প্রত্যেক শিল্পী তাঁর যুগমানসের ভাস্কর ও ভাষ্যকার। একইসঙ্গে তিনি তাঁর ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমকালিক বিশ্বমানসেরও প্রতিচিত্রক ও স্বপ্নকল্পক। কথাটি সব্যসাচী ভাষাশিল্পী বাঙালির জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে, বলা চলে, শতভাগেরও অধিক সত্য। তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবেই সমধিক খ্যাত। তবে প্রেমের কবি হিসেবেও তাঁর খ্যাতি গগনচুম্বী। নজরুল মূলত কবি পরিচয়ে সুবিদিত হলেও বাংলা সঙ্গীতের জগতেও তিনি, রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি, দৃষ্টিধাঁধানো এক নক্ষত্রস্বরূপ। এছাড়া প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটক এবং ছড়াসাহিত্যেও তাঁর অবদান যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য এবং সমীহযোগ্য। এমনসব বিস্ময়কর শিল্পসাফল্যের কারণে মনন-ঝলসানো সাহিত্য-প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের সমকালেই তিনি যুগস্রষ্টা অভিধায় অভিহিত হয়েছেন। আপাদমস্তক সংবেদনশীল এই শিল্পস্রষ্টার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পরাধীনতার যন্ত্রণায় দগ্ধ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মহাক্রান্তিকালে। সুতরাং উপনিবেশবাদীদের দমন, পীড়ন, শোষণ, প্রেষণ ও লুন্ঠন যজ্ঞগুলি তিনি সচক্ষে অবলোকন করেছেন। একইভাবে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন স্বদেশ ও স্বসমাজে বিরাজমান হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, দূরত্ব এবং হানাহানির চিত্র। এমনকি ধর্মীয় পরিচয়ে একজন মুসলিম হিসেবে তিনি আরো দেখেছেন তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে জেঁকে থাকা দারিদ্র্য অশিক্ষা কুশিক্ষা এবং কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতাজাত নিদারুণ পতনমুখীতা। এর পাশাপাশি তাঁর নজর এড়িয়ে যায়নি বৃহত্তর হিন্দুসমাজের বর্ণবৈষম্য কেন্দ্রীক জাতপাতের কুপ্রথা এবং মুসলমানদের মধ্যেকার আশরাফ আতরাফের ব্যবধান। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষধারী বৃটিশ সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক হিসেবে পরোক্ষভাবে লব্ধ করেছেন যুদ্ধ নামক ধ্বংস-লীলার ছায়া-অভিজ্ঞতা। এসব বিষয়ের সংশ্লেষণে নজরুলের মনোজগতে সৃষ্টি হয়েছিল বিষাদ,ক্ষোভ ও প্রতিবাদের এক জটিল বয়ন। অন্যদিকে প্রেম ছিল তাঁর সত্তালগ্ন এক সহজাত মানবিক ব্রত এবং প্রয়াস। পরস্পর বিপরীতমুখী এই আত্মচেতনাগুলির অভিঘাতে নজরুল তাঁর স্বকালের পটভূমিতে এক অভিনব বার্তার প্রবক্তারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। নজরুলের গল্পসাহিত্যেও প্রবলভাবে প্রতীয়মান