ফারজানা রফিক ফারিয়া
‘কেন যেন আমার নিজের প্রচন্ড বেদনাও নিজের মধ্যে কোনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে না, যেমন অতলাদ সমুদ্রের গভীর বেদনা, নিজেকে নিচ থেকে ঠেলে উপরে ঢেউ তুলতে পারে না’।
খোঁজা সাধারণত প্রাচীনকালের সেই সব চাকর বা দাসদের বলা হতো যাদের পুরুষত্ব নষ্ট করে দেয়া হত। আর এর ফলে অন্দরমহলের নারীদের পুরুষ চাকর দ্বারা সেবা দেয়া যেমন সম্ভব হতো। তেমনি অন্দরের নারীদের পরপুরুষের কুদৃষ্টি কিংবা পরপুরুষের সাথে প্রেম-ভালোবাসার সু্যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখা যেত।
সাধারণত বিভিন্ন রাজা-বাদশাদের বিভিন্ন হারেমে এই খোঁজাদের নিযুক্ত করা হত। আরবি হারেম তথা নিষিদ্ধ শব্দ থেকে এই হারেম শব্দের উৎপত্তি। মুসলমান মহিলাদের জন্য নির্ধারিত স্থান,যেখানে মাহরাম ব্যতীত অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষেধ তাকেই হারেম বলা হয়। পরবর্তীতে সেই হারেমের ধারণা উপমহাদেশের হিন্দু রাজা-বাদশাহদের মধ্যেও প্রচলিত হয়।
হারেমের চার দেয়ালে খোঁজাদের মতো অসম্পূর্ণ পুরুষের পদধূলি পরলেও যেহেতু তাদের পুরুষ হিসেবে গণ্য করা হতো মা, তাই খোঁজাদের জন্য হারেমের নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিলনা। তেমনি এক খোঁজা আগাখান তার জবানীতে লিখে গিয়েছেন হারেমের অন্ধকার জীবনের কথা।
কাহিনী সংক্ষেপ
আফ্রিকার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ চর্ম, কুঞ্চিত কেশ, পুরু ঠোঁটের লোক আগা খান। কীভাবে কোথা থেকে তথাকথিত সভ্য সমাজে তার আগমন, মনে না থাকলেও কালিতে লিখে রেখে গেছে হারেমের চারদেয়ালের ভিতরের সুখ-দুখের গাঁথা, লিখেছেন রাজায়-রাজায় ক্ষমতা,প্রতিহিংসা আর রক্ত লালসার কথা।
আফ্রিকার উপকূল থেকে আরব বণিকদের হাত হয়ে বাগদাদের হিসমাৎউদ্দীন কাজীর কাছে পৌছায় খোঁজা আগা খান। হিসমাৎউদ্দীন কাজী তাকে লিখিয়ে পড়িয়ে শিক্ষিত করে বিক্রি করে দেন কান্দাহার বাজারে, যেখান থেকে সফাভিদ রাজদরবারে পৌছান আফ্রিকার সেই ক্রীতদাস। সফাভিদ বংশের শাসনকাল যখন ক্রমশ ম্রিয়মাণ, তখন সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় ইরানেরই একদল পশুপালক, যারা পরবর্তীতে রাজ করেছেলেন ইরানের সিংহাসনে। নাম ছিল তার নাদির শাহ, যিনি পরে শা দ্বিতীয় তামশকে সরিয়ে রাজকার্য পরিচালনার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন।
একজন রাজার অধীনে এত জন রানী থাকায় রাজা যেমন সব রানীর দিকে সমান যত্ন করতে পারতেন না, তেমনি রাজার ভালোবাসার অভাবে বুভুক্ষের মতো হাহাকার চলত রাণীদের বুকে। এই হাহাকার মেটাতে খোঁজাদের মধ্যেও পৌরুষত্বের খোঁজ করত মহলের হাসী-বাদীরা।মানসিক এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য কখনো কখনো নিজেদের পীড়ন করত আবার কখনো অন্যকে। তবে আবার কখনো নিজের কর্তৃত্ব ফলানোর জন্য কিংবা হারেমকে নিজের অধীনে রেখে রাজাকে বশে আনতেও নানা কুটিলতার আশ্রয় নিতেন রাণীরা। তেমনি একজন ছিলেন সিরাজাই বেগম। যিনি দেখতে সুশ্রী হলেও মন ছিল কুটিলতায় ভরা। হারেমে প্রবেশের পরপরই শুরু করেন অত্যাচারের এক ভয়াল পরিবেশ। যার নীরব সাক্ষী হয়ে ছিল আগাখান। শুধু কি তাই? আগা খান দেখেছেন নাদির শাহের ছলচাতুরীর চেহারা, লালসার চেহারা, ভালোবাসার রূপ। তবে সবখানেই খোজা হবার দরুণ তাকে থাকতে হয়েছে নীরব সাক্ষী।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
