Advertisement

উন্মেষ

সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গল্প: রবিতনের সংযম

salah unmesh

রমজান মাস। সংযমের মাস। মুসলমানদের পবিত্রতম মাস। যথাযথ ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মাধ্যমে সবাই রোজা পালন করেন। কেউ কেউ পালনের চেষ্টা করেন।
শান্ত-স্নিগ্ধ দিন শেষে চারদিকে মাগরিবের আজান হবে। সুললিত কণ্ঠে ভেসে আসছে কোরআনের আয়াত। এখন রোজাদারদের ইফতারের সময়। সবাই যার যার সামর্থ অনুযায়ী ইফতারি নিয়ে প্রস্তুত। এমন সময় ইফতার করতে বসেছে মা রবিতন এবং রবিতনের ছেলে হাশেম।  
কেউ বাসায়, কেউ অফিসে, কেউ ইফতার পার্টিতে, কেউবা রেস্টুরেন্টে বসে ইফতার করে। তারা এসবের কোথাও যেতে পারে না। তারা তো রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কের পাশে ফুটপাতের বাসিন্দা। তা-ও আবার নির্ধারিত কোনো ফুটপাত নয়। ভিক্ষা করতে করতে যখন যেখানে পথের শেষ হয়, সেখানেই বসতি গড়ে।
তারা আজ বসেছে রাজধানীর অভিজাত এলাকা বারিধারার একটি ফুটপাতে। এই সময়ে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা, সুনসান নীরবতা। কিছুটা দূরে পানির বোতল হাতে সিগনালে দাঁড়িয়ে আছে একজন ট্রাফিক পুলিশ। ইফতারের আগ মুহূর্তে শাঁ শাঁ করে ছুটে যায় দুএকটা গাড়ি। যেন ইফতারের জন্য কত তাড়া তাদের। পুলিশটিকে দেখে রবিতনের মায়া হয়। মনে মনে বলে, আহা চাকরি। নিজের জন্য আর তেমন দুঃখ হয় না।

পাশের মসজিদের মাইকগুলো থেকে একযোগে ভেসে আসে সুমধুর আজানের ধ্বনি। মনটা কেমন শীতল হয়ে আসে। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয়ে এলো। সেই সুমধুর ধ্বনি শুনে প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম গ্লাসে রাখা চিড়া-গুড়ের শরবতটুকু ঢক ঢক করে গিলে নেয় মা রবিতন।
চল্লিশোর্ধ্ব রবিতন গরিব হলেও রোজা রাখে। শুধু জরুরি অজুহাত ছাড়া। এসবে তো তার হাত নেই। এটুকু সে জানে। বাকি রোজাগুলো ভাঙে না। কারণ সে জানে রোজা মানে সংযম। এই সংযমটা তাদের মতো গরিবদের জন্যই বেশি জরুরি। ধর্মীয় জ্ঞান কম থাকলেও রোজা যে রাখতে হয়, সেটা সে বোঝে। তাই সংযমী হওয়ার চেষ্টা করে। আবার রবিতন এ-ও মনে করে, ব্যবসায়ীরা তেমন সংযম বোঝে না। কিছু কিনতে গেলেই মাথা গরম হয়ে যায়। কারণ তারা রোজা এলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। ইফতার সামগ্রীর দামও তাদের নাগালের বাইরে। কিনতে না পারলে হাত পাতে। পচা-বাসি খাবার জোটে। দুএকজন যে ভালো নয়, এমন নয়। মাঝে মাঝে ভালো কিছু জোটে। রবিতন ভাবে, ব্যবসায়ীরা সারাদিন না খেয়ে থাকে ঠিকই কিন্তু ব্যবসায়ের সংযম তারা বোঝে না। রবিতন পেটের সংযম করে। সেটা অভাবে হোক বা স্বভাবে হোক।