তাঁর এই অভিনবত্বের প্রকাশ। গল্পের কাহিনি, আখ্যান, গঠন-কাঠামো, কথন-কৌশল, ভাষাবিন্যাস ও চরিত্র-চিত্রনের পরিক্ষেত্রে নজরুল এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্য প্রদর্শন করেছেন। গল্পে তাঁর স্বকালের ছবি অঙ্কিত হয়েছে চিরায়ত জীবন-সন্বিষ্ট অনুসঙ্গ-প্রসঙ্গসমূহের সমাজতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক, ঐতিহাসিক ও আর্থরাজনৈতিক বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায়। তাঁর সৃষ্ট মানব-মানবীদের আন্তসম্পর্ক এবং তাঁদের জৈবিকতার রসায়ন আবর্তিত হয়েছে সময়ের প্রচল ভাঙ্গার সুপ্ত প্রয়াসে। কিন্তু এজন্য তাঁরা সময়ের সড়ক থেকে সরে দাঁড়াননি। বরং তার আবহ গতির শরণেই নবসৃষ্টির ব্রত চর্চা করেছেন। এইসব চরিত্রের কেউ কেউ দার্শনিক মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আবার কেউ কেউ আবির্ভূত হয়েছেন বিপ্লবী এবং সংস্কারক হিসেবে। কাউকে কাউকে দেখা গেছে জগদ্দল জীবনের অচলায়তন ভাঙ্গার বিদ্রোহীরূপে। তবে তাঁর অধিকাংশ চরিত্রের মধ্যে নিয়ত প্রতিভাত হয়েছে দ্রোহ এবং প্রেমের যুগপৎ সঞ্চরণ। কথাসাহিত্যে নজরুল তাঁর স্বধর্মীয়-সমাজের পার্সপেক্টিভ থেকে বিষয় ও চরিত্র নির্বাচন করেছেন। কাহিনির প্রেক্ষণ ও প্রেক্ষাপট নিয়েছেন তাঁর নিজের প্রত্যক্ষণজাত অভিজ্ঞতা থেকে। এতে ক'রে তাঁর অভিব্যক্তির উপস্থাপনা খানিকটা ব্যক্তিক স্থানিক ও সাময়িক হয়ে উঠেছে। তবে উপলব্ধির শাশ্বতিতা এবং প্রকাশভঙ্গির শিল্পগত ঋজুতার কারণে তা নিরেট স্থাণু ও সাবজেক্টিভ হয়ে পড়েনি। এক্ষেত্রে ভাষা নির্মিতির ব্যাপারেও তিনি তাঁর কাব্যভাষার সর্বভুকতা থেকে কিছুটা ব্যতিক্রমী। নজরুল ইসলামের কথাসাহিত্য-বিষয়ে আরেকটি জিনিস উল্লেখ্য, তা হলো- তিনি যে সমাজের জীবনচরিত ও জীবনাচার অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন সেই সমাজ-সম্পর্কিত কথাসাহিত্যের অনুসরণ বা অনুকরণযোগ্য তেমন কোনো পূ্র্বনজির তাঁর সামনে ছিল না।
সবমিলিয়ে এখানেও নজরুল প্রায় এক নবপথের অভিযাত্রী। নজরুলের মোট গল্পগ্রন্থ তিনটি- ব্যথার দান-১৯২২, রিক্তের বেদন-১৯২৫ ও শিউলি মালা-১৯৩১ এবং সবমিলিয়ে গল্পসংখ্যা ১৮টি। নজরুলের গল্পপাঠে পাঠক মনে সাধারণত এমন ধারণা জন্মায় যে তাঁর কথাসাহিত্যের প্রায় পুরো পরিসরটাই বিষাদ ও বেদনাসঞ্জাত ভাবের আবেশে পরিবৃত; এবং তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে গতিচাঞ্চল্যের চেয়ে আবেগের প্রাবল্যই বেশি। অর্থাৎ বিষয়টি তাঁর কাব্যচরিত্রে পরিলক্ষিত অদম্য ইচ্ছাশক্তি অশ্রান্ত কর্মাভিপ্রায় ও ধ্বংসোদ্গত নবসৃষ্টির অনিঃশেষ এষণা থেকে বেশখানিকটা ব্যতিক্রমি বটে। তাই বলে আবহ সমাজকাঠামো এবং সমাজমানসের পরিবর্তনের যে প্রত্যয় তিনি আজীবন লালন করেছেন তা কিন্তু এখানেও সতত বর্তমান।
