Advertisement

উন্মেষ

সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য: বাস্তবতার অসামান্য দলিল

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

বাংলাদেশের ‘সব্যসাচী লেখক’ সৈয়দ শামসুল হক। বিংশ শতাব্দির শেষভাগের সক্রিয় একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক। কবিতা, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, ছোটগল্প, অনুবাদ, গান-তথা সাহিত্যের সব শাখার সাবলীল বিচরণই তাকে ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার প্রায় ৬২ বছরের লেখক জীবনে মাত্র ২৯ বছর বয়সে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেছিলেন। বলতে গেলে, তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এ পুরস্কার লাভ করেছেন। এ ছাড়া বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে একুশে পদক এবং ২০০০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেছেন। সুতরাং বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে বা বাংলাদেশের তিনটি সর্বোচ্চ পুরস্কারই তিনি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তাঁর দীর্ঘ সাহিত্য জীবন বা বহুমাত্রিক কর্মকা- নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বিশাল ক্যানভাসের প্রয়োজন। আজ শুধু তাঁর কাব্যনাট্য নিয়ে কিছু বলার প্রয়াস পাবো। তাই শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, সৈয়দ শামসুল হক কিন্তু নাট্যকার হিসেবেও ব্যাপকভাবে সফলতা পেয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘বিবিসি’র বাংলা বিভাগে নাটক নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান। এ সম্পর্কে বিবিসি বাংলার তাঁর সহকর্মী তালেয়া রেহমান বলেছেন, ‘উনি
নাটক এবং অভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন, নির্দেশনাও দিয়েছেন। বিশেষ করে ক্লাসিক্যাল নাটকের অনুবাদে তার আগ্রহ ছিল। এ ছাড়া বিবিসির যেমন কাজ সেটা তিনি করে গেছেন সেগুলো নিশ্চয়ই তার ভালো লাগেনি।’ পরে অবশ্য সৈয়দ শামসুল হকও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নাট্যকার হিসেবে আমার কাজের সূচনাটি হয়েছিল বিবিসি বাংলায় নাটক করবার অভিজ্ঞতা থেকেই।’
তাঁর কাব্যনাট্যসমূহ হচ্ছে-পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬), গণনায়ক (১৯৭৬), নূরলদীনের সারাজীবন (১৯৮২), এখানে এখন (১৯৮৮), কাব্যনাট্য সমগ্র (১৯৯১), ঈর্ষা, বাংলার মাটি বাংলার জল, নারীগণ, যুদ্ধ এবং যোদ্ধা। তাঁর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটি কাব্য নাটক। পরের নাটক নূরলদীনের সারাজীবন ফকির বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত। তাঁর রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশ এবং মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি ও ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরেছেন। অন্য নাটকের মধ্যে নারীগণ, যুদ্ধ এবং যোদ্ধা, ঈর্ষা, এখানে এখনে সমকালীন বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।
ড. মিল্টন বিশ্বাস তাঁর নাটক সম্পর্কে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁকে মুনীর চৌধুরী ‘তোমার হাতে নাটক হবে’ বলেছিলেন। সে সময় ইংরেজি একাঙ্কিকা অনুবাদ করেছেন তিনি। তবে যৌবনে কবিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও গল্প-উপন্যাসের আঙিনায় পদচারণা ছিল তাঁর নির্বিঘ্ন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় প্রাণিত হয়েছেন তিনি। দেশের সমূহ বর্তমানকে ভাষামাধ্যমে আরো একটি স্তরে প্রকাশ করার দরজা দেখে কবিতার হাত ধরে নাটকে প্রবেশ তাঁর। কারণ তিনি হয়তো মনে করেছেন, খ- কবিতার সব সম্ভাবনা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সেখান থেকে মুখ ফেরানোর জন্য মহাকাব্য, কথাকাব্য ও কাব্যনাট্য লেখার অনুপ্রেরণা লাভ করেন সৈয়দ হক।’ (কাব্যনাট্যের সৌকর্যে সৈয়দ শামসুল হক)
সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবে বেশি পরিচিত। নাটকটির চরিত্রগুলো হচ্ছে-মাতব্বর, পীর সাহেব, মাতব্বরের মেয়ে, পাইক, গ্রামবাসী, তরুণদল ও মুক্তিযোদ্ধাগণ। নাটকটিতে কোনো দৃশ্য-বিভাজন নেই। একটানা কাহিনির স্রোত বয়ে চলেছে শুরু থেকে শেষ অবধি। নাটকটি গ্রামবাসীর সংলাপ দিয়ে শুরু। ‘মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা... ক্রমান্বয়ে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী, যুমনার বানের লাহান’-মানুষের এ আগমনের ইঙ্গিতে আছে সব ধরনের প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করার সম্ভাবনা। কাহিনির শেষ মুহূর্তে মাতব্বর শুনেছেন, ‘পায়ের আওয়াজ শুনি মাঠ হয়া পার শত শত হাজার হাজার/ দৌড়ায় আসতে আছে এখানে এবার।’ এই পায়ের আওয়াজ আসলে মুক্তিপাগল মানুষের আওয়াজ। যে পদধ্বনি রাজাকার মাতব্বরদের মতো মানুষকে ভীত করে তুলেছে। শেষে তার মৃত্যু আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তির আকাক্সক্ষার বার্তা হয়ে ওঠে। বলা যায়, বাংলাদেশে এখনো যেসব নাটক মঞ্চস্থ হয়; তার মধ্যে এ নাটক সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও দর্শকনন্দিত।  
