ঝর্না রহমান-এর জন্ম ২৮ জুন ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে- কেওয়ার, মুন্সিগঞ্জে। বড়দের নানামাত্রিক রচনা থেকে শিশুসাহিত্য ও সংগীত- সবক্ষেত্রেই উজ্জ্বল সাক্ষর রেখেছেন। আশির দশক থেকে তার লেখালেখির শুরু। কথাসাহিত্যের পাশাপাশি লেখেন প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুতোষ রচনা ও নাটক। পেশাগত জীবনে রাজধানীস্থ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ঝর্না রহমান ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। পেয়েছেন সম্মানজনক আরেকটি পুরস্কার- ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৪২৭)’।
ঝর্না রহমান গল্পকার হিসেবেই সমধিক জনপ্রিয়। সম্পাদনা করেন ছোটকাগজ ‘পরণকথা’। তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ঘুম-মাছ ও এক টুকরো নারী, অগ্নিতা, স্বর্ণতরবারি, কৃষ্ণপক্ষের ঊষা, পেরেক, জাদুবাস্তবতার দুই সখী, বিপ্রতীপ মানুষের গল্প, বিষপিঁপড়ে, তপতীর লাল ব্লাউজ, আয়নামামি, শান্তির বাবা মারা গেছে, কালঠুঁটি চিল, অন্য এক অন্ধকার। Dawn of the Waning Moon গল্পগ্রন্থ অনুবাদ করেছেন ঝর্না রহমান। গল্পচর্চা, গল্পপাঠ, সমকালীন বাংলা গল্পের গতিপ্রকৃতির বিষয়কে উপজীব্য করে বরেণ্য এ গল্পকারের সঙ্গে কথা বলেছেন উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিক হাসান-
গল্প লেখার শুরু কখন, কীভাবে?
ঝর্না রহমান: আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালি বইটি পড়ি। পথের পাঁচালির অপুকে মনে হলো ও তো অপু নয়, আমি। অপুর মধ্যে যে সুদূরের আকর্ষণ, প্রকৃতির প্রতি অনুসন্ধিৎসা আর প্রতিদিনের সাধারণ জীবনের অজস্র তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ের প্রতিও বিস্ময়বিমুগ্ধতা, আমিও যেন ছোটবেলা থেকেই অমন করে দেখতাম ভাবতাম। ওই সব দেখা আর ভাবা আমার মধ্যে কিছু একটা আকুলতা সৃষ্টি করতো। প্রকাশের আকুলতা।
তারপর এল লেখার প্রেরণা। সেটা এল আমার মায়ের মধ্য থেকে। আমার মা বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন। প্রচুর বই ছিল তাঁর। ছোটবেলাতেই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের ভা-ারের অনেক বই-ই পড়ে ফেলেছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়ের ‘বিষবৃক্ষ’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, নজিবর রহমানের ‘আনোয়ারা’, ‘গরীবের মেয়ে’, আকবর হোসেনের ‘কী পাইনি’, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘চিতা বহ্নিমান’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধ’ুসহ আরও অনেক খ্যাত অখ্যাত লেখকের বই। তখনকার দিনে ফেরিওয়ালারা চাঙারিতে করে জনপ্রিয় বইগুলো বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করতেন। মা যা পেতেন তাই কিনতেন আর মেঝেতে মাদুর বা পাটি বিছিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে গোগ্রাসে গিলতেন। মায়ের সাথে সাথে আমিও। তবে চুরি করে! ওই সব বই পড়তে পড়তে মনে হতো, আমিও পারব এমন করে গল্প লিখতে।
সুন্দর সাহিত্য ভাষার প্রতি তখন থেকেই আমার আকর্ষণ জন্মায়। তাই যেখানে সুযোগ থাকত সেখানেই অলংকৃত ভাষার ব্যবহার করতাম। স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল বাংলা। বাংলা গদ্য, কবিতা আর বিরচন অংশ। বিরচন অংশে ভাব সম্প্রসারণ, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আর কিছু কিছু সাহিত্যিক রচনা, যেমন, শৈশব স্মৃতি, ঝড়ের রাত্রি, সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত- এসব আমি খুব আনন্দ নিয়ে লিখতাম। কারণ এখানে আমার কল্পনা আর সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ ছিল। বলা যায় এসবের ভেতর দিয়ে আমার গল্প লেখার ‘শুরু’টা ঘটে।
গল্প লেখেন কেন?