ইতিহাস আমার বরাবরই ভয়ের কারণ। এত রাজা-বাদশা, এত কুটিলতা, এত রাজনীতির মারপেচ, এত যুদ্ধ আমার কখনোই বোধগম্য হয়নি। কিন্তু এই বইটা পড়ার পর আমার কেন জানি ইতিবাসের প্রতি হালকা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। এর পর আমি টুকটাক ইতিহাসের কথা জেনেছি, রাজা-বাদশাদের জীবনের রাজপথে আবছাভাবে ঘুরে বেরিয়েছি। সাধারণত দিনলিপি ধাচের গল্পের কোনো কাহিনী সংক্ষেপ হয় না। তবুও আমি দিয়েছি। আসলে গল্পটা আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে, তাই সংক্ষেপে জানানোর চেষ্টা।
বইটার ব্যাপারে একটা গ্রুপ থেকে জানতে পারি। তারপর হার্ডকপি খোঁজার কঠিন কাজ শুরু করি। কিন্তু মিশনে ব্যর্থ হয়ে পিডিএফ-ই পড়া শুরু করি।
আমার পড়া লেখকের প্রথম লেখা এটি। সাধারণত অচেনা বা আন্ডাররেটেড লেখকের বই আমাকে হতাশ করেছে। কিন্তু কিছু লেখক সত্যিই চমৎকার লেখেন, তবে লেখা কেন আন্ডাররেটেড হয়, তা আমার বুঝে আসেনা। এই লেখকও তেমনি একজন বলে মনে হয়েছে আমার। লেখকের ঝরঝরে লেখনীর কারণেই হয়তো এত ভালো লেগেছে বইটা। সাধারণ শব্দ চয়ন ছিল, কিন্তু মনে ধরার মতো লেখা। ঐতিহাসিক গল্প হলেও কোনো কঠিন শব্দ লেখক ব্যবহার করেননি,যার কারণে পড়তে গিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি।
নাদির শাহের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানা ছিল না আমার। বইটা পড়ে জানতে পেরেছি। আবার কোহিনূর হীরা কীভাবে ভারত থেকে পারস্যে গিয়েছে সে ব্যাপারেও আমার জ্ঞান বলতে ‘নাদির শাহ মুঘল সম্রাটের থেকে নিয়ে গিয়েছেন’ এটুকুই ছিল। এই বইতে কীভাবে নিয়েছেন,কেন নিয়েছেন সেগুলোরও উল্লেখ ছিল। নাদির শাহ কুটিল রাজা হলেও তার মাঝে যে ভালোবাসার জন্য একটা কোমল হৃদয় ছিল, আর সেই হৃদয়ের তৃপ্ততা যে সিরাজাই বেগম দিতে পারেনি এটা জেনে নাদির শাহের প্রতি বেশ মায়া লেগেছিল। এত বড় সাম্রাজ্য শাসন করে, তরবারির আঘাতে শত মানুষকে ধরাশায়ী করলেও মনে শান্তি খুঁজে পাননি।
অনুদিকে সিরাজাই বেগমের পাশবিক আচরণের বর্ণনা পড়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। একটা মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তার যেন প্রতিমূর্তি সিরাজাই বেগম। বইটা পড়ার পর রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলের যে ছবি আমার মনে ছিল তা এক নিমিষেই কর্পূরের মতো হারিয়ে গিয়েছে।
লোভ, হিংসা, ভালোবাসা, পাওয়া-না পাওয়া সব মিলিয়ে ছোট পরিসরে অসাধারণ একটা বই।