তাঁর 'ব্যথার দান' শিরোনামীয় গল্পটার দিকে মনোনিবেশ করলে প্রথমেই নজরে আসে এর আখ্যানিক কাঠামোর ভিন্নতা। গল্পে উপযোজিত ঘটনা পরম্পরার যে প্রচলিত ঐক্য-প্রবাহ থাকে তা এখানে অনুপস্থিত। যেমন এ গল্পে ইউনিটি অব প্লেইস এবং ইউনিটি অব টাইম-এর প্রথাগত বিধানটি রক্ষিত হয়নি। একইভাবে ইউনিটি অব এ্যাকশানও অসংযোজকতার উলম্ফনে আক্রান্ত। গল্পের ক্ষেত্রপট উদ্গাতি প্রেমিক যুগল দারা ও বেদৌরার মধ্যেকার সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়নেও স্থানগত অনৈক্য রয়েছে। শুরুতেই আখ্যানের প্রধান অধিবক্তা (প্রোটাগোনিষ্ট) দারা কথা বলেন গোলেস্তান থেকে। অন্যদিকে তাঁর প্রণয়সঙ্গী বোদৌরার কথা আসে বোস্তান থেকে। কাহিনির অকুবিবরণী থেকে বুঝা যায় সম্পর্কের সূচনাতে তাঁরা এক জায়গাতেই ছিলেন। কিন্তু গল্পের প্লট ও ন্যারেটিভ প্রসারণের প্রয়োজনে সংযোজিত অনুঘটক-চরিত্র সয়ফুল-মুলকের ব্যতিচারের ফলে তাঁদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির অবতারণা হয় এবং তাঁরা বিভাজিত হয়ে ছিটকে পড়েন দু'টি ভিন্ন স্থানে। তবে গল্পের পরিনতি পর্বে আবার তাঁদের সকলকে দেখা যায় সূচনাকালের গোলেস্তানে এবং কাহিনির চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে দারা ও বেদৌরার নির্ঝরের এপার-ওপার অবস্থানের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ গল্পটির সমাপনে প্রদর্শিত হয় মিলনস্নাত বিচ্ছেদ এবং বিচ্ছেদোন্মুখ মিলনের এক অনন্য-সাধারণ নাট্যায়ন-দৃশ্য। এ গল্পে এটিও একটি গাঠনিক ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। প্রসঙ্গত বলা যায় এখানে সয়ফুল মুলকের চরিত্রাচরণে শেক্সপিয়রের ওথেলো নাটকের ভিলেন ইয়াগোর একটি দূরাঙ্গিতিক এবং খণ্ডিত ছায়াবিম্ব পড়েছে ব'লে অনুমিত হয়। কিন্তু এখানে মনে রাখা জরুরি-সয়ফুল মুলক কোনভাবেই ইয়াগোর প্রতিরূপ নয়, তথা বর্ন ভিলেন টু দ্য বোন নয়। বরং সয়ফুল মুলকের ক্রিয়াটি ভুল প্রসূত, ইচ্ছাকৃত এবং পরিকল্পিত নয়। তথাপি বিশেষভাবে বিবেচ্য যে, তাঁর এই ভুলটি গল্পের আখ্যান বিস্তারে সক্রীয় ক্যাটালিষ্ট হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আলোচনার এ পর্যায়ে গল্পটির সেটিং নিয়ে কিছু কথা বলা যায়। যে কোনো ফিকশনাল ন্যারেটিভে সেটিং একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। আর সেটিং বলতে গল্পের কাহিনি বয়নের নিমিত্তে অঙ্কিত চরিত্রগুলোর বসবাস, অবস্থান, বিচরণ এবং তাঁদের জীবন প্রবাহে সম্পৃক্ত বিষয় ও ঘটনাবলী সংঘটিত হওয়ার স্থান, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও সমাজ-সময়ের যুক্ত রূপকে বুঝানো হয়। আলোচ্য গল্পের সেটিং