ফেসবুক, অনলাইন পোর্টাল বা সেগুলোর বাহিরেও যারা লেখালেখি করে তারা মূলত লেখক। সেটা হতে পারে গান-গল্প, কবিতা-প্রবন্ধ, ছড়া-নিবন্ধ, ফিচার-কলাম, প্রত্রিকার প্রতিবেদনসহ নানান কৌতুক ইত্যাদি। আমি মূলত বলতে চাচ্ছি, যে লেখে সে লেখক। যে কবিতা লেখে সেও লেখক, যে গল্প লেখে সেও লেখক। এই যে লেখালেখি তারা করছে; এই লেখালেখি থেকেই কেউ কবি হবে, কেউবা গল্পকার, কেউ হবে ছড়াকার ইত্যাদি। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, কবিতা লিখলেই সে কবি না বা গল্প লিখলেই তাকে গল্পকার বলা যাবে না। এদের সবার নাম হচ্ছে, লেখক। সুতরাং লেখক একটি কমন নাম। আর গল্পকার, কবি, ছড়াকার এগুলো হচ্ছে লেখকের অর্জিত নাম। লেখককে এই নামগুলো নিজের লেখার মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হয়। অর্জন করে নিতে হয় নিজের লেখার নিজস্ব প্লট, ধরণ, চিন্তাচেতনার মাধ্যমে। অর্জন করে নিতে হয় নিজের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে। কবি, হতে হয়। গল্পকার, হতে হয়। উপন্যাসিক, হতে হয়। কবিতা গল্প লিখলেই কবি গল্পকার হওয়া যায় না। দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য চর্চা করে একসময় লেখকরা সাহিত্যিক হয়। কবিতা গল্প লিখতে লিখতেই একটা সময় লেখকরা প্রতিষ্ঠিত কবি গল্পকার হয়ে উঠে। আজ সেরকম একজন প্রতিষ্ঠিত কথাশিল্পে সাফল্য অর্জনকারী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের গল্প নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানাধীন শিরঙ্গল গ্রামে ১৩৩৩ সালের ১৫ই কার্তিক তথা ১লা নভেম্বর ১৯২৬ সালে জন্মগ্রহণ করা এই আবু ইসহাককে নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই তাঁর লেখা দুই বাংলার জনপ্রিয় উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র কথা উঠে আসে। এটা শুধু আবু ইসহাককে নিয়ে কথা বলতে গেলেই না। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর কথা উঠলে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র কথা উঠবেই। এটা একজন লেখকের কত বড় অর্জন তা বলা বাহুল্য। আবু ইসহাকের গল্প বা উপন্যাস যাই বলি না কেন, তাঁর সকল সাহিত্যকর্ম ভিন্ন গল্পের হলেও সেই গল্পগুলোয় তাঁর নিজস্ব একটা প্লট আছে। নিজস্ব একটা ভাষা তিনি ব্যবহার করে গেছেন। তিনি বাংলা ভাষার নতুন ধরনের অবিধান প্রণেতা হিসেবেও বেশ খ্যাতি অর্জন করে গেছেন। আবু ইসহাকের এমন অনেক পাঠকমহল আছে যারা কিনা আবু ইসহাকের নামবিহীন একটা লেখা পড়ার পর বলে দিতে পারবে যে, এটা আবু ইসহাকের লেখা ছিল। কারণ তাঁর লেখা পড়তে পড়তে তাঁর লেখার প্লটটার সাথে পরিচিত হয়ে যায় একজন সাধারণ পাঠকও।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মৌলভী মোহাম্মদ এবাদুল্লা ও আতহারুন্নিসার ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চমতম সন্তান। বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র আবু ইসহাকের গল্প বলার ঢং একটু ভিন্ন। অন্যদের থেকে একটু আলাদা প্লটে লিখেছেন উনার অনেক জনপ্রিয় গল্পগুলো। তবে গল্পের ভিতরের গল্পগুলো কিন্তু মোটামুটি একই বলা যেতে পারে। একেক গল্পের নাম একেকরকম। কাহিনী ভিন্ন। চরিত্র ভিন্ন। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি আবু ইসহাকের গল্পের ভিতরের যে গল্পটা সেটা কিন্তু প্রায় একই। তাঁর প্রায় গল্পের থিমগুলো হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশ ভাগ, স্বাধীনতার আনন্দ দুঃখ, দুর্ভিক্ষের হাতছানি, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ঘেরাটোপে একশ্রেণীর উত্থাপন, ধর্মকে পুঁজি করে এলাকার প্রভাবক্ষমদের উৎপীড়ন, ধর্মান্ধতা, পীর, ওঝা, খাজাবাবার দরবার ইত্যাদি।
এখন এই বিষয়টার আরও গভীরে যেতে চাইলে আমাদের একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। সেটা হচ্ছে আবু ইসহাকের জন্ম ১৯২৬ সালে। আর আবু ইসহাকের প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘অভিশাপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত কলকাতার নবযুগ প্রত্রিকায়। সুতরাং যে সময় তিনি লেখালেখি শুরু করেন সেসময়ের প্রেক্ষাপটেই তিনি লিখে গেছেন। সেই সময়টাকে তিনি নিজের লেখার মধ্যে তুলে ধরেছেন। আর সেসময় মানুষ ডাক্তারের ওষুধের থেকেও গুরুত্ব দিত ফুঁ দেওয়া পীরের পানি পরা। খাজাবাবার দরবারের মানত। এই জন্য আবু ইসহাকের গল্পে সেগুলোই উঠে এসেছে। যেগুলো বর্তমানে আমরা এখন পড়লে অবাক হয়ে যাই। এই বাংলা এমন ছিল? মানুষের এত অভাব ছিল?
বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৬২-১৯৬৩ সালে সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হওয়া লেখক এই আবু ইসহাকের গল্প নিয়ে আরও কথা বলার আগে আমরা তাঁর জনপ্রিয় একটি গল্প ‘কানাভুলা’র ছোট একটা রিভিউ পড়ি-
“উহ্, মইরা গেলাম গো, উহ্-উহ্-উহ্’
স্ত্রীকণ্ঠে চাপা চীৎকার। বালিশের ওপর দুই কুনই দিয়ে উপুড় হয়ে হাঁপাচ্ছে রাহেলা। মাঝে মাঝে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে। জাহিদের মা ছেলের বউ রাহেলাকে মরিয়ম ফুল ভিজাইয়া পানি খাওয়ানোর পরেও কাজ যখন হচ্ছিল না, তখন জাহিদকে রাস্তার কলের থেকে এক বোতল পানি নিয়ে পাইকপাড়ার পীর সাহেবের কাছে পাঠান। কিন্তু দুঃখজনক তখন পীর সাহেবও চিন্তায় মগ্ন ছিল প্রসব বেদনায় কাতরানো নিজের ছোট মেয়েকে নিয়ে। হঠাৎ কেউ একজন এসে সেই চিন্তাকে উড়িয়ে দিয়ে সু-সংবাদ দিয়ে গেলো পীর সাহেবকে-ছেলে হইছে।’
পীর সাহেবের মুখের একদম কাছে পানির বোতল নিতে মানা করেছে জাহিদকে ওর মা। কারণ পীর সাহেবের ফুঁর তেজে বোতল ফেটে যেতে পারে। ফুঁ দেওয়া পানির বোতলটা জাহিদ রিক্সার আরোহী আসনের নিচে খোড়লের মধ্যে রেখে যাওয়ার সময় দেখলো, মহকুমা শহরের একমাত্র লেডি ডাক্তার আইরিন গোমেজ ও নার্স সুশীলা বিশ্বাস পীর সাহেবের বাড়ির পিছন দরজা দিয়ে বেরুচ্ছে। অবাক হয় জাহিদ- ‘পীর সাহেবের বাড়িতেও এদের দরকার পরে?’
