কে? আপনার ঠিকানা কী? আপনার পরিবার কোথায়? আপনার ধর্ম কী? জাতি কী?
উঠে দাঁড়িয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে অনাদি হাত দুটো মেলে দেয়। তারপরে চট করে ঘুরে বেডের পাশ দিয়ে গিয়ে ঘরের পেছন দিকের দরজাটা খোলার চেষ্টা করে। তার শরীর নেচে ওঠে, পা দুটি চঞ্চল হয়ে ওঠে। হাত দিয়ে সে কোনো একটা মুদ্রা দেখায়।
—যাবেন না, যাবেন না, সেদিকে টেরেসটা রয়েছে। ভিড়ের মাঝখান থেকে হাসপাতালের একজন অফিসার চিৎকার করে উঠে।
বাধা না মেনে প্রায় দৌড়ে যাবার মতো অনাদি ঘরটার পেছন দিকের দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। বাইরে রাতের খোলা বাতাসের গন্ধ। সপ্তম মহলের ঘরের দরজার ঠিক বাইরে অন্ধকারের মধ্যে একটা লোহার স্টেয়ার কেস। অনাদি সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। আঃ উপরে উন্মুক্ত আকাশ। অনাদির পেছন পেছন হুড়মুড় করে উঠে আসে রিপোর্টারের দল, টিভি ক্যামেরাগুলি—আপনি কে? কী আপনার পরিচয়?
অনাদি একটু হেসে উঠে, কত যে প্রশ্ন, অথচ তার কাছে কোনো উত্তর নেই। সে ঘুরে ওদের দিকে তাকায়। রাতের আকাশ তাকে হাতের ইশারায় ডাকে। দূরে শহরের আলোকমালা, মাথা তুলে আছে অট্টালিকাগুলি।
সিঁড়ি শেষ হওয়ার আগে আগে সে দাঁড়ায়। সামান্য ক্লান্ত। নিচে উন্মুখ রিপোর্টার, ক্যামেরা পার্সনের দল। ওরা কিছু একটা ব্রেকিং নিউজ চাইছে, কিছু একটা এক্সক্লুসিভ স্টোরি।
—আমার আধার নেই, প্যান কার্ড নেই, আইডি নেই… অনাদি উচ্চারণ করে যায়, আমার নাম নেই, আমার জাতি নেই, ধর্ম নেই। আমি জানিনা কীভাবে আমার অস্তিত্ব প্রমাণ করব। মানুষ বলে প্রমাণ করতে পারার মতো আমার হাতে কিছুই নেই। আমার শুধু খুব ক্ষুধা পায়, প্রচন্ড তৃষ্ণা পায়।
সিঁড়ি বেয়ে টেরেসটাতে পৌঁছে যায় সে। বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে বিশাল অট্টালিকাটার শেষ তলার ছোটো টেরেস দেওয়ালটার পাশে। এই উচ্চতায় নিচে রাতের শহর গাড়ি মোটরের শব্দ, রেল ইঞ্জিনের শব্দ, হর্ন, কোলাহল ক্ষীণ হয়ে আসছে। পিঁপড়ের মতো মানুষগুলি ঘর মুখো হচ্ছে। দুহাত মেলে সে রাতের ঘ্রাণ নেয়। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কিছু একটা খোঁজে, সন্তুলন রাখতে অসুবিধা হয়, মাঝেমধ্যে ভারসাম্য হারিয়ে যেতে চায়।
অনাদির এই ভঙ্গিতে মানুষগুলি থমকে দাঁড়ায়। রিপোর্টার ক্যামেরাম্যানরা স্তব্ধ হয়ে যায়। হাসপাতালের ডাক্তার অফিসার নার্সরা হতবাক হয়ে যায়।
তারপরে রাতের অপার শূন্যতায় সে নিজের শরীর ছেড়ে দেয়।
**********************************************************************************
লেখক পরিচিতি : ১৯৬২ সনে অসমের নগাঁও জেলায় গল্পকার, লেখক, সাংবাদিক মনোজ গোস্বামীর জন্ম হয়। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র শ্রী গোস্বামী অসমের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র ‘নতুন দৈনিক’, ‘আজির বাতরি’, ‘আমার অসম’, ‘দৈনিক জনসাধারণ’ ইত্যাদি পত্রপত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে ‘আমার অসম’ পত্রিকার মুখ্য সম্পাদক। ‘সমীরণ বরুয়া আহি আছে’, ‘মই রাজেন বরুয়াক সমর্থন করো’, ’এলুমিনিয়ামর আঙ্গুলি’ লেখকের অন্যতম গল্প সংকলন। ‘ভুল সত্য’ গল্প সংকলনের জন্য ২০২২ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
অনুবাদক পরিচিতি : ১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও
জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়। ১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এমএ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত
গল্পের সংখ্যা পাঁচশত কুড়িটিরও বেশি। সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর
নিয়ে নিয়মিত ভাবে অসমিয়া গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে
চলেছেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সংস্থা NEINAD এর পক্ষ থেকে
অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life
Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশটি।
0 Comments