খোঁজা সাধারণত প্রাচীনকালের সেই সব চাকর বা দাসদের বলা হতো যাদের পুরুষত্ব নষ্ট করে দেয়া হত। আর এর ফলে অন্দরমহলের নারীদের পুরুষ চাকর দ্বারা সেবা দেয়া যেমন সম্ভব হতো। তেমনি অন্দরের নারীদের পরপুরুষের কুদৃষ্টি কিংবা পরপুরুষের সাথে প্রেম-ভালোবাসার সু্যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখা যেত।
সাধারণত বিভিন্ন রাজা-বাদশাদের বিভিন্ন হারেমে এই খোঁজাদের নিযুক্ত করা হত। আরবি হারেম তথা নিষিদ্ধ শব্দ থেকে এই হারেম শব্দের উৎপত্তি। মুসলমান মহিলাদের জন্য নির্ধারিত স্থান,যেখানে মাহরাম ব্যতীত অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষেধ তাকেই হারেম বলা হয়। পরবর্তীতে সেই হারেমের ধারণা উপমহাদেশের হিন্দু রাজা-বাদশাহদের মধ্যেও প্রচলিত হয়।
হারেমের চার দেয়ালে খোঁজাদের মতো অসম্পূর্ণ পুরুষের পদধূলি পরলেও যেহেতু তাদের পুরুষ হিসেবে গণ্য করা হতো মা, তাই খোঁজাদের জন্য হারেমের নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিলনা। তেমনি এক খোঁজা আগাখান তার জবানীতে লিখে গিয়েছেন হারেমের অন্ধকার জীবনের কথা।
কাহিনী সংক্ষেপ
আফ্রিকার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ চর্ম, কুঞ্চিত কেশ, পুরু ঠোঁটের লোক আগা খান। কীভাবে কোথা থেকে তথাকথিত সভ্য সমাজে তার আগমন, মনে না থাকলেও কালিতে লিখে রেখে গেছে হারেমের চারদেয়ালের ভিতরের সুখ-দুখের গাঁথা, লিখেছেন রাজায়-রাজায় ক্ষমতা,প্রতিহিংসা আর রক্ত লালসার কথা।
আফ্রিকার উপকূল থেকে আরব বণিকদের হাত হয়ে বাগদাদের হিসমাৎউদ্দীন কাজীর কাছে পৌছায় খোঁজা আগা খান। হিসমাৎউদ্দীন কাজী তাকে লিখিয়ে পড়িয়ে শিক্ষিত করে বিক্রি করে দেন কান্দাহার বাজারে, যেখান থেকে সফাভিদ রাজদরবারে পৌছান আফ্রিকার সেই ক্রীতদাস। সফাভিদ বংশের শাসনকাল যখন ক্রমশ ম্রিয়মাণ, তখন সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় ইরানেরই একদল পশুপালক, যারা পরবর্তীতে রাজ করেছেলেন ইরানের সিংহাসনে। নাম ছিল তার নাদির শাহ, যিনি পরে শা দ্বিতীয় তামশকে সরিয়ে রাজকার্য পরিচালনার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন।
একজন রাজার অধীনে এত জন রানী থাকায় রাজা যেমন সব রানীর দিকে সমান যত্ন করতে পারতেন না, তেমনি রাজার ভালোবাসার অভাবে বুভুক্ষের মতো হাহাকার চলত রাণীদের বুকে। এই হাহাকার মেটাতে খোঁজাদের মধ্যেও পৌরুষত্বের খোঁজ করত মহলের হাসী-বাদীরা।মানসিক এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য কখনো কখনো নিজেদের পীড়ন করত আবার কখনো অন্যকে। তবে আবার কখনো নিজের কর্তৃত্ব ফলানোর জন্য কিংবা হারেমকে নিজের অধীনে রেখে রাজাকে বশে আনতেও নানা কুটিলতার আশ্রয় নিতেন রাণীরা। তেমনি একজন ছিলেন সিরাজাই বেগম। যিনি দেখতে সুশ্রী হলেও মন ছিল কুটিলতায় ভরা। হারেমে প্রবেশের পরপরই শুরু করেন অত্যাচারের এক ভয়াল পরিবেশ। যার নীরব সাক্ষী হয়ে ছিল আগাখান। শুধু কি তাই? আগা খান দেখেছেন নাদির শাহের ছলচাতুরীর চেহারা, লালসার চেহারা, ভালোবাসার রূপ। তবে সবখানেই খোজা হবার দরুণ তাকে থাকতে হয়েছে নীরব সাক্ষী।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