আসার ইচ্ছা না থাকা সত্বেও লেডি ডাক্তার ও নার্সকে অনুরোধ করে জাহিদ রিক্সায় তুলে নিয়ে বাড়িতে আসেন। এই ফাঁকে পীরের পরা পানির বোতল আরোহী আসনের নিচে খোড়লটার মধ্যে পরে গিয়ে সব পানি শেষ। একফোঁটাও আর নেই।
জাহিদের যমজ ছেলে আর মেয়ে হয়েছিল সেদিন। সন্তানের বয়স আঠারো মাস পুরা হওয়ার পর জাহিদের মা বাচ্চা বউমা সহ একহাড়ি মিষ্টি ও পীরের নজরানা বাবদ দশ টাকার একটা নোট নিয়ে জাহিদের রিক্সায় উঠে। পীরের দরবারে যাবে। জাহিদ রিক্সা চালায় পাইকপাড়ার উল্ট পথে। জাহিদের মা তখনি বলে উঠে- ‘তোরে কি দিনে-দুফরে কানাভুলায় পাইছে’? কানাভুলা হচ্ছে এক রকমের ভুত। এই কানা ভুত পথ ভুলাইয়া উল্ট পথে নিয়ে যায়। মায়ের কথায় জাহিদ বলে-
‘তুমি কিচ্ছু চিন্তা কইরো না মা। যার অছিলায় চান-সুরুয পাইছ, তার বাড়িতেই যাইতে আছি। ঐ যে দ্যাখ্যা যায় তার বাড়ি।”
শুধু এই কানাভুলা গল্পেই নয়। আবু ইসহাকের এমন অনেক গল্প আছে যে গল্পগুলোতে তিনি গল্পের মূল মেসেজ লেখেননি। তবে সাধারণ পাঠক বুঝতে পারে গল্পের মূল কথাটুকু। গল্পের পরিবেশ সেটা জানান দেয়। তিনি সাপ মেরেছেন ঠিকই কিন্তু লাঠি ভাঙেননি।
কানাভুলা গল্পে আবু ইসহাক কোথাও বলেননি পীরের পরা পানি দ্বারা জাহিদের বউ খালাস পায়নি। যমজ ছেলেমেয়ে খালাস পেয়েছেন একমাত্র লেডি ডাক্তার আর নার্সের জন্য এটাও কোথাও বলেননি। কিন্তু গল্পের পরিবেশ সেটা বলে দেয়। পাঠককে বুঝিয়ে দেয়, পীরের পরা পানিতেই যদি পোয়াতী খালাস পেত, তাহলে নিজের ছোট মেয়ের জন্য মহকুমা থেকে লেডি ডাক্তার আনা লাগতো না। যদিও পুরো গল্পটাতে জাহিদের মা অজানাতেই রয়ে গেছে। এর মূল কারণ, পীরের পরা পানির বোতল পরে গিয়ে পানি শেষ হলেও খালি বোতল কিন্তু জাহিদ ওর মায়ের কাছে দেননি। বোতলে পানিই দিয়েছিল। এই যে বিষয়টুকু গল্পের কোথাও লেখেননি আবু ইসহাক। এই জন্য জাহিদের মায়ের বিশ্বাস পীরের পরা পানিতেই কাজ হয়েছে। সেজন্যেই তিনি নজরানা দিতে যাচ্ছিল পীরের দরবারে। যদিও সে পানি আনতে আনতেই পরে গিয়েছিল। গল্পের শেষে জাহিদ একটি বাড়িকে দেখতে বলছিল ওর মাকে। সেটা যে লেডি ডাক্তারের বাড়ি সেটাও কিন্তু গল্পের কোথাও লেখা ছিল না। কারণ গল্পটা আবু ইসহাকের লেখা। আবু ইসহাক একজন আবু ইসহাকই। তাঁর লেখা গল্পই কথা বলে। কথা বলে গল্পের পরিবেশ।
১৯৮১ সালে সুন্দরবন সাহিত্য পদক ও ১৯৯৭ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল প্রতিভা আবু ইসহাককে আমি মাঝে মাঝেই বলি, তিনি সাপ মেরেছেন, কিন্তু লাঠি ভাঙেননি। যদিও এটা বলার কারণ আমি উপরে বলে এসেছি। তিনি গল্পকেই কথা বলিয়েছেন নিজের লেখায়। নিজে কিছু বলেননি। কোথাও লেখেননি। গল্পের পরিবেশই বলে দেয় গল্পের মূল কাহিনীটুকু।
‘দাদীর নদীদর্শন’ গল্পে আবু ইসহাক কোথাও বলেননি দাদীর ধর্ম নিয়ে একগুঁয়েমির কথা। দাদীর চরিত্র যেখানে কথা বলে সেখানে আবু ইসহাক লিখবে কেন? দাদী একবার অসুস্থ হলে তাঁকে ওষুধ খাওয়ানো যায়নি। তাঁর মতে, হারাম জিনিস ছাড়া নাকি ওষুধই হয় না। শুধুই কি তাই? ওষুধের মতো অনেক কিছুই দাদী খেতেন না। প্যাকেট করা বিস্কুট, লেবেল লাগানো বোতলের চাটনী, মোরব্বা, জেলী আরও কত কি! তাঁর মতে এগুলো বিলেতী জিনিস। নাম না জানা চকমকে কিছু হলেই সেটা বিলেতী এবং সেটা হারাম। তিনি তো খেতেনই না। বাড়ির ছোট বাচ্চাদেরও খেতে দিতেন না। এটা নিতান্তই একগুঁয়েমি। দাদীর অজানার জন্য এতকিছু। দাদী জানবে কেমনে? বুঝবে