Advertisement

উন্মেষ

রক্তক্ষরণের যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কবিতার প্রসব হয় - সৌরভ শইকীয়া


সৌরভ শইকীয়ার জন্ম ১৯৬৯ সনে। সমসাময়িক আধুনিক অসমিয়া কাব্য সাহিত্যের একটি সমাদৃত নাম।প্রান্তিকএর পাতায় প্রথম আত্মপ্রকাশ। আত্মপ্রকা­শ মাত্র বৃহত্তর পাঠক সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।ইংরেজি থেকে শুরু করে সংবিধান স্বীকৃত প্রায় সব ভারতীয় ভাষায় কবিতা অনূদিত হয়েছে। প্রকাশিত কাব্য সংকলন নয়টি। জীবনে বেশি প্রভাব মায়ের। পিতা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মাচারী। সৌরভ রাষ্ট্রীয় আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনেক কবিতা উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। সার্ক সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রিত। ২০১০ সনে ভারত ভবন, ভূপালে অনুষ্ঠিত কবি ভারতীঅনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। সম্প্রতি গোয়ায় অনুষ্ঠিত North East and Western Poetry Festival এ যোগদান করেন। Penguin India র সংকলন ‘The Dancing Earth’ কবিতা সন্নিবিষ্ট। তাছাড়া ‘Indian Literature’ সমকালীন ভারতীয় সাহিত্য­, the SARAC journal ‘Beyond Borders’ এবং বিভিন্ন English Literary Journal এ প্রকাশিত হয়েছে একগুচ্ছ রুচিপূর্ণ মননশীল কবিতা

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীর হয়ে সৌরভ শইকীয়ার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অসমিয়া সাহিত্যের অনুবাদক বাসুদেব দাস।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ প্রথম কবে কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং কবে থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন ?

সৌরভ শইকীয়াঃ প্রাক স্নাতক পর্যায়ে কলেজে পড়ার সময় প্রথম কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। নব্বই দশকের শেষের দিক থেকে আমি ধীরে ধীরে কবিতার পৃথিবীতে সিরিয়াসলি পা রাখি।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ আপনি যখন লিখতে শুরু করেছিলেন আর আজকের যে সামাজিক পরিবেশ তারমধ্যে অসমিয়া কবিতার কোনো উত্তরণ ঘটেছে কি? সেই সম্পর্কে একটু বিস্তারিতভাবে বলুন।

সৌরভ শইকীয়াঃ সময়টা বোধহয় ১৯৯৫। প্রখ্যাত অসমিয়া সাময়িক পত্রিকা 'প্রান্তিক'এ প্রায় নিয়মিত ভাবে আমার কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। একজন তরুণের উত্থানে এটি একটি কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল। সাময়িক পত্রিকাটি সেই দায়িত্ব পালন করেছিল। আমি যখন লিখতে আরম্ভ করেছিলাম তখন অসমের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি আজকের মত এতটা অস্থির এবং উত্তাল ছিল না। প্রায় গোপনে অসমিয়া কবিতার জগতে একটি মিষ্টি মধুর বাতাস সশব্দে প্রবেশ করেছিল। সেই সময়ের প্রতিবাদ মুখর একঘেয়ে শব্দসর্বস্ব যান্ত্রিক কবিতাগুলি দীক্ষিত পাঠককে বিরক্ত করতে শুরু করেছিল।কবিতা ও এক ধরনের শিল্প। জীবনের অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধির সার কথাটুকু নিয়ে কবিরা কবিতা রচনা করেন।তার মধ্যে পরিস্থিতি এবং সময়ের চাপ পড়ে। অসমিয়া কবিতা একটি পরিক্রমার মধ্য দিয়ে পার হয়ে এসে তবেই তার ভাঁজ গুলিতে যুগচেতনার রং এবং ধুলো লেগেছে। রূপান্তর ঘটেছে।হয়তো এই রুপান্তরই উত্তরণের এক একটি ঢাল।নিশ্চয়। অসমিয়া কবিতার পর্বান্তর ঘটেছে।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ অসমিয়া সাহিত্যের কোনো কবির কবিতা আপনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে কি?