রবিতনের একটাই আক্ষেপ, ছেলেটাকে ভিক্ষুক বানাতে পেরেছে, মানুষ করতে পারেনি এখনো। বয়স কত আর? চৌদ্দ কি পনেরো হবে হয়তো। প্রকৃত বয়স তো মনে নেই রবিতনের। কোথাও লিখেও রাখা নেই। লেখার মতো খাতাই তো ছিল না কোনো কালে। এক প্রভাবশালী গৃহকর্তার ঔরসে ছেলেটার জন্ম। পেটের তাগিদে কাজ করতে যাওয়াই অপরাধ ছিল তার। ওই বয়সের কাঁচা শরীর আকৃষ্ট করেছিল দারোয়ান, ড্রাইভার, কেয়ারটেকার থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালার। নিচু জাতের কবল থেকে মুক্তি পেতে নালিশ করেছিল গৃহকর্তার কাছে। কিন্তু তার চেতনা যে ভোগের লিপ্সায় জেগে উঠেছিল, তা কে জানতো? মিষ্টি মিষ্টি কথায় ফাঁদে ফেলেছিল। ফাঁদই বলা যায়। বিয়ে করার আশ্বাস দিয়েছিল। স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে রবিতনই হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় স্ত্রী। সেসব ভেবে আজ মন খারাপ হয়।

রবিতন আজ ভাগ্যদোষে ভিক্ষা করে। ছেলে হাশেম সবকিছুই বোঝে কিন্তু রোজা রাখে না। সারাদিন শুধু খাই খাই করে। সে তো আর সংযম বোঝে না। ইফতারের ওই সামান্য পানিটুকু তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটাতে পারে না। তাই ইফতারের ঘণ্টাখানেক পরই আবার খাবার চায় ছেলেটা। ক্ষিপ্ত হয়ে যায় রবিতন-
‘এতো খাই খাই করোস ক্যান? একটু আগেই না খাইলি। প্যাডে কি কুমির ঢোকছে?’
‘যা খাইছি, তারে খাওন কয় মা? ক্ষিধা লাগলে খাওন চাইমু না? ইফতারে খালি চিড়া ভিজানো পানি খাইছি।’
‘রোজার দিন কম খাওন ভালো। হোনোস না রোজা মানে সংযম। এত খাইতে চাইলে কামাই কইরা খা।’
‘আমারে কাম দিবো কেডা? সবাই খালি কয়, চুরি কইরা পলায়া যাবি গা।’
‘কাম না পাইলে কম খাইবি।’
‘ওহ, সংযম খালি আমাগো লেইগ্যা? ঢাকার বড় বাপের বড় পোলারা যা খায়?’
‘চোখ ঘুইট্টা উডায়া হালামু। ওইদিকে ভুলেও চাইবি না। বেশি লোভ কিন্তু ভালো না।’
‘তুমিই তো লোভ কইরা ধরা খাইছো।’
‘হ, লোভ করছি ভালো করছি। তোর কি তাতে?’
রাগের মাথায় বললেও রবিতনের চোখটা ভিজে ওঠে। অপরাধ বোধ জাগ্রত হয়। মুহূর্তেই নিজের কৃতকর্মের জন্য মাথা অবনত করে। এবার হাশেমের কড়া জবাবের জন্য অপেক্ষা করে।  
‘আমি যে ক্যান তোমার প্যাটে আইলাম? হালার কোনো বড় লোক মায়ের প্যাট খুঁইজা পাইলাম না।’
‘তোরে যে প্যাটে আনছে, হেও তো বড় লোকই আছিল। তুই আহার পরেই তো আমারে ঘার ধইরা বাইর কইরা দিলো।’
‘হ্যার লাইগ্যাই তো আমি অইয়া গেলাম জাউরা পোলা। রাস্তার পোলা। ঠিক-ঠিকানা নাই। তোমার লুউচ্চা প্রেমিকের সংযম তহোন কই আছিলো? বড়লোক বইলা যা খুশি করতে পারে? এইহানে আমার কী দোষ?’
‘দোষ তো আমাগো কপালের। ওই দ্যাক, পুলিশ আইতাছে।’
পুলিশের আগমনে আলাপ আপাতত বন্ধ হয়ে যায়। প্রসঙ্গ পাল্টে যায়। পালানোর পথ খোঁজে মা-ছেলে।
‘লও জলদি, অন্য জায়গায় যাই। এই ফুটপাত তো আবার ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হইছে।’

ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা থেকে পা বাড়ায় মা-ছেলে। ‘এই এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত’ সাইন বোর্ডের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে রবিতন, ‘পুরা দ্যাশটাই তো ভিক্ষুকে ভরা। অফিসার ভিক্ষুকের মতো হাত পাইতা ঘুস খায়। নেতা হাত পাইতা ভোট ভিক্ষা করে। আর আমরা হাত পাতলেই দোষ। এই দ্যাশ কোনকালে ভিক্ষুকমুক্ত অইবো?’