ইতিহাস আমার বরাবরই ভয়ের কারণ। এত রাজা-বাদশা, এত কুটিলতা, এত রাজনীতির মারপেচ, এত যুদ্ধ আমার কখনোই বোধগম্য হয়নি। কিন্তু এই বইটা পড়ার পর আমার কেন জানি ইতিবাসের প্রতি হালকা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। এর পর আমি টুকটাক ইতিহাসের কথা জেনেছি, রাজা-বাদশাদের জীবনের রাজপথে আবছাভাবে ঘুরে বেরিয়েছি। সাধারণত দিনলিপি ধাচের গল্পের কোনো কাহিনী সংক্ষেপ হয় না। তবুও আমি দিয়েছি। আসলে গল্পটা আমার অসম্ভব ভালো লেগেছে, তাই সংক্ষেপে জানানোর চেষ্টা।
বইটার ব্যাপারে একটা গ্রুপ থেকে জানতে পারি। তারপর হার্ডকপি খোঁজার কঠিন কাজ শুরু করি। কিন্তু মিশনে ব্যর্থ হয়ে পিডিএফ-ই পড়া শুরু করি।
আমার পড়া লেখকের প্রথম লেখা এটি। সাধারণত অচেনা বা আন্ডাররেটেড লেখকের বই আমাকে হতাশ করেছে। কিন্তু কিছু লেখক সত্যিই চমৎকার লেখেন, তবে লেখা কেন আন্ডাররেটেড হয়, তা আমার বুঝে আসেনা। এই লেখকও তেমনি একজন বলে মনে হয়েছে আমার। লেখকের ঝরঝরে লেখনীর কারণেই হয়তো এত ভালো লেগেছে বইটা। সাধারণ শব্দ চয়ন ছিল, কিন্তু মনে ধরার মতো লেখা। ঐতিহাসিক গল্প হলেও কোনো কঠিন শব্দ লেখক ব্যবহার করেননি,যার কারণে পড়তে গিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি।
নাদির শাহের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানা ছিল না আমার। বইটা পড়ে জানতে পেরেছি। আবার কোহিনূর হীরা কীভাবে ভারত থেকে পারস্যে গিয়েছে সে ব্যাপারেও আমার জ্ঞান বলতে ‘নাদির শাহ মুঘল সম্রাটের থেকে নিয়ে গিয়েছেন’ এটুকুই ছিল। এই বইতে কীভাবে নিয়েছেন,কেন নিয়েছেন সেগুলোরও উল্লেখ ছিল। নাদির শাহ কুটিল রাজা হলেও তার মাঝে যে ভালোবাসার জন্য একটা কোমল হৃদয় ছিল, আর সেই হৃদয়ের তৃপ্ততা যে সিরাজাই বেগম দিতে পারেনি এটা জেনে নাদির শাহের প্রতি বেশ মায়া লেগেছিল। এত বড় সাম্রাজ্য শাসন করে, তরবারির আঘাতে শত মানুষকে ধরাশায়ী করলেও মনে শান্তি খুঁজে পাননি।
অনুদিকে সিরাজাই বেগমের পাশবিক আচরণের বর্ণনা পড়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। একটা মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তার যেন প্রতিমূর্তি সিরাজাই বেগম। বইটা পড়ার পর রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলের যে ছবি আমার মনে ছিল তা এক নিমিষেই কর্পূরের মতো হারিয়ে গিয়েছে।
লোভ, হিংসা, ভালোবাসা, পাওয়া-না পাওয়া সব মিলিয়ে ছোট পরিসরে অসাধারণ একটা বই।
বই: হারেম থেকে বলছি
লেখক: নিগূঢ়ানন্দ
প্রকাশনী: বিশ্বাস পাবলিশার্স
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২০৯
লেখক: নিগূঢ়ানন্দ
প্রকাশনী: বিশ্বাস পাবলিশার্স
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২০৯
বিএসসি ( কৃষি), শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
0 Comments