সৌরভ শইকীয়াঃ কবিতার চেয়ে আমার জীবনে পুরোনো গানগুলির প্রভাব বেশি। আমি ঐতিহ্য এবং মুল্যবোধে বিশ্বাস করি। একটি অসমিয়া কবিতা পড়ে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের একজন মানুষ সেই কবিতার মধ্যে অসম এবং অসমিয়া ভাষাকে যেন উপলব্ধি করতে পারে তা চাই। গভীর এবং মাটির স্পর্শ থাকা কবিতাই সবসময় আমাকে আকর্ষণ করে। জোর করে লেখা পাণ্ডিত্যপূর্ণ কবিতা বিরক্তিকর। আমার রচনায় কীসের প্রভাব সেটা পাঠকই বলতে পারবে। আমার কোনো রোল মডেল নেই।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ আপনার কিছু কবিতায় অসমের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক পরিবেশ সুন্দর করে জায়গা করে নিয়েছে। এই সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন।

সৌরভ শইকীয়াঃ কবিতা একটি আয়নার মতো। আমাদের চারপাশ এবং সমাজের অবিকল প্রতিচ্ছবি সেই আয়নাটিতে প্রতিফলিত হয়। হয়তো আমার কবিতায় অসমের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা ভৌগোলিক পরিবেশ জায়গা করে নিয়েছে। এটা নিতান্তই স্বাভাবিক। কারণ অসমকে গভীর আবেগে আমি বুকে বহন করে বেড়াই।অসমের মাধ্যমেই আমি বিশ্বকে ভালোবাসি। চারপাশের পরিস্থিতি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাতাস গায়ে এসে আঘাত করে। সময়ের অপবাদ এবং রক্তের দাগ লাগে আমার রচনায়।আমার নির্মাণ সমসাময়িকতা থেকে আমার নিস্তার নেই।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ অসমিয়া কবিতার সাম্প্রতিক অবস্থান সম্পর্কে আমাদের কিছু বলবেন কি?

সৌরভ শইকীয়াঃ সমসাময়িক ভারতীয় কবিতার প্রেক্ষাপটে অসমিয়া কবিতার মান যথেষ্ট উন্নত এবং চিত্তাকর্ষক। কিন্তু এটা সত্য যে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিঙের মতো অনেক রংচঙে আবর্জনা সুন্দর কবিতাগুলিকে ঢেকে ফেলেছে। অসমে কবিতার সমাদর আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।কয়েকজন প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত করেছে। পরিবর্তিত হয়ে গেছে অসমিয়া কবিতার শ্রী-ছাঁদ।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ কবিতা লেখার জন্য আপনি কোনো ধরনের অনুপ্রেরণা অনুভব করেন কি?

সৌরভ শইকীয়াঃ আমি যখন গভীরতায় নিমজ্জিত হই তার কিছু নির্ভুল আগমনী বার্তা পাই। কিন্তু এটা খুবই বিরল। ক্বচিৎ কখন ও হয়ে থাকে। এক চূড়ান্ত শক্তি বার্তা প্রেরণ করে উপর থেকে। মিরাকল কিংবা আশ্চর্য পতন। ঢেউ-তুফান প্রচন্ডভাবে আঘাত করতে থাকে। রক্তক্ষরণের যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কবিতার প্রসব হয়। যন্ত্রনাও এক ধরনের প্রেরণা।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ কবিতা লিখে জীবনধারণ করা সম্ভব কি? অসমিয়া কবিতা জীবিকার অবলম্বন হতে পারে কি?

সৌরভ শইকীয়াঃ কবিতা লিখে জীবনধারণ করা সম্ভব নয়। আগামী কুড়ি বছর তা সম্ভব হবে না।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আজকের দিনে কবিদের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে কি?