সন্তর্পনে হেঁটে যায় রবিতন ও হাশেম। পুলিশ বুঝতে পারে না যে, তারা এখানে সাময়িক ঘাঁটি গেড়েছিল। হেঁটে চলে যায় অদূরের মার্কেটের কাছে। মার্কেটে ভিড় প্রচুর। ঈদের জন্য অসংখ্য মানুষের বাহারি কেনাকাটা। মা-ছেলে দাঁড়িয়ে হাত পাতে। নানা শ্রেণির মানুষ বের হয় কেনাকাটা করে। হাতভর্তি ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে আসে এক ভদ্রমহিলা। রবিতনকে দেখেই চিনতে পারে।
‘আরে রবিতন যে। এত বছর কোথায় ছিলে?’
রবিতন ধাক্কা খায় বুকের মধ্যে। তারই গৃহকর্ত্রী এত বছর পর সামনে। লজ্জা ও ভয়ে কাচুমাচু হয়ে যায়।
‘জে ম্যাডাম, গেরামে আছিলাম।’
‘আমি বাসায় ছিলাম না। তুমি না বলে চলে গেলে। তোমার সাহেব বললেন, কোন ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছো।’
‘সাহেব আর কিছু কয়নাই ম্যাডাম?’
‘কই, না তো। তোমার সঙ্গে ছেলেটি কে?’
‘হাশেম, আমাগো পোলা।’
‘ছেলের বাবা কোথায়?’
‘নাই ম্যাডাম। অ্যাক্সিডেন্টে মইরা গেছে।’
‘ওহ স্যাড। দুঃখের কথা কি বলবো, তোমার সাহেবও কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন পাঁচ বছর হলো।’
‘কন কি ম্যাডাম?’
রবিতনের চোখে জল চলে আসে। হাশেম হতভম্ভের মতো মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুকের ভেতরটা কেমন খাঁ খাঁ করে ওঠে।
‘সে যাক গে, পাস্ট ইজ পাস্ট। কোথায় থাকো এখন?’
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রবিতন বলে, ‘কোথাও থাকি না। ফুটপাতে ফুটপাতে রাইত কাটে। ভিক্ষা করি মা-ছেলে।’
‘আহা, কী বলো? কী জীবন ছিল তোমার। কী হয়ে গেল। তবে তুমি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারো।’
‘আমরা গিয়া কি করমু?’
‘আমারও একজন দারোয়ান এবং কাজের লোক দরকার। আমাদের দারোয়ানটা ঈদের পর আর আসবে না। বিদেশ চলে যাবে। কাজের বুয়াটাও অসুস্থ হয়ে গ্রামে চলে গেছে গত সপ্তাহে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে উপকারই হলো। আমাদের ভাগ্যে হয়তো এটাই ছিল।’
‘কী কন ম্যাডাম? যেই বাড়ি থিকা পালায়া আইতে বাইধ্য অইছি, হেই বাড়িতে আবার যামু?’
‘আরে তাতে কী? তখন তোমার বয়স কম ছিল। একটা ভুল না হয় করেছো। এত বছর তো কম কষ্ট পাওনি। চলো আমার সঙ্গে। মাথা গোজার ঠাঁই তো হবে।’
রবিতন তাকায় হাশেমের মুখের দিকে। হাশেমের চোখে জল। রবিতনও কেঁদে ফেলে। এবার আর সংযমী হতে পারে না। কোনো সংযমই তার চোখের জল আটকাতে পারে না। সংকোচ ভুলে জড়িয়ে ধরে ভদ্রমহিলাকে। আত্মস্বীকৃত স্বামীর প্রথম স্ত্রীকে।

Post a Comment

0 Comments