ঝর্না রহমান: প্রথম কারণ ভালোলাগা। গল্প লেখা তো একটা সৃজনশীল কাজ। সৃষ্টিতে থাকে আনন্দ। সবরকম সৃজনশীল কাজই আমার খুব ভালো লাগে। তারপরে একটু তাত্ত্বিকতায় আসি। প্রতিদিনের বহমান জীবনে, ওই যে রবীন্দ্রনাথের বলা সেই ‘সহস্র বিস্মৃতিরাশি’- তা তো ভেসে যাচ্ছে! তার বেশির ভাগই দৃষ্টির আড়ালেই ভেসে যায়। কিন্তু কোনো-কোনোটা ভেসে যায় আমার চোখের ভেতরের চোখ আর মনের ভেতরের মনটাকে নিয়ে। ওই চোখ আর মন সেই ভেসে যাওয়া ঘটনার খড়কুটো নিয়ে ফেরত আসে। তখন সেটি আর খড়কুটো নয়। জীবনের সত্য, জীবনের কথা, জীবনের ঐশ্বর্য। সেটাকে নিজের ভেতরে নিয়ে কেটে-ছেটে-ছুঁয়ে-ছেনে-মেপে-চেপে, রঙ মেখে, দাগ এঁকে, একটা কিছু বানিয়ে বের করে ফেলার একটা মাতাল আনন্দ আছে, সেই আনন্দে লিখি। আর লেখকের লেখা গল্পের ভেতরে তো লেখকের গল্পও বেঁচে থাকে, তো সেটা তো এক ধরনের জীবনতৃষ্ণাই!
কী ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে লিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন?
ঝর্না রহমান: যিনি লিখবেন তাঁকে তো হতে হবে আগুনের মতো সর্বভুক, সাগরের মতো সর্বগ্রাসী, বাতাসের মতো সর্বত্রগামী। জীবন আর মানুষই লেখকের লেখার মূল উপজীব্য। তাই জীবনের বিচিত্র বিষয় নিয়েই একজন লেখকের লেখার বাসনা থাকতে পারে। তবে জীবনাভিজ্ঞতা লেখকের বিচরণের জন্য জরুরি বিষয়। অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো কিছু লিখতে গেলে তা হবে কষ্টকল্পিত, অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক, অবাস্তব ইত্যাদি দুর্বলতা আক্রান্ত। তাই একজন লেখকের জীবন যতদূর বিস্তৃত ততদূরই হবে তাঁর লেখার বিষয়। আমি একজন শিক্ষিত সমাজসচেতন মানুষ, জেন্ডার বিচারে নারী, সংসারের দায়িত্বশীল গৃহিণী, পেশাগতভাবে একজন শিক্ষক। সুতরাং এসব আমার অভিজ্ঞতার জায়গা। কাজেই আমার লেখার বিষয় এসব জায়গা থেকে আসে। স্বাচ্ছন্দ্যও বোধ করি। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দবেদনা, প্রেমবিরহ, সংঘাত-সংকট, সামাজিক সমস্যা, সবই লেখার বিষয়। মানুষের সম্পর্কের জটিলতা, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে লিখতে আমার ভালো লাগে।
পাঠকের ওপর গল্পের প্রভাব কেমন?