সৌরভ শইকীয়াঃ সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে একজন দায়িত্বশীল লেখক পরিবর্তন সূচিত করতে পারে। শুভদিনের পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে তুলতে পারে। একটি ভালো কবিতা, নাটক, অথবা উপন্যাস মানুষকে ভাবতে এবং চিন্তা করতে শেখায়। কবিরা আকাশ থেকে খসে পড়ে নি যে মানুষের কথা তারা ভুলে যাবে। একজন লেখক অথবা কবি তিনি নিজের অজান্তেই মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। তিনি যে ভাষায় লেখেন সেই ভাষার প্রতি দায়বদ্ধ। সমাজের জন্য, সেই সমাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জন্য তিনি কিছু একটা রেখে দিয়ে যেতে চান। একজন লেখক আমাদের সমাজেরই অঙ্গ নয় কি?

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ কবিতা দেশকালের দ্বারা সীমাবদ্ধ কি?

সৌরভ শইকীয়াঃ কবিতার কোনো দেশ নেই। শ্রেষ্ঠ কবিতার সুরভি দেশ-কালের পরিধি অতিক্রম করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কবিতা সীমাবদ্ধ নয়। মূলত মুক্ত এবং স্বাধীন এই কবিতা।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ আপনি কিসের জন্য কবিতা লেখেন এবং কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

সৌরভ শইকীয়াঃ কবিতা লেখার কথা কখনও ভাবিনি। ঘটনাক্রমে এসে পড়েছি। আলাদা কোনও তাগিদই ছিল না।হয়তো নিজেকে দেখার এক তাড়নায় ধীরে ধীরে কবিতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছি।সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’-কথাটা বলেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। লিখলেই কি কবিতা হয়? একজন সার্থক কবি তার যুগ সম্বন্ধে সচেতন থেকেও নিজস্ব ভাবনা এবং প্রতিভায় যখন কবিতা লিখে যায় তখন তার কবিতার আঙ্গিক এবং ভাষা বিচিত্রভাবে সৃষ্টি হয়। তাঁর নির্মাণে ভাষা এমন একটি অপরূপ সংগতি লাভ করে যে তা কেবল তাঁর কবিতাতেই সম্ভব। অন্য কারও কবিতায় সেটা সম্ভব নয়। কবিতা সব সময় জীবন খোঁজে। অন্য কিছু নয় কবিতা জীবনের এক নির্মল স্বীকারোক্তি। আমি বিশ্বাস করি একটি মোমের মতো একদিন জ্বলে উঠবে সত্য।সময় থমকে থাকেনা। ব্যক্তি সমাজ এবং সভ্যতা উপেক্ষা করলেও কবিতা থাকবে কবিতার পাশেই।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ আপনার কিছু কবিতা অনূদিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের ম্যাগাজিনগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে ইংরেজি এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই সম্পর্কে কিছু বলুন।

সৌ্রভ শইকীয়াঃ আমার কিছু কবিতা (খুব কম সংখ্যক) পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের কিছু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এই কবিতাগুলি অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত অনুবাদক বাংলা সাহিত্যের গবেষকবাসুদেব দাস।অসমিয়া সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।কিন্তু এসব Literary Journal এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।পাঠক এবং শুভানুধ্যায়ী সুধী সমাজ আমার নির্বাচিত কবিতার একটি ইংরেজি সংকলনের অভাব অনুভব করে।বাংলা অনুবাদের একটি সংকলন প্রকাশিত হলে আমি খুবই আনন্দিত হতাম।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ কবিতার বাইরে গান এবং ছবি আপনার প্রিয় বলে জানতে পেরেছি। এই সম্পর্কে দুই চার কথা বলুন।

সৌরভ শইকীয়াঃ ভিনসেন্ট ভ্যানগঁগ যে ছবি আঁকেন, সেটা কেবল ভ্যান গঁগই পারেন। কিশোর কুমারের মতো কেউ যদি গাইতে পারবে কি? গান এবং ছবি আমার অত্যন্ত প্রিয় বিষয়।

উন্মেষ সাহিত্য সাময়িকীঃ অনেক ধন্যবাদ সৌরভ। নমস্কার।

সৌ্রভ শইকীয়াঃ নমস্কার।

 

Post a Comment

0 Comments