হিসেবে নির্দেশিত এবং নির্দিষ্ট হয়েছে মধ্য এশিয়ার দেশ ইরানের দু'টি অঞ্চল গোলেস্তান ও বুস্তান। গল্পকার নজরুল একজন বাঙালি এবং তদানিন্তন ভারতবর্ষের বঙ্গভূমি তাঁর জন্ম ও জীবনযাপনের স্থান। তাহলে এই অতিদূর দেশের দু'টি অঞ্চলকে তিনি তাঁর কাহিনি বুননের সেটিং বা ক্ষেত্রভূমি বানালেন কেনো? সম্ভবত এখানেও তিনি তাঁর স্বসময়ের মানসচর্চা এবং স্বজীবনে অর্জিত অভিজ্ঞতার মননজাত প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস পেয়েছেন। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ-ভারতীয় বাহিনীর একজন সৈনিক হিসেবে তাঁকে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার পরস্পরের সন্নিবর্তী কয়েকটি অঞ্চলে অবস্থান করতে হয়েছিল। সুতরাং তাঁর গল্পের সেটিঙের ক্ষেত্রে এমনটি অনুমিত হয় যে, এই গল্পের বিষয় ও ঘটনারাজি অনেকটাই লেখকের ব্যক্তিজীবন সম্ভূত এবং ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা প্রসূত। গল্পটির গঠন-কাঠামোর দিকে মনোযোগ দিলে দেখা যায় এর ন্যারেটোরি তথা কথন ধারাতেও ধৃত হয়েছে নতুনত্ব। দারার কথা, বেদৌরার কথা ও সয়ফুল মুলকের কথা-এ রকম পাঁচটি উপশিরোনামের মাধ্যমে গল্পকার তাঁর পুরো বয়ানটি উপস্থাপন করেছেন। কথাগুলোতে খানিকটা চিঠি বা পত্ররূপী অবয়ব থাকলেও প্রতিটি বয়ানই মূলত বক্তার আত্মকথন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে আন্তব্যক্তিক ভাব বিনিময় সংক্রান্ত এই আত্মকথনগুলোর আদান-প্রদানে একধরনের ডায়ালোগিগ ফর্মও সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গল্পটি পত্রনাট্যের গঠন-কাঠামোতে নির্মিত হয়েছে ব'লে ধ'রে নেয়া যায়। গল্পের প্রণয়জুটি দারা ও বেদৌরার মিলন এবং মিলনোত্তর বিচ্ছেদ ও বিরহ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দারা তাঁর মাকে সম্বোধন এবং উদ্ধৃত করেছেন। বেদৌরাকে উদ্দেশ্য ক'রে দারা মায়ের কথা তুলে ধরেছেন এইভাবে-
"আমার হাতের ওপর কচি পাতার মত তোমার কোমল হাত দু'টি থুয়ে মা অশ্রু-জড়িত কণ্ঠে আদেশ করেছেন...'দারা,প্রতিজ্ঞা কর... বেদৌরাকে কখনো ছাড়বি নে।...এর আর কেউ নেই যে বাপ।' সে কি ব্যথিত-ব্যাকুল আদেশ, গভীর স্নেহের সে কি নিশ্চিন্ত নির্ভরতা।"
সুদূর গোলেস্তান, বোস্তান, বেলুচিস্তান আর আফগানিস্তানের স্থানিক প্রেক্ষিতে সাজানো গল্পে লেখক অতি নিপুণ হাতে অঙ্কন করেছেন তাঁর স্বকালের ঐতিহ্যবর্তী চিরায়ত বঙ্গজননী ও বঙ্গসন্তানের প্রতিচ্ছবি। নিশ্চিন্ত নির্ভরতা নিয়ে মা তাঁর পুত্রকে আদেশ করেছেন একজন অবলা-অসহায় কন্যার পাণি গ্রহন করতে। তৎকালীন বাঙালি সমাজে কন্যা সন্তানদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হতো মায়ের অভিব্যক্তিতে যেনো তারই পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। বেদৌরার সঙ্গে পরিণয়ের ব্যাপারে দারা মাকে লক্ষ্য ক'রে আরো বলেছেন-