ঝর্না রহমান: ওরে বাবা, এ প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হবে? তাহলে উল্টে আর একটা প্রশ্ন করি, গোয়ালা কি তার গরুর দুধকে কখনো মন্দ বলে? আসলে এ কথা বলার সময় বোধ হয় এখনো আসেনি। যদিও আমি লিখছি চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। বইয়ের সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়। তারপরেও আমার বইগুলো পাঠকের দরবারে মহাসমারোহে পৌঁছেছে, এমন কথা বলতে পারব না। খুব বেশি পাঠকের কাছে আমার গল্প হয়তো পৌঁছায়নি।
আবার সব লেখকের লেখার একরকম পাঠকও থাকে না। কমলকুমার মজুমদারের সাহিত্য বহুসংখ্যক পাঠককে প্রভাবিত করবে না। তাঁর সাহিত্য হৃদয়ঙ্গম বা উপভোগ করার জন্য মেধাবী পাঠক চাই। আবার শরৎ-সাহিত্য আলোর মতো, জলের মতো বাতাসের মতো সহজ সঞ্চরণশীল, সবরকম পাঠকের কাছেই পৌঁছায়, তাঁদের মনকে নাড়া দেয়, প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। আমার গল্প, আমি দেখেছি, আত্মম্ভরিতার মতো শোনাবে হয়তো, এজন্য দুঃখ প্রকাশ করে নিচ্ছি আগে, সাহিত্যবোদ্ধা পাঠকের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। একটা ঘটনা বলি, ‘অগ্নিতা’ নামে আমার একটি গল্প সংকলন আছে, নামগল্পটি ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। যেবার বইটি বেরুল, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি থেকে ২০০৪ সনের বইমেলায়। একদিন আমি স্টলে বসে আছি, এক ভদ্রলোক এলেন। বইটি দেখিয়ে আমাকে বললেন, এই বইয়ের লেখককে আপনি চেনেন? আমি তাঁর এই গল্প আগে পড়েছি, তখন থেকে আমি তাঁর খোঁজ করছি... ইত্যাদি।
তবে এটা হলো প্রশংসা, প্রশংসা আর প্রভাব এক কথা নয়। প্রভাব অনেক বড় জিনিস। আমার গল্প আমার লেখার স্টাইল, আমার চিন্তাধারা এসব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কারও চিন্তাজগতে কোনো আলোড়ন সৃষ্টি হলো কিনা, ভাবনার উপকূলে কোনো ঢেউ আছড়ে পড়ল কিনা, সেটা আমার জানা নেই। আর প্রভাবের নানা মাত্রা, নানা স্তর আছে। সেটা সব সময় স্পষ্ট করে বোঝাও যায় না।
গল্প লেখার সার্থকতা খুঁজে পান?
ঝর্না রহমান: নাহ্, তেমন কোনো সার্থকতা খুঁজে পাই না। সময় পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। প্রযুক্তি এসে দখল করে নিচ্ছে সব কিছু। এটা এক ধরনের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মানুষের মন-মনন আনন্দবিনোদন- জীবনের সব দিকের ওপর প্রযুক্তি তার জাল বিস্তার করেছে। বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে মানুষ। তবে এটা যে নেতিবাচক তা বলছি না। বরঞ্চ প্রযুক্তি এসে মানুষের পড়ার জগৎকে লক্ষগুণে বিস্তৃত করে দিয়েছে, তা ঠিক। সাহিত্যও এখন বই ছেড়ে, কাগজ ছেড়ে, প্রযুক্তির পাখায় ভর করে উড়ে চলেছে। অসংখ্য অনলাইন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সেখানে গল্প কবিতা সবই প্রকাশিত হচ্ছে। তবুও মনে হয় এখন যেন গল্প লেখার যুগ অবসিত হতে চলেছে। প্রতি বছর বইমেলায় বহু গল্পের বই প্রকাশিত হয়, কে পড়ে সেসব? কিছু বিখ্যাত প্রখ্যাত লেখকের লেখা ছাড়া! সেখানেও গল্পের বাজার মন্দা।
উপন্যাসের প্রতি পাঠকের যতখানি আগ্রহ গল্পে ততটা নেই। এটা আমার কাছে একটা বিস্ময়ের ব্যাপারও বটে। সাধারণভাবে মনে হয়, আধুনিক যুগ হচ্ছে প্রচ- ব্যস্ততার যুগ। মানুষের যেন কোনো কিছুতেই সময় নেই। জেট বিমানের গতিতে ছুটছে মানুষ। সেখানে আনন্দলাভ বা বিনোদনের জন্য সময়সাপেক্ষ কোনো জিনিসে মানুষের আগ্রহ কম। সাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রেও হয়তো সেটা ঘটাই স্বাভাবিক ছিল। গল্প ছোট, উপন্যাস বড়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ছোট গল্পের চেয়ে বড় উপন্যাসের প্রতি পাঠকের আগ্রহ বেশি। যে কারণে প্রকাশকরা ছোটগল্পের বই প্রকাশে তেমন উৎসাহী হন না।
কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে, আসলে এরকম সাধারণ বিবেচনার যোগ্য নয়। ছোটগল্পে গল্পরস মুখ্য নয়, গল্পের নির্মাণশৈলী মুখ্য। গল্পরসের চেয়ে গল্পের নির্মিতির স্বাদ গ্রহণটাই আসল কথা। সেই স্বাদ গ্রহণ করার জন্য যে মনীষা বা ধৈর্য দরকার তা এই গতির যুগে সব পাঠকের ক্ষেত্রে পাওয়া মুশকিল। তার চেয়ে দেড়শ দুশ পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস পড়ে তার গল্পটাকে উপভোগ করার মধ্যে ভালো মজা পাওয়া যায়। তবে একটা ভালো গল্প নির্মাণ করার করার পর লেখক হিসেবে যে তৃপ্তি সেটাকে যদি সার্থকতা বলা যায়, তবে তা মাঝে মাঝে খুঁজে পাই বৈকি!