এরপর সৈয়দ শামসুল হকের যে নাটকটির প্রসঙ্গ আসে, সেটি হচ্ছে-নূরলদীনের সারাজীবন। বলে রাখা ভালো, নাটকটি শুধু মঞ্চেই নয়; আবৃত্তিকারের কণ্ঠেও অসংখ্যবার ধ্বনিত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। নাটকটি প্রসঙ্গে নাট্যব্যক্তিত্ব অনিরুদ্ধ বিশ্বাস বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম দশটি কাব্যনাট্যের নাম করতে গেলে প্রথম দিকেই স্থান দিতে হয় এই নাটকটিকে। সৈয়দ শামসুল হক সারাজীবনে আর কিছু যদি নাও রচনা করতেন, শুধু নূরলদীনের সারাজীবনের জন্য তিনি অমর হয়ে থাকতেন, এ-কথা বলাতে কোনো অত্যুক্তি হয় না। কাব্য করে-করে অনেক শব্দশিল্পী অনেক সাহিত্য নির্মাণ করেছেন। কিন্তু তাঁদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলতে হয়, সৈয়দ হকের এ-সৃষ্টি প্রায় অলৌকিক। একথা একান্তই নিজস্ব উপলব্ধি থেকে বলছি।’ (সৈয়দ শামসুল হক: এক বিস্ময়কর নাট্যকার)
তবে নাটকটি রচনা করতে গিয়ে নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকও বলেছেন, ‘ইতিহাস থেকে আমি পেয়েছি নূরলদীন, দয়াশীল ও গুডল্যাডকে; কল্পনায় আমি নির্মাণ করে নিয়েছি আব্বাস, আম্বিয়া, লিসবেথ, টমসন ও মরিসকে। নূরলদীনের আত্মা ও প্রেরণা আমি ইতিহাসের ভেতর থেকে সংগ্রহ করেছি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক সংকট আমি সম্ভবপরতার ক্ষেত্র থেকে আবিষ্কার করে নিয়েছি। (নূরলদীনের সারাজীবন: ‘সবিনয় নিবেদন’ অংশ)
কাব্যনাট্য যে এত শ্রুতিমধুর হতে পারে, ছন্দ ও অন্ত্যমিলের সমন্বয় থাকতে পারে, তাল-লয়-রসের অমীয় ভান্ডার হতে পারে; তা নূরলদীনের সারাজীবন না পেলে আমরা হয়তো বুঝতে পারতাম না। নাট্যকার যখন নূরলদীনের কণ্ঠে উচ্চারণ করেন-‘হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই।/ এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়,/ হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়।/ এক এ নূরলদীন যদি মিশি যায়,/ অযুত নূরলদীন য্যান আসি যায়,/ নিযুত নূরলদীন য্যান বাঁচি রয়।’ কী এক অসম্ভব আবেগকে সম্ভাবনাময় করে তুলে ধরেছেন তিনি। নাটকের অভিনেতা থেকে শুরু করে দর্শক-শ্রোতারাও আবেগকম্পিত হয়ে যান।
এ ছাড়া সৈয়দ শামসুল হকের অন্য নাটকের মধ্যে দুই অঙ্কের ‘এখানে এখন’ নাটকে দুটি শ্রেণি-চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এর আগে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা এবং কলোনির উচ্চবর্গ ও স্থানীয় নিম্নবর্গের পরিচয় নাটকে উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। এ নাটকে নাট্যকারের ভাষায় ‘ব্যবহর্তা আর ব্যবহৃত’ দুটি শ্রেণি দেখা যায়। ‘গণনায়ক’ নাটকটি উইলিয়াম শেকসপিয়ারের জুলিয়াস সিজার অবলম্বনে রচিত। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’র পর এটি লেখা অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ তিনি রাজনৈতিক কিছু অভিজ্ঞতাকে পরীক্ষা করেছেন। এ নাটকে রাজনৈতিক বিবেকের পালা বলতে চেয়েছেন। ‘ঈর্ষা’ নাটকে কাব্যনাট্যের চূড়ান্তরূপ দেখিয়েছেন। ঈর্ষার নির্যাস নিয়ে ‘ওথেলো’ রচিত বলে তিনি মনে করেন।
চিত্রনাট্য ও কাহিনি বর্ণনার সফলতা ছাড়াও সৈয়দ শামসুল হক নাটকে অসংখ্য উপমা-প্রতীক আর চিত্রকল্পের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এসব তুলনা-প্রতিতুলনা, সাংকেতিক বিবরণ এবং কল্পচিত্রের আভাসে তাঁর সমাজমনস্কতা প্রতিভাত হয়। অপরদিকে ব্যক্তির অভিজ্ঞতার সাথে সমষ্টির চিন্তা ও অর্জনের মিলিত প্রকাশও দর্শককে আকৃষ্ট করে। তাই সাহসের সাথেই বলা যায়, নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকের কালজয়ী নাটকসমূহ কালের বিচারে উত্তীর্ণ হবেই। কারণ এমন কাব্যনাট্য বাংলা সাহিত্যে একটি-দুটিই হয়। কেননা তাঁর কাব্যনাট্যে উদ্দেশ্য একক, উপায় সংক্ষিপ্ত, সংবেদনা তীব্র। আর এ সংবেদনা প্রকাশে সৈয়দ শামসুল হকের দক্ষতা সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ এবং অসামান্য।

Post a Comment

0 Comments