"এই যে বেদৌরাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলে, এর জন্যে দায়ী কে? আমার সকল কাজেই বাধা। কোথাও পালিয়েও টিকতে পারছি নে! আমি আজ বুঝতে পারছি মা, যে, আমার এই ঘর-ছাড়া উদাস মনটার স্থিতির জন্যেই তোমার চির-বিদায়ের দিনে এই পুষ্প-শিকলটা নিজের হাতে আমায় পরিয়ে গিয়েছ। ঐ মালাই তো হয়েছে আমার জ্বালা! লোহার শিকল ছিন্ন করবার ক্ষমতা আমার আছে, কিন্তু ফুলের শিকল দ'লে যাবার মত নির্মম শক্তি তো নেই আমার।"
দাম্পত্য প্রেমকে, ভালবাসাকে কী অসাধারণভাবে দর্শনস্নাত ক'রে তোলা হয়েছে পুষ্প-শিকলের উপমার মধ্য দিয়ে। বেদৌরার সঙ্গে পরিণয় ঘটানোর জন্য মায়ের প্রতি এ কিন্তু তাঁর সত্যিকারের কোনো অভিযোগ নয়: বরং অভিযোগের অবগুণ্ঠনে এ তাঁর সুগভীর আবেগোদ্গত কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। সময় ও সংস্কৃতির পরিবর্তন সাপেক্ষ আজকের আধুনিক বাঙালি জীবনে কোনো মা কি তাঁর সন্তানের কাছে এমন নিশ্চিন্ত নির্ভরতা প্রত্যাশা করেন, কোনো সন্তানও কি মায়ের কোনো আদেশের প্রতি এমন নির্বিবাদী প্রণতি প্রদর্শন করেন, এমনকি সমকালের কোনো বাঙালি কন্যা কি নিজেকে বেদৌরার মতো এমন অবলা ও অমহায় ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? এই প্রশ্নগুলোর জবাব হবে বিমিশ্র 'না'। তাহলে তো বলাই যায় নজরুল তাঁর গল্পে তাঁর কালের মাতৃ-পিতৃ ভক্তি এবং নির্মোহ প্রেম-চেতনার এক নির্জলা অধিভাষ নির্মাণ করেছেন। দারা যখন আবার বলেন-
"তারপর সেই ছাড়াছাড়ির ক্ষণটা বেদৌরা, তা কি মনে পড়ছে? আমি শিরাজের বুলবুলের সেই গানটি আবৃত্তি করছিলাম।
এমন সময় তোমার মামা এসে তোমায় জোর ক'রে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল; ...জানিয়ে দিল যে, সে থাকতে আমার মত একটা ঘর-বাড়ি-ছাড়া বয়াটে ছোকরার সঙ্গে বেদৌরার মিলন হতেই পারে না।"
তখন পাঠকের মনে হতেই পারে যে,এই গল্পটি লেখার সময় চেতনে অবচেতনে অথবা অচেতনে লেখক-নজরুলের স্মৃতিতে তাঁর প্রথম প্রণয়ের নার্গিস খানম ও তাঁর মামা আলী আকবর খানের বিষয়টি খুব তীব্রভাবে জাগ্রত হয়েছিল। প্রেমে পাওয়া না পাওয়া কেন্দ্রিক অভিসার ও বিরহ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দারা আরো একবার দার্শনিক চৈতন্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন নিম্নের কথাগুলোর মধ্য দিয়ে -
"এই যে জীবনের অনেকগুলো দিন তোমার বিরহে কেটে গেল,তাতে তোমাকে না হারিয়ে আরও বড় ক'রে পেয়েছি।"