প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজে গল্প পাঠের প্রাসঙ্গিকতা কী?
ঝর্না রহমান: গল্পে তো সমাজ মানসেরই প্রতিফলন ঘটে। সমাজের পরিবর্তনগুলো মানুষের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, কতখানি বদলে দিচ্ছে মানুষের জীবনভাবনা, মূল্যবোধ, ধ্যানধারণা, আচরণ, সংস্কৃতি- এসব প্রতিফলিত হয় কথাসাহিত্যে। গল্প পাঠের মধ্য দিয়ে সমাজে পরিবর্তনশীলতার নানা মাত্রা আর জীবনের সাথে তার যোগসূত্রটা আবিষ্কার করতে পারে মানুষ। তার ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, শুভাশুভ- সব কিছুই তো গল্পে আসে। এসব প্রসঙ্গ মানুষের মনে নানারকম উপলব্ধির জন্ম দিতে পারে। যেমন দশ বছর আগের গল্পেও বর্তমান সময়ের প্রযুক্তিগত বিষয়, যেমন, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, স্কাইপি, ভাইবার, হোয়াটস্অ্যাপ, সেলফি ইত্যাদি জিনিস আসত না। প্রযুক্তির বিকাশ সমাজে একটা বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। মানুষের জীবনের সর্বস্তরে তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এখনকার গল্পে এসব বিষয় আসছে। সমাজের এইসব পরিবর্তন যুগেরও পরিবর্তন, মানুষের চিন্তাচেতনায় বাঁক বদল। সাহিত্যে তার ছায়াপাত ঘটবে আর তা সময়ের স্বাক্ষর হিসেবে মুদ্রিত হবে। সাহিত্য তো সময়কে এভাবেই ধরে রাখে।
একজন পাঠক আপনার গল্প পড়বেন কেন?
ঝর্না রহমান: একবার আমার একজন পাঠক বলেছিলেন, ‘আপনি একটা গল্পে এক ফালি জীবন নেন, তারপর সেটাকে নানা দিক থেকে দেখেন, সেখানকার বুনোটগুলো খুলে খুলে দেখেন আবার বুনে দেন’- হয়তো গল্পের ভেতরে এই এক ফালি জীবনের চালচিত্রকে নতুন নির্মাণের ভেতর দিয়ে দেখার জন্য কেউ কেউ আমার গল্প পড়তে চাইবেন। তবে একজন লেখকের সব গল্প তো আর একই ধারার হয় না। ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণের ভেতর দিয়ে এক-একরকম গল্প হয়ে ওঠে। এক-এক ধরনের গল্প এক-এক ধরনের পাঠকের কাছে ভালো লাগে। পাঠকের মধ্যে চিন্তা রুচি মনোভঙ্গির পার্থক্য আছে। একবার একজন, যিনি নিজেও সাহিত্যচর্চা করেন, আমার গল্প পড়ে বললেন, যে আমার গল্পে এত বিশুদ্ধ চেতনা যে তার দম বন্ধ হয়ে যায়। আর একবার আমার এক অচেনা পাঠকের চিঠি এল আমার ঠিকানায়। যিনি লিখলেন, আমার গল্প পড়ার জন্য তিনি দুশ মাইল পায়ে হেঁটে আমার কাছে আসতে রাজি। কারণ আমার গল্পের ভাষা তাকে বিবশ করে রাখে! আর পাঠকের কাছে গল্প যাবে না গল্পের কাছে পাঠক আসবে- এটাও একটা প্রশ্ন। তবে আমার মনে হয়, ব্যাপারটি পরিপূরক আর এ দুটোর মিথস্ক্রিয়া ঘটলে তখন একটা সার্থকতা আসে। সে ক্ষেত্রে লেখককেই তো প্রথমে পাঠকের দরবারে গল্পের ফেরিওয়ালা হতে হবে!
