‘কিচ্ছু হবে না নীল। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি। অ্যাম্বুলেন্স...। কে কোথায় আছেন, প্লিজ হেল্প’। এদিক ওদিক তায় নিপা। কাউকে দেখতে পায় না। উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়ে। নীলকে রেখে কীভাবে উঠবে। কী করবে ঠিক বুঝতে পারে না।
অত্যন্ত নির্বিকার নীল- ‘অস্থির হয়ো না লক্ষ্মীটি। কিচ্ছু লাগবে না। এই সময়ে কাউকে পাবে না। বরং তুমি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও। আর তোমার আঁচল দিয়ে রক্তটা মুছে দাও লক্ষ্মী।’
‘আমি এখন কী করব? তুমি এত নির্বিকার কেন নীল?’
যেন কিছুই শুনছে না নীল। নিপার আঁচল ধরে টেনে নেয়। এই আঁচল টানা নিয়ে নিপার সঙ্গে কম ঝগড়া হয়নি। একদিন রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়ার পর নিপার আঁচল টেনে হাত-মুখ মুছছে নীল। নিপা তা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে নেয় বিরক্তিসহ-
‘তুমি কি নীল? টিস্যু আছে তো। তাছাড়া মানুষ দেখছে, এটা পাব্লিক প্লেস।’
‘হোক পাব্লিক প্লেস। মানুষের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আমাদের ফলো করবে...। আমরা অত সেলিব্রেটি নই। তাছাড়া ওই আঁচলেই আমার শিহরণ, ওখানেই জীবন-মরণ’।
বাক্যটি এবারও আওড়ায় নীল। আঁৎকে ওঠে নিপা। নিপার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে নীলের কপালে। ততক্ষণে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এই তো সেদিন একটা অনুষ্ঠানে নিপার সঙ্গে তার প্রথম দেখা। দেখতে দেখতে এত দ্রুত শেষ মুহূর্ত রচিত হবে কে ভেবেছিল! রেললাইনের মতো সারিবেঁধে স্মৃতিগুলো হামলে পড়ে। একটা দৈনিক পত্রিকায় ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করত নীল। সেদিন ছিল বর্ষার সন্ধ্যা। অ্যাসাইনমেন্ট শিট ধরিয়ে দিয়ে বার্তা সম্পাদক বললেন- ‘ভালোভাবে শর্টগুলো নেবেন। ফিচার ফটো হবে। একাধিক ছবির ক্রমিক ব্যবহার করবো। অনেক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। নামকরা নৃত্যশিল্পীরা আসবে।
অভ্যেসমতো নীল ঘাড়টা ডান দিকে হেলিয়ে দিয়ে বলল- ‘জি ভাইয়া। আমি সব অ্যাঙ্গেল ধরেই ক্লিক নেব। আপনার পছন্দমতো ব্যবহার করবেন, সমস্যা নেই।’
‘ঠিক আছে। সাবধানে যেও। আর শোনো, প্রোগ্রাম শেষ করেই অফিসে চলে আসবে। কোথাও সময় নষ্ট করো না’।
‘জি ভাইয়া...’ বলেই ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো অফিস থেকে। গিয়ে দেখে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। একটি গ্রুপ নৃত্য হচ্ছে, মধ্যমণি নিপা। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলছে নীল। বারকয়েক নিপার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। নৃত্য শেষ করে ইনডোরে যাচ্ছে নিপা। পেছনে যায় নীল।
‘এসকিউস মি...’
‘আমাকে বলছেন?’
‘আশপাশে তো আর কেউ নেই। ইনফ্যাক্ট মনোনিবেশ করার মতোও এই অনুষ্ঠানে ‘তাই নাকি?’
‘জি, অবশ্যই। নিশ্চয় আপনারও অজানা নয়?’
‘নাহ। আমি জানি না কিছুই।’
‘ইয়েস। চাঁদের সৌন্দর্য্য হয়তো চাঁদ নিজেই জানে না। জানলে অহংকার তৈরি হতো। এত সুন্দর করে মানুষকে আলোকিত এবং আলোড়িত করতে পারত না।’
ভেংচি কেটে নিপা- ‘এত সহজে?’
