২০০০ সাল। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ি। সেই সময়গুলোতে আমি আমার বন্ধুদের সাথে সারাদিন নির্মলেন্দু গুণের কবিতার গল্প করতাম। বাস্তব ঘটনা হলো তখন কবির কবিতা পড়তে পড়তে কবির প্রেমে আমি উন্মাদ প্রায়। এক কথায় প্রেমের মধ্যগগনে আমার অবস্থান। এ অবস্থায় কিছু বন্ধুরা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে গোপনে একদিন বলল 'চল জয়শ্রী দাসকে কবির কাছে রেখে আসি'।
এরপর তারা একদিন, সকালবেলা মোহাম্মদপুরে আমাদের বাসায় এসে বলল, 'চল, ওট মিশুকে তোকে আজকে এক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাব। তুই খুব খুশি হবি'। আমি সরল বিশ্বাসে বন্ধুদের সঙ্গে উঠলাম।
দুই বন্ধু দুই দিক থেকে উঠে মাঝে আমাকে বসিয়ে, আমার দুইটি হাত চেপে ধরল। যেন কিছুতেই আমি পালিয়ে যেতে না পারি। আমার মনে একটু সন্দেহ হল, দেখলাম পরিবহণটি আজিমপুর এর দিকে যাচ্ছে । আমি অনেক অনুনয় বিনয় করে বললাম 'কোথায় যাচ্ছিস?'
তারা বলল 'তোকে তোর প্রেমিকের কাছে দিয়ে আসব'।
অনেক কান্নাকাটি করে, প্রতিজ্ঞা করলাম 'আমি আর কখনো নির্মলেন্দু গুণের নাম মুখে আনবো না।' এ শর্তে তারা আমাকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু তাদের মধ্যে এক বন্ধু অবাক হয়ে বলল ' তুই কবির সাথে সঙ্গে দেখা করতে চাইছিস না কেন?'
আমি তখন কেঁদে কেঁদে বললাম, 'কাছে গেলে যদি কবির সামান্য কোনো বিষয় আমাকে কষ্ট দেয়, তাহলে প্রেম একটু কমে যাবে। আমি তার প্রেমে সম্পূর্ন নিমজ্জিত থাকতে চাই। কিন্তু স্পর্শ চাইনা'।
২০২২ সালের ১৯শে জুন। বাইশ বছর পর এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়, আয়োজন হল তার সঙ্গে আমার দেখা হবার। ১৮ জুন রাতে আমি এবং কবি নির্মলেন্দু গুণ দুজন মিলে এ কথা ঠিক করলাম। কবির রচনাবলীর একাদশ খন্ড যা তিনি ৮৩জন গুণীজনকে উৎসর্গ করেছেন তারমধ্যে ক্ষুদ্র একজন আমি। ঠিক হলো আমি তার বুড়িগঙ্গায় যাব রাত সাড়ে সাতটায় এবং সেখান তার হাত থেকে বইটি আমি সংগ্রহ করবো। কিন্তু সারারাতই মনে হল যাবো কি? না যাবোনা? সকালবেলা উঠে অফিসে গেলাম। সেখানে আমি অমনোযোগী। ওই এক প্রশ্ন! যাবো, না যাবো না।
মাত্র ১৪বছর বয়স থেকে আমি কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং তার কবিতার সাথে প্রেম করছি, কিন্তু তা মনে মনে। যদি এ প্রবল প্রেম চোখের পলকে হারিয়ে যায়, তবে এর মতো কষ্ট এ জীবনে আমি পাবো না। এবার শেষ বিকেলে যখন কনে দেখার আলোটিও ডুবে যাচ্ছে, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম দেখা করব না। এবার মনে অন্য চিন্তা, 'কি করে কবিকে বলব'।
সন্ধ্যা ছয়টা সে আমাকে ফোন করে বলল 'জয়শ্রী কখন আসবে'।
তার কণ্ঠে 'জয়শ্রী' শুনলে মনটা কেমন ছটফট করে, প্রেমের যন্ত্রণায় আমি নীল হয়ে যাই। আমি কিছু বলছি না।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বললেন 'আমি আজ ক্রিকেট খেলা দেখায় মগ্ন থাকবো। আজ তবে এসো না। অন্য দিন এসো'।
আমি মনে মনে বললাম 'তোমার সঙ্গে আমার অনেক মিল'।
একথা শুনে কবির খুবই প্রিয় একজন বন্ধু বললেন,'সকলের জন্য ভালো হলো। ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেল অনেক প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়'।
লেখক: জয়শ্রী দাস, কথা সাহিত্যিক ও গবেষক।
2 Comments
অসাধারণ সুন্দর লেখা। একজন সৎ মানুষের পক্ষেই অকোপটে এ ভাবে প্রেমের কথা লেখা যায়। অভিনন্দন প্রিয় জয়শ্রী দাশ। তবে জানবেন অনেকেই আপনার প্রেমে পরে আছে।
ReplyDeleteচমৎকার লেখা কথাশিল্পী
ReplyDelete