বাংলা সাহিত্যে গল্পের যে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে সে প্রেক্ষাপটে আপনার লিখনপ্রস্তুতি কী রকম?
ঝর্না রহমান: লেখকরাই তো লেখার নতুন বলেন, ভিন্নধর্মী বলেন বা পরিবর্তনশীল- যা-ই বলেন, সেই ধারা তৈরি করেন। সময় লেখকের মনোজগতকে অধিকার করে। সময় প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। নতুন চিন্তা, নতুন ধ্যানধারণা, নতুন মূল্যবোধ পুরোনোকে সরিয়ে দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। জীবনের নিত্য-নতুন উপচার, মানবসম্পর্কের বহুমাত্রিকতা, মানুষের অভ্যাস আচার আচরণ- এ সব কিছু কথাসাহিত্যে জায়গা করে নিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে গল্পের ফর্ম, ভাষাভঙ্গি, উপস্থাপন-কৌশল, নন্দনতত্ত্বগত ধারণা। ভেঙে যাচ্ছে গল্পের ব্যাকরণ, প্রচলিত কাঠামো। বাড়ি বানাতে গেলে একটি জানালাকে আনুভৌমিকভাবেই স্থাপন করা হয়, এটি ছিল গল্পের প্রচলিত কাঠামোগত ধারণা। কিন্তু আধুনিক সময়ে গল্পের নির্মিতিতে সেটা কৌণিকভাবে বা আংশিকভাবে বা উল্টোভাবে স্থাপন করে নতুন নির্মাণশৈলী সৃষ্টি করছেন কেউ কেউ। নৈমিত্তিকতার ভেতরে থেকে জোলো, ব্যবহৃত, চেনা, ক্লান্তিকর প্রাত্যহিকতাকে ধারালো, তীব্র, রক্তাক্ত, ক্ষতাক্ত, ক্লেদাক্ত, জ্বলজ্বলে, আগুন পোড়া, পাথর-ছোড়া অভিব্যক্তির মধ্যে উন্মোচন করা হচ্ছে গল্পে। গল্পহীনতার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে গল্প। সময়ের পরিবর্তন মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত ছাপ ফেলে যাচ্ছে। তা একজন লেখককেও নিরন্তর বদলে দিচ্ছে। ধারার সাথে তারও চলে ধারাবাহিকতা। ধারা থেকে বিচ্যুত হলে লেখককে তো চড়ায় আটকে থাকতে হবে! কাজেই একজন লেখক হিসেবে আমারও গল্পে নতুন ধারার নানা দিক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি আর কী! আমি তো আর পরীক্ষা দিতে বসছি না! আমি মনে করি ‘ধারা’র ভেতরে আমিও আছি!
