০২.
লাশ কোথায় পেলেন ?
লাশটা ভাটারার কাছে রাস্তার ঢালে মরে পড়েছিল। কামরান কবির বলল।
তার কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল শুভজিত। ও তো আবার ক্রাইম রিপোর্টার। রিপোর্ট করতে গেলে শব্দের মোচড় কিছু শিখতে হয়।
হাসলি যে! অলোক বলল। ওর দিকে কটমট করে তাকায় ওসি কবির ও তার সহকারী এসআই খগেন মিত্র।
না মানে লাশ যখন, সে তো মরেই পড়ে থাকবে, তাই না! এখানে আপনার বাহুল্য দোষ হয়েছে ভাই। শুভজিতের ঠোঁটে তখনও হাসির রেশ লেগে আছে। ‘লাশ মরে পড়েছিল!’
সে যাকগে, ওরা এখানে বাংলার ক্লাস করতে আসেনি। লাশখানা দেখা দরকার। অলোকেশের ইচ্ছার মূল্য দিতে তৈরি হয়ে আছে এসআই মিত্র। অলোকের কথা সে অনেক শুনেছে, এই প্রথম চাক্ষুস করলো। এতে তার জীবন যেন ধন্য হয়ে গেল।
চলুন, চলুন স্যার। সসম্ভ্রমে বলল এসআই খগেন মিত্র।
লাশ থানার বারান্দায় রেডক্রস থেকে পাওয়া সাদা কাপড়ে মুড়ে রাখা ছিল। একটু পরেই পোস্টমর্টেমের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হবে।
গোয়েন্দা-সহযোগী শুভ খানিক আগুপিছু করে। লাশ দেখতে তার কখনওই ভাল লাগে না। লাগার কথাও নয়। এ তো আর প্রিয়তমা স্ত্রী মোমতাজ মহলের জন্য সম্রাট শাজাহানের বানানো তাজমহল নয় যে বারবার দেখবে!
অলোকেশ খুব মনোযোগ দিয়ে লাশ দেখছেন। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে শুভ ওর নিকন ব্র্যান্ডের ক্যামেরাখানা আনতে ভুলে গেছে। কুছ পরোয়া নেহি। সম্প্রতি সে স্যামসাং কোম্পানির তৈরি একখানা জবরদস্ত স্মার্টফোন খরিদ করেছে। নোট-এইট। যেমন দেখতে তেমনই কার্যক্ষমতা। ঝকঝকে ছবি হয়, ক্লোজ শটে নাকের ভিতরের লোম অব্দি ধরা পড়ে।
শুভ ছবি তোলে, অলোকেশ লাশ দেখে। বাচ্চা ছেলে। এর বয়স টেনেটুনে এগারো হতে পারে, তার বেশি নয়। কী নিষ্পাপ দেখতে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এমন মাসুম বাচ্চাটাকে কেউ গলা টিপে মেরেছে! সত্যি, দিন দিন মানুষ কেমন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে!
অলোক লাশের গায়ে হাত দেন না। ছেনেকুটে দেখার নাম গোয়েন্দাগিরি নয়। আর্থার কোনান ডয়েলের বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমস প্রায়ই বলতেন, গা হাত-পা নয়, কেসের কিনারা করতে শুধু মগজ খাটাও, তাতেই চলবে।
নাহ, ছেলেটার সারা গায়ে আর কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন নেই, শুধু ওই ঘাড়ের পেছনে ছোট্ট ফুটো ছাড়া। রক্তমুখো ফুটো। মনে হয় যেন কাঁটা ফুটেছে।
ওসি কামরান কবির আঙুল তুলে লাশের গলা দেখান। গলার চারদিকে মালার মতো গোলাকার দাগ। যেন কালসিটে। নাকের ফুটোয় একটু রক্তের মতো। গলা টিপলে কখনও কখনও এমন হয়।
খগেন মিত্র সহসা বলে ফেলল, স্যার, ফাঁসটাস দেয়নি তো!
তুমি একটা গাধা! খিঁচিয়ে উঠলেন কামরান কবির। জানো না, বড়রা কথা বললে সেখানে ছোটোদের নাক গলাতে নেই। তুমি দেখছি পুরো মুণ্ডটাই গলিয়ে ফেললে! অভ্যাসটা ত্যাগ করো খগেন, নইলে ভীষণ পস্তাবে।
শুভ অবশ্য বুঝতে পারে না, ওসি সাহেব হঠাৎ এমন রেগে গেলো কেন! খগেন শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলেছে, সিদ্ধান্ত তো দেয়নি।
অলোকেশ মুচকি হাসেন। না না, খগেনের অনুমান একদম ঠিক নয়। এটা ফাঁসের দাগ নয়। কেউ ফাঁস দিলে গলায় এমন গোলকার দাগ পড়ে না। ওটা দেখতে ইংরেজি ‘ক্যারেট’ সাইন বা উল্টো ভি-এর মতো হবে। অর্থাৎ থুতনির দিকে ফাঁসের দাগ উঠে আসবে। গোলাকার দাগ দুদিক থেকে এসে ক্রস করবে না।
তাছাড়া ...?বলেই থেমে যান অলোকেশ। এটা ওর এক কৌশল। চট করে বলে দিলে তো ল্যাঠা চুকে গেল। ভাবনার আর কোনো দরজা খোলা রইলো না।
তাছাড়া কী মিস্টার অলোকেশ? উৎসুক চোখে গোয়েন্দার দিকে তাকায় ওসি কবির।
না মানে আমি মোটিভের কথা বলছিলাম। কারণ ছাড়া তো আসলে কিছু হয় না। এই ছেলের ফাঁস দেবার কোনো কারণ নেই। এইটুকুন বাচ্চার জীবনে কী এমন ঘটতে পারে যে সে মনের দুঃখে গলায় ফাঁস দেবে।
হুম। ঠিক তাই। কবির অলোকেশের সাথে একমত হয়। এটা খুন, ছেলেটাকে নির্ঘাত কেউ মেরে ফেলেছে। কী নিষ্ঠুর!
লাশ দেখা হয়ে গেলে ওসি সাহেব দুজন