কেমনে? অনুমান আন্দাজটাই করবে কেমনে? কারণ দাদী তো বাড়ির বাহিরে বের হয় না। বাহিরের পরিবেশ সম্পর্কে তিনি জানেন না ঠিক মতো। কিন্তু তিনি সেটা স্বীকারও করেন না। বাড়ির মধ্যে বন্দি জীবনের মতো কাটিয়ে দেওয়া দাদী দেশ বিদেশের কোন খবর জানে না। দুনিয়া যে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা মানতেই চায় না। দাদীর নদীদর্শন’ গল্পে দাদীর ধর্ম নিয়ে একগুঁয়েমি প্রকাশের পাশাপাশি অবিশ্বাসের চরিত্রটাও তুলে এনেছেন আবু ইসহাক। একবার মেঘের কারণে ঈদের চাঁদ না দেখা গেলেও রেডিওতে চাঁদ দেখার কথা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু এটা দাদী মানবেন না। রেডিও নাকি শয়তানের কল এবং তিনি এতটাই গোঁড়ামি করছেন যে, মীরহাবেলীতে ঈদ হলো ঈদের পরের দিন।
আবার আবু ইসহাকের এই থিমগুলোর বাহিরেও কিছু জনপ্রিয় গল্প আছে। সেগুলোও প্রায় একই প্লটে লেখা।
যেমন ‘জোঁক’ গল্পটিতে লেখক দু’টি জিনিস ফুটে তুলেছেন। চৌধুরী সাহেবের ক্ষমতার অপব্যবহার। ওসমানদের রুখে দাঁড়ানোর দৃশ্য। বর্গা চাষীর যে কষ্টটা সেটাকে পাঠকের সামনে তুলে এনেছেন আবু ইসহাক। বুক পানিতে ডুব দিয়ে কাটা পাটের তে-ভাগা আইন পাশ হয়েছে জানে না ওসমান। জানার কথাও না। অক্ষর না চেনা ওসমানের থেকে টিপসই অন্য কথা বলে নিয়েছিলেন চৌধুরী সাহেব। এখানে ক্ষমতার জোড় খাটানো প্রকাশ পেয়েছে চৌধুরী সাহেবের। আসলে গল্পটা লেখা মূলত ১৯৫৮ সালে। যুদ্ধের আগে অবশ্য এমনটাই ছিল বাংলার পরিবেশ। সেই পরিবেশটাকেই আবু ইসহাক গল্পে তুলে ধরেছেন।
আবার আবর্ত গল্পে ইউনুসের চাচার বেঈমানি ফুটে উঠেছে। সেই সাথে ফুটে উঠেছে তাদের মূর্খতা। নদীর পানির স্রোতে নূরজাহানের ভেসে যাওয়াটা বেশ কষ্টের ছিল। পড়ার সময় শরীর শিউরে উঠেছিল। তবে এই একটা গল্পে আমার কথা বলার আছে একটু ভিন্নভাবে। আবু ইসহাক এখানে ইউনুসের চাচার মরণকাল উল্লেখ করেছেন যখন ইউনুস চাচার কাছে জমি চাইতে যায়। অথচ সেই চাচা আবারো সুস্থ হয়। দাড়িতে কলব করে। এবং গল্পের শেষে নূরজাহানকে পানিতে ডুব দেওয়ায়। এই ডুব দেওয়ানোর সময় এত শক্তি কোথায় পায় মানুষটা? একটা শেষ বয়সী মানুষের এত শক্তি একজন যুবতী মেয়ের ঘার ধরে ডুব দেওয়ায় পানিতে? এখানে কেমন যেন একটু খটকা লেগেছে আমার। তবে গল্পটা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ইউনুসের চাচার নূরজাহানকে বিয়ে করার মধ্যদিয়ে। যদিও নূরজাহান ও ইউনুস দু’জন দু’জনকে বেশ পছন্দ করতেন।
আবু ইসহাকের লেখায় ব্রিটিশ শাসিত বাংলার রুপ পাওয়া যায়। আবু ইসহাকের জনপ্রিয় গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, বোম্বাই হাজী, হারেম, জোঁক, খুতি, ঘুপচি গলির সুখ, আলামত, মৃত্যু সংবাদ, ময়না কেন কয় না কথা, ঠগিনী, বংশধর, সাবীল, আবর্ত, পিপাসা, শয়তানের ঝাড়, মহাপতঙ্গ ইত্যাদি। আবু ইসহাকের এই মহাপতঙ্গ ছোট গল্পটি অবলম্বনে রচিত চিত্রনাট্য সুইজ্যারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় পুরস্কার লাভ করে। গল্পটিতে দু’টি চড়ুই পাখির কণ্ঠে কথা বলিয়েছেন আবু ইসহাক। গল্পটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে টানাপোড়ন দুর্ভিক্ষ ছিল সেটা বেশ ফুটে উঠেছে।
আবার ‘ময়না কেন কয় না কথা’ গল্পে ময়না পাখির জয় বাংলা বলাটা বেশ মজার ছিল। সেই গল্পের শুরুতেই যেটা বুঝতে পারা যায় তা হলো, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের সাথে শ্রত্রæতা করা সোলেমানের মনের অবস্থা।