গল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
ঝর্না রহমান: মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে যাই। মনে হয় গল্প বুঝি হারিয়ে যাচ্ছে! মানুষ গল্প পড়ে কম। প্রকাশকরা গল্পের বই ছাপতে চান না। তবে চক্রটা বোধ হয় পুরোপুরি ঠিক না। এখন অনলাইন পত্রিকার যুগ চলে এসেছে। এটি সাহিত্যের জগতে বিরাট একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে হয়। এতকাল বই পত্রপত্রিকা সাহিত্যের বাহন ছিল। একটি বই বা পত্রিকা একবারে খুব বেশি পাঠকের হাতে পৌঁছে না। আবার তারও একটা সময়সাপেক্ষতা থাকে। বই সংগ্রহে থাকলেও পত্রপত্রিকা তেমন থাকে না। কিন্তু অনলাইন পত্রিকায় একটি লেখা ইচ্ছা করলেই যখন খুশি তখন যে কেউ পড়তে পারে। এখানে প্রকাশিত লেখা হারাচ্ছে না। বহু লোকে পড়ে। মন্তব্য লেখে, অথবা ভালোলাগা চিহ্নিত করে। কতরকমভাবে লেখকের লেখার সাথে পাঠক যুক্ত হয়ে যাচ্ছে! তাই মনে হয় অনলাইন পত্রিকার যুগে উপন্যাসের চেয়ে গল্পের ভবিষ্যৎই উজ্জ্বল। আর গল্প হারিয়ে গেলে তো জীবনই বিবর্ণ হয়ে যাবে! গল্প কিন্তু সাহিত্য আকারে লিখিত হওয়ার আগেই মানুষ তার জীবনের অনুষঙ্গ করে নিয়েছে গল্পকে। দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে যে সমস্ত প্রাচীন মিথ-কিংবদন্তি-রূপকথা-উপকথা মানুষের জীবনের সাথে প্রবহমান হয়ে বহদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, মানুষের কল্পনা আর চিন্তার জগতকে সমৃদ্ধ করেছে, সে সব তো গল্পই! তার ওপর ভর করে আছে মানুষের জীবন। পরবর্তী সময়ে সেসব আবার গল্প লেখার অনুপ্রেরণা হয়ে এসেছে লেখকের কাছে!
আপনার গল্প লেখার প্রেরণা কী?
ঝর্না রহমান: আমার গল্প লেখার প্রেরণা জীবনকে দেখার চোখ, জীবনকে বোঝার বোধ, জীবনের ঝড়জলআগুনমাটিফুলরঙের ভেতর দিয়ে পাওয়া অভিজ্ঞতা। আর আমার চারপাশের মানুষ। এসব, এরা, আমার ভেতরে গল্প এনে দেয়, গল্প ফলিয়ে তোলার লাঙল জোয়াল বীজধানের জোগান দেয়।
বিশ্বসাহিত্যে বাংলা গল্পের অবস্থান কোথায়?
ঝর্না রহমান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে হাসান আজিজুল হক প্রমুখের হাতে বাংলা সাহিত্যে অনেক ভালো। শুধু ভালো বললে ঠিক হবে না, বলতে হবে ‘আয়ুষ্মান’ গল্প রচিত হয়েছে। যা কিনা বিশ্বসাহিত্যের আসরে হেমিংওয়ে, কিপলিং, স্টাইনবেক, টমাস মান, মার্কেজ, গুন্টার গ্রাস- এদের পাশে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু ভাষার দূরত্ব এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা। বাংলাদেশে বসে আমরা কোনো কোনো লেখকের গল্পকে বিশ্বসাহিত্যের সাথে এক কাতারে কল্পনা করে আত্মতৃপ্তি পেতে পারি, কিন্তু তাতে বাংলা গল্পের ঐশ্বর্য বিদেশের পাঠকের কাছে উন্মোচিত হবে না। তার জন্য বাংলাকে ইংরেজির পোশাক পরতে হবে। ভালো বাংলা গল্পের উন্নত মানের ইংরেজি অনুবাদ হলে তা বিদেশের পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারে, আর তখন বিশ্বসাহিত্যে তার স্থানও নির্ণীত হতে পারে। তবে এ কথা ঠিক, সামগ্রিকভাবে বাংলা গল্পকে বিশ্বসাহিত্যে একটি জায়গা করে নেওয়ার জন্য আরও অনেক পথ যেতে হবে।
আপনার প্রিয় গল্পকার কারা? কেন প্রিয়!
ঝর্না রহমান: প্রিয় গল্পকার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হাসান আজিজুল হক। তাঁদের গভীর জীবনবোধ, জীবনসত্য সম্পর্কে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিস্তৃত সমাজচেতনা, জীবনবাস্তবতা, দেশকালইতিহাসঐতিহ্যসংস্কৃতি চেতনা কাব্যময়তা- গল্পকে মানুষের জীবনের অনিন্দ্য শিল্পরূপ করে গড়ে তুলেছে। তাঁদের প্রত্যেকের রচনাভঙ্গি গল্পশৈলী স্বতন্ত্র, ভাষাভঙ্গি স্বতন্ত্র। গল্পের মানুষ আর মানুষের গল্প এঁদের লেখায় নতুনভাবে নির্মিত হয়।
0 Comments