Advertisement

উন্মেষ

মাঈন উদ্দিন আহমেদের গল্প শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি

 

চার বছর আগের ঘটনা। তখন শীতকাল। ডিসেম্বর মাস। প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফিরছি লোকাল বাসে করে। বনশ্রী থেকে বাড্ডা। রামপুরা আসার আগেই বাস পরিপূর্ণ। দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। আমি প্রথম স্টেশন থেকে উঠেছি। তাই একদম সামনের দিকের সিট পেয়েছি। সত্যি বলতে বাসে তখন পা ফেলার মতো জায়গা নেই। এরকম দৃশ্য রোজ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বনশ্রী- ব্লকে কিছু যাত্রী নামল এবং কিছু  উঠল। আগের চেয়ে যাত্রী আরও বেড়েছে নিশ্চিত। আমার পাশে বসা লোকটি নেমে গেছে। ফাঁকা সিট দখলে নিতে লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ার মতো অবস্থা। শেষমেশ শাড়ি পরা বোধ করি চল্লিশোর্ধ্ব একজন মহিলা দখল পেল। আমি জানালার পাশে। সে আমার ডানে। একটু পরে লক্ষ্য করলাম তার সঙ্গে আরেকজন আছে। একটি মেয়ে। কিছু আন্দাজ করার আগেই মহিলা আমাকে অনুরোধের মতো করে বলল,

     বাবা, তুমি একটু চেপে বসলে, একটু বসতে পারতো।

আমি হকচকিয়ে গেলাম। দুজনের সিটে তিনজন! লোকাল বাসে আগে এরকম আমি কখনও দেখিনি। তারপর আমি ছেলে তারা মেয়ে তাও আবার অপরিচিত। উপায় থাকলে সিটটা ছেড়ে দিতাম নিশ্চিত। সেটা সম্ভব নয়। আমি সিট থেকে উঠলে দাঁড়ানেরও জায়গা পাবো না। তাই অতিরিক্ত না ভেবে বললাম— 'আচ্ছা, বসুক।'

মেয়েটা বসল ঠিক দুজনের মাঝখানে। আমি জানালার সাথে একদম মিশে বসে আছি৷ অস্বস্তি হচ্ছিল কিছুটা। মহিলাটা মাঝে বসল না কেন? এরকমটাই হয়তো ছিল কপালে। দুজনের সিটে তিনজন! নতুন অভিজ্ঞতা জীবনের অভিধানে। মেয়েটা পাশে বসার পরে, যখন তার বাম হাত আমার ডান হাতের সাথে ঘর্ষণে লিপ্ত হলো তখন গায়ে জ্বালা ধরে গেল। কেমন যেন আদিম উত্তেজনা। ডিসেম্বর বলে মনে হচ্ছে না তো! চৈত্র চলে নাকি? জবাব চাই! রক্তকণাও উন্মাদ প্রায়। ঘটনা কী? চোখ বাঁকিয়ে জ্বালাময়ী খনির উৎস দেখার চেষ্টা করলাম। নমুনা দেখেই কপোকাত। হাতের কী বাহার! বাম হাতটা দেখেছি শুধু। নাহ! এবার আর হেলাফেলা করলে চলবে না। আস্ত ঘাড়টা- ঘুরিয়ে দিলাম। নিমিষেই চোখ বুঝে এলো। বহুদিন বাদে কাউকে দেখে মনে হলো, বেশ তো! উজ্জ্বল চেহারা, হাসিমাখা মুখ, মায়াভরা চোখ। সচরাচর মেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমাতে আমি অপটু। সাহসে কুলোয় না একদম। খাঁটি ভীরু আমার আত্মা। জীবনে ব্যতিক্রম কিছু ঘটাতেই হবে। শিকলে বাঁধা একগুঁয়ে নিয়মে জীবন চলে না। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে বুক ভরে দম নিলাম। সাহস সঞ্চার করলাম আর কী! তারপর! তারপর জিজ্ঞেস করে ফেললাম—'আপনার নাম কী?'

প্রশ্নের জবাব এলো দ্রুত হাসিমুখে। বলল— 'আমি তানিশা।'

তানিশা! নাম শুনে কেমন নেশা ধরে গেলো। নামেও নেশা হয় জানতাম না। নতুন অভিজ্ঞতা। তার দিক থেকে পাল্টা প্রশ্নও পেয়েছি। আশ্চর্য চমৎকার গলায় জিজ্ঞেস করলো— 'তোমার নাম?'

বাপরে! প্রথম চোটেই তুমি! থতমত খাওয়ার মতো অবস্থা। কোনমতে কাঁপা স্বরে নামটা বললাম—'তাযিন আহমেদ লুব্ধক।'

কাঁপা-কাঁপি করলে নৌকার থেকে সোনার পুঁটি পড়ে যাবে, তাই মুহূর্তেই নিজেকে শামলে নেয়ার চেষ্টা করলাম। কথার স্রোত থামতে দেয়া যাবে না। তালে রাখতে হবে যেভাবেই হোক। সে লক্ষ্যেই আবার জিজ্ঞাসার তীর ছুঁড়লাম— 'যাবেন কোথায়?'

ছোট করে উত্তর প্রশ্ন এলো একত্রে— 'তিতুমীর কলেজ। তুমি?'

 — 'আমি লিংক রোড নামব’।

 জানি, এসব অনর্থক আলাপ। লিংক রোড আসতে তেমন বাকী নেই। হাতে সময় কম। কাজের কথা দ্রুত সারতে হবে। প্রশ্নের যাত্রা অব্যাহত রাখলাম— 'আপনি কোন ক্লাসে পড়েন?'

— 'এবার এডমিশন টেস্ট দিয়েছি।'

কথাটা শুনে, বুকের উন্মাদ আকাশে দিশাহীন উড়তে থাকা হাইড্রোজেন বেলুন ঠুস করে চুপসে গেলো। মলিন হয়ে গেলো আমার মুখ। হতাশার ঝ  বিধ্বস্ত আমার মন। আন্দাজই করতে পারিনি ইনি এতো বড় ক্লাসে পড়েন। আমার চেয়ে আনাম দুই ক্লাস বেশি। এক ডানার আশাহত বিরহী পাখি হয়ে গেলাম। কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে গেলো বেমালুম। আমি আর কোন প্রশ্ন করার আগ্রহ পাইনি। আমাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে এবার সে পাল্টা প্রশ্ন করল— 'তুমি কীসে পড়ো?'

— 'এবার এসএসসি দেবো।'

জবাবটা এমনভাবে দিলাম যেন আমি এক চির বিরহী বুড়ো বাউল। মৃদু হাসি মিশ্রিত মুখে সে বলল—'বুঝতে পারছি ছোট ভাই। তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়।'

শেষবার তার দিকে তাকালাম। ছোট ভাই!! সদ্য ফোঁটা ফুলে মৌমাছি পৌছানোর আগেই ফুলগুলো ঝড়ে গেল! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি নয় কী? এরপরসে তার ব্যাগ থেকে দুইটা চকলেট বের করে আমাকে সাধলো৷ আমি আহাম্মক হয়ে গেলাম। স্নেহের দান ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে গ্রহণ করলাম।

এরমধ্যেই লিংক রোডে বাস চলে এসেছে। সাপের মতো পাশ কাটিয়ে নেমে গেলাম। রাস্তায় নেমে দেখি সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। হয়তো ছোট ভাইকে শেষ বিদায় দিচ্ছে। আর তো দেখা হবার কথা নয়।

Post a Comment

0 Comments