"অনিলের নীল রংটাকে সুনীল আকাশ ভেবে ধরতে গেলে সে দূরে স'রে গিয়ে বলে-ওগো,আমি আকাশ নই, আমি বাতাস, আমি শূন্য, আমায় ধরা যায় না।" এখানে গল্পকার ভাব ও আবেগের প্রতীকি ব্যঞ্জনার মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রকৃত প্রেম দূরেই সুন্দর, তাকে ধরা যায় না এবং সে ধরা দেয়ও না।
বেদৌরার কথাতেও সেকালের ঐতিহ্য-লালিত চিরায়ত নারী-মানসের প্রতিভাস পাওয়া যায়। একইসঙ্গে তাঁর কথায় দার্শনিকতার আভাসও স্পষ্ট। তিনি বলেছেন-
"আমরা নারী, একটুতেই যত কেঁদে ভাসিয়ে দিত পারি, পুরুষরা তা তো পারে না। তাদের বুকে যেন সব সময়েই কিসের পাথর চাপা। তাই যখন অনেক বেদনায় এই সংযমী পুরুষদের দু'টি ফোঁটা অসম্বরণীয় অশ্রু গাড়ি পড়ে, তখন তা দেখে না কেঁদে থাকতে পারে, এমন নারী তো আমি দেখি না"
এমনকি দারার মতো বেদৌরাও প্রেমকে মহান পবিত্র এবং অবিনশ্বর ব'লে ঘোষণা করেছেন। তাঁর ভাষায়-
"আমার প্রেম বক্ষের গভীর গোপন-তলে-নিহিত মহান প্রেম, যা সর্বদাই পবিত্র, প্রেম চিরকালই পবিত্র, দুর্জয়, অমর;"
পাঠকের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, দারা ও বেদৌরার বলা এই কথাগুলো মূলত নজরুল-মানসে উদ্ভূত প্রেম বিষয়ক অধিচেতনারই বলিষ্ঠ প্রতিবয়ন। বেদৌরার কথার মধ্য দিয়ে গল্পটির উপসংহার ঘটে। তবে তাঁর এই শেষ বয়ানটি রীতিমতো একটি সার্থক ড্রামাটিক ডায়ালগের রূপ ধারণ করেছে।যেমন বেদৌরার মুখে দারার কথা- "দেখ বেদৌরা, আজ আমাদের শেষ বাসর-শয্যা হবে। তারপর রবির উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তুমি চ'লে যাবে নির্ঝরটার ওপারে, আর আমি থাকব এপারে। এই দু'পারে থেকে আমাদের দু'জনেরই বিরহ-গীতি দুইজনকে ব্যথিয়ে তুলবে। আর ঐ ব্যথার আনন্দেই আমরা দু'জন দু',জনকে আরও বড়,আরও বড় ক'রে পাব।"
পরিসমাপ্তিতে এসে গল্পটিকে না ট্র্যাজেডি না কমেডি বলা যায়। বরং এটি একটি বিচ্ছেদী-প্রেমের গল্প; এবং বিচ্ছেদই প্রেমকে অমর করে। কারণ বিচ্ছেদের গহনেই জন্ম নেয় অনন্ত বেদনার স্মৃতি। আর বেদনাই অমর প্রেমের অনন্ত উৎসারণ-ভূমি। নজরুল তাঁর আত্মমানসে প্রেমের এই অনিন্দ্য স্বরূপটিই উৎকীর্ণ করেছেন। সম্ভবত একারণেই তিনি গল্পটির উপসংহার টেনেছেন রবীন্দ্রনাথের করুণ-রস উদ্গারি গানের কলি "আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন, আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন।" এই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই বিচ্ছেদ ও বেদনাহীনতায় প্রেমের অপমৃত্যু ঘটে। সুতরাং প্রেম আর বিচ্ছেদ-বেদনা একসঙ্গে চলে। অর্থাৎ যেখানে প্রেম সেখানেই বেদনার অধিবাস। মনে হয় একারণেই Shelley বলেছেন-
"Our sweetest songs are those
that tell of saddest thought."
লেখক: প্রফেসর খৈয়াম কাদের
সাবেক উপাধ্যক্ষ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।
1 Comments
সমৃদ্ধ আলোচনা।
ReplyDelete