অন্যদিকে স্বল্প চাহিদার মানুষ হানিফের জীবনীটা বেশ মজা করে লিখে গেছেন গুণী কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাক ‘ঘুপচি গলির সুখ’ গল্পে। এতটাই স্বল্প চাহিদার মানুষ ছিলেন গল্পের মূল চরিত্রের হানিফ যে, পরীক্ষার খাতায় পঁয়ত্রিশ নম্বর পেয়ে পাশ করা ও পঁয়ত্রিশ টাকার একটা চাকরি জোগাড় করাই ছিল তার মূল ইচ্ছা। প্রথম ইচ্ছাটা পূরণ হলেও দ্বিতীয়টা পূরণ করতে পারেনি খুব সহজে। শুরুটা করে বিশ টাকা মাইনের প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টারী দিয়ে। হানিফের মতে, যার কোন গতি হয় না, সেই করে মাষ্টারী। যদিও বছর পাঁচেক বাদে দ্বিতীয় ইচ্ছেটাও পূরণ হয় যুদ্ধের ডামাডোলের সেই বাজারে। হানিফ তখন কেরানিগিরি শুরু করে।
আবু ইসহাকের গল্প পড়ে আমি বেশ মুগ্ধ হই। কারণ তিনি দেশ ভাগের আগে ও পরের এই বাংলার যে চিত্রগুলো তুলে এনেছেন গল্পে তা যেন বেশ শিক্ষনীয়। বর্তমান সময়ে এই আমাদের মতো তরুণদের তা যেন জানাটা দরকার ছিল। সে সময় যারা একটু পড়াশুনা করেছে, জ্ঞান অর্জন করেছে তাদের কাছে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত ঠকেছে। কারণ তারা ছিল অতি সাধারণ। তেমন একটি গল্পের কথা বলতেই হয়। আবু ইসহাকের ‘খুতি’ গল্পটা পড়ার পর প্রথম যে কথাটা মনে হয়েছে তা হলো- ‘উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট।‘ গল্পে আকবর সাহেব কত ভালো মানুষ। নামাজী ব্যক্তিত্ব এই আকবর সাহেব বিসমিল্লাহ্ না জানা চাকরের হাতে জবাই করা মোরগের গোস্ত খাবে না। অথচ ভিতরটা লোভে ভরা। ধর্মের বেশে অন্যের ক্ষতি বা অন্যকে ঠকানোই ছিল এই আকবর সাহেবের মূল কাজ।
বিড়ালের পেট থেকে তিনটা ছানার বদলে যদি একটা ছানা জন্ম নেয় তাহলে ছানাটা বেশ শক্তিশালী স্বাবলম্বী হয়। দুই বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের প্রকাশিত বই খুব বেশি নেই। তিনি যতটুকু লিখতে চেয়েছেন, মানসম্মত লেখার চেষ্টা করেছেন। আবু ইসহাকের উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে, সূর্য দীঘল বাড়ী, পদ্মার পলিদ্বীপ, ও কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাস ‘জাল’ ইত্যাদি। গল্পগ্রন্থগুলো, হারেম, মহাপতঙ্গ, স্মৃতিবিচিত্রা ও অগ্রন্থিত গল্প, এক ডজন গল্প ইত্যাদি। আবু ইসহাকের ধ্রæপদ সাহিত্যাঙ্গন থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি নাটকও রয়েছে ‘জয়ধব্বি’ নামে।
বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একজন কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাক স্কলারশিপ নিয়ে নড়িয়া ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ সালে এসএসসি পাশ ও ১৯৪৪ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এর ১৬বছর পর তিনি ১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেন। কর্মসূত্রে তিনি দেশ ও দেশের বাহিরে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে কর্মরত ছিলেন। জনপ্রিয় উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র এই লেখক আবু ইসহাক ২০০৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যু বরণ করে এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে তিনি মরনোত্তর স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
লেখক: সাহিত্য সমালোচক ও গল্পকার
0 Comments