কিছুটা অপ্রস্তুত নীল- ‘মানে?’
‘আপনিও এরই মধ্যে পড়ে গেলেন?’
একটু নড়েচড়ে, আশপাশে তাকিয়ে নীল- ‘মানে! আপনার কথার আগামাথা বুঝছি না কিছুই।’
‘এত কম বুদ্ধির তো আপনাকে মনে হয়নি...। শুরুটা তো ঠিকঠাকই ছিল। এরই মধ্যে এমন ভড়কে গেলে চলবে?’
‘এই প্রথম। হয়তো অন্য কিছু ঘটছে আমার ভেতর। যাহোক। আমি নীল। দৈনিক স্বপ্নকথা পত্রিকার সিনিয়র ফটোগ্রাফার। প্রফেশনাল ছবিও তুলি।’ বলেই নিজের ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দেয়।
‘ধন্যবাদ। আমি নিপা...’
থামিয়ে দেয় নীল। ‘আপনাকে জানি। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। কে না চেনে...।’
অনুষ্ঠান শেষ করে যথাসময়েই অফিসে ফেরে নীল। কিন্তু ছবিগুলো দিতে দেরি হয়ে যায়। ডেস্কে বসে ছবিগুলো জুম করে করে দেখছিল সে। এরই মধ্যে কয়েকবার চিৎকার করে ছবি চেয়েছে বার্তা সম্পাদক। নীলের কোনো সাড়া নেই। উঠে এসে নীলের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছে তখনো নীল এক ধ্যানে ছবিগুলো দেখছে। চোখের সামনে হাত নাড়েন বার্তা সম্পাদক- ‘ধ্যান পরে করিস ভাই, আগে ছবিগুলো দে...। তুই তো আগে এমন ছিলি নারে নীল!’
‘দিচ্ছি ভাই। এডিট হয়ে গেছে। এখনই সার্ভারে দিচ্ছি। আপনি বসেন।’ এরই মধ্যে হাস্যখোরাকে পরিণত হয়েছে বিষয়টি। ডেস্ক ছেড়ে দু’জন উঠেও এসেছে। এর মধ্যে শান্তও ছিল। সে নিপার ছবি দেখেই চিনে ফেলে। ‘আরে এ তো আমাদের নিপা।’
নীল- ‘আমাদের নিপা মানে? চিনেন নাকি শান্ত ভাই?’
‘চিনব না? আমার ক্যাম্পাসের ছোটবোন। খুব সম্মান করে আমাদের।’
আরেকবার ধমক দেন বার্তা সম্পাদক- ‘তোরা গল্প পরে কর। আগে আমার ছবি দে। এই শান্ত, তোর কাজ তুই কর। সময় নেই...।’ তখনকার মতো বিদায় নিলেও বিষয়টি নীলের মাথায় ঘুরতে থাকে। আর নীল ঘুরতে থাকে শান্তর পেছনে। কাজের ফাঁকে নিচে নেমে চা খাওয়ায়, ফাঁক-তাল বুঝে নিপার কথা বলে। অত সহজে টলে না। কিন্তু ভাগ্যে থাকলে কে আটকাতে পারে? দুদিন বাদেই নীলকে ডাকে ফিচার সম্পাদক রহমান মুফিজ ভাই। তার কক্ষে গিয়ে দেখে সামনে ফিনফিনে সাদা সালোয়ার-কামিজ পরে বসে আছে নিপা। মুফিজ ভাই জিজ্ঞেস করলেন- ‘দেখেন তো চিনেন কিনা?’
‘জি, তাকে কে না চেনে? সেলিব্রেটি নৃত্যশিল্পী। তাছাড়া ওইদিন একটা প্রোগ্রাম থেকে তো আমিই ছবি তুললাম। ফিচার পাতার লিড হলো যেগুলো।’
‘হ্যাঁ, ছবিগুলো খুব চমৎকার হয়েছে। তাই আমাদের পাতার জন্য তাকে পার্মানেন্ট মডেল হিসেবে পছন্দ করলাম। শান্তর নাকি কাছের ছোটবোন। আপনাকে ইন্ট্রুডিউস করিয়ে দিতে ডাকলাম। সপ্তাহে একদিন তিনি সময় দিবেন। পুরো সপ্তাহের ছবি বিভিন্ন স্পটে গিয়ে তুলে রাখবেন, কেমন? দুজনে আলাপ করে শ্যুটের সময় ও লোকেশন ঠিক করে নিবেন’।
পুরনো ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে নীল- ‘জি ভাইয়া’
পরদিনই ফটোশ্যুটে রমনা পার্কে যায় তারা। নিপার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের ছবি তুলে নীল। ধরে ধরে বিভিন্ন ভঙ্গি দেখিয়ে দেওয়ার ফাঁকে এক আধটু দুষ্টুমিও করে। ধীরে ধীরে নিপারও মনে ধরে নীলকে। এরপরই জীবনে ধরে রাখার ব্যবস্থা। খুব দ্রুত গতিতেই হয়েছে সব। বিপত্তি বাঁধে যখন অফিসের সবাই জেনে যায়। হুট করেই নীলকে না করে দেয় অফিস থেকে। এরপরই ওই অফিস থেকে মন উঠে যায় নিপার। চেষ্টা করে অন্য কোথাও। শেষে একটি পত্রিকায় ফিচার রাইটারের কাজ পায়। প্রথমে নীল রাজি হয়নি, নিপার নৃত্যটা হারিয়ে না যায় কিনা। শেষে সংসার বাস্তবতার কথা চিন্তা করে সায় দেয়। ‘অল্পদিনের মধ্যেই একটা কাজের ব্যবস্থা করে নিবে। তারপর আর নিপাকে ফিচার লেখার চাকরি করতে দিবে না। পুরো সময় নৃত্যে সময় দিতে বলবে’। এমন চিন্তা থেকেই রাজি হয় নীল। ছোটাছুটিও করে কম না। মুহূর্তের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেওয়া উড়নচ-ী নীল অনেকেরই দ্বারে দ্বারে ঘোরে একটা চাকরির জন্য। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। আজও সকালে একটা ফ্রিল্যান্সিং শ্যুটে গিয়েছিল। পকেট খরচ তো আর নিপার থেকে নেয়া যায় না। যদিও নিপা চুপিচুপি নীলের পকেটে টাকা রেখে দেয়। ইতস্তত হয় নীলের। আজ যে টাকা পেয়েছিল ভেবেছিল রাতে বাইরে খেতে যাবে। কিন্তু সিঁড়ি থেকে পা-ফসকে পড়ে জীবনই দিতে হলো। সিঁড়ির কার্নিশ লেগেছে মাথায়। নাহলে হয়তো বেঁচে যেত। নিপার আঁচল ধরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নীল।
দুই
এখনো নিপা নীলের জন্যই সাজে, গান-নৃত্য করে, ইলিশ-পোলাও রান্না করে। না থেকেও পুরোটাজুড়ে আছে নীল। ইদানীং এই অফিসের ফিচার এডিটর একটা বিষয় লক্ষ্য করছেন। প্রায়ই ছুটি নেয় নিপা। সেদিন জিজ্ঞেসই করে বসলেন- ‘এত ছুটি কেন নিপা? কাল আবার কী?’
‘আগামীকাল ওর জন্মদিন। রাত ১২টায়ই কেক কাটতে চাই। এজন্য কিছু আয়োজনের ব্যাপার আছে তো...’
‘ওর মানে?’
‘আমার পার্টনার। নীল।’
‘আচ্ছা। তো আমাদের দাওয়াত করবেন না?’
ক্ষণিকের জন্য চুপসে যায় নিপা- ‘জি ভাইয়া। নিশ্চয় করব। এইবার ঘরোয়াভাবে আয়োজন করছি তো। একান্তই...।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। আপনাদের জন্য শুভকামনা’।
অফিস থেকে বেরিয়ে শপিংমলে চলে যায় নিপা। ঘুরে ঘুরে জন্মদিনের সব কেনাকাট শেষ করে। নীলের জন্য টিশার্ট, প্যান্ট, গিফট কেনে। নীলের প্রিয় রঙের টিশার্ট কেনে। মাপও ঠিক করে নেয়। রাতে কেক, ফুল মোম সাজিয়ে অপেক্ষা করে নিপা। বারবার মোবাইল হাতে নিয়ে আবার রেখে দেয়। বারবার তাকায় দেয়ালঘড়িটির দিকে। নীল আসে না। এক পর্যায়ে সেখানেই বসে ঘুমিয়ে পড়ে নিপা। পরদিন অফিসে গেলেই কক্ষে ডাকেন ফিচার এডিটর। জিজ্ঞেস করেন তার বিশেষ দিন ও মানুষ সম্পর্কে।
‘এত কী বিশেষ দিন পালন করেন নিপা? তা-ও অনানুষ্ঠানিক? আজ পর্যন্ত এই অফিসের কাউকে কোনো দাওয়াত দেননি তো। আজ পর্যন্ত তো আপনার বরকেও দেখালেন না। অথচ এত প্রেম তার প্রতি। এত আয়োজন সব।’
‘এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় ভাইয়া। কাজের কোনো আলাপ থাকলে বলুন।’
‘ওকে আপনি আসতে পারেন’।
ফিচার এডিটরের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায় নিপা। কিন্তু ফিচার এডিটরের মাথা থেকে নিপার বিষয়টি যায় না। কয়েকদিন বাদে আবার ছুটির আবেদন করে নিপা। সেদিনটিকেই মোক্ষম হিসেবে বেছে নেন ফিচার এডিটর। সহকর্মী রিপনকে ডেকে বলেন- ‘কাল সকাল থেকে নিপাকে ফলো করতে হবে। দেখব, কী এমন বিশেষ আয়োজন করে...কারা থাকে সে আয়োজনে যে আমরা সেখানে দাওয়াত পাওয়ার উপযুক্ত নই?’ রিপনও সায় দেয়। তারও তো নিপার ব্যাপারে আগ্রহ কম নয়।
রিপন বলে- ‘আমি সকাল থেকে তার বাসার কাছে থাকব। বাসায় আয়োজন করলে তো দেখাই যাবে, আর বের হলে আপনাকে কল করব। এরপর পিছু লাগব’।
পরিকল্পনা অনুযায়ীই পরদিন নিপাকে অনুসরণ করে রিপন। সাদা শাড়ি পরে ফুল আর আইসক্রিম হাতে করে একটি রিকশায় চড়ে যেতে থাকে নিপা। পেছনে গাড়িতে ফিচার এডিটরসহ কয়েকজন অনুসরণ করে নিপাকে। নিপার রিকশা গিয়ে থামে আজিমপুর কবরস্থানে। একটি কবরের সামনে দাঁড়ায় নিপা। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে...ভিজে যাচ্ছে সব।
‘মনে পড়ে নীল? আজ ছিল আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিন। কী লাজুক অথচ প্রেমিক দৃষ্টিতে দেখছিলে আমাকে। আমিও নাচের মধ্যে মধ্যে আটকে যাচ্ছিলাম তোমার চোখে। এই দিনটিই আমাকে সব দিল। সব নিয়েও নিল। এই নাও তোমার প্রিয় কদম’। বলে কবরের ওপর কদম ফুলগুলো রাখে নিপা। একটু থেকে আবার বলতে শুরু করে- ‘তুমি না বৃষ্টি খুব পছন্দ করো? বৃষ্টি এলে পাগল হয়ে যাও? আমাকে জোর করে ভেজাতে? এখন কেন চুপ করে আছ? এসো। ভিজব দুজন। এই দেখ তোমার প্রিয় আইসক্রিম এনেছি। বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রিম খেতে পছন্দ করো তুমি? নিজেরটা শেষ করে আমারটা কেড়েবুড়ে খেতে। আমিও ইচ্ছে করে ধীরে খেতাম যেন তোমারটা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমার হাতে কিছু থাকে, যেটা তুমি কেড়ে খেতে পারবে। এখন কীভাবে এমন চুপ করে আছ? কীভাবে? বলো। আমি আর পারছি না নীল। এসো...প্লিজ এসো...’।
দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছেন ফিচার এডিটর ও ফটোগ্রাফারসহ কয়েকজন। তারাও চোখ মুছছেন। নীল যেন চলে গিয়েও রয়ে গেলেন।
লেখক: রনি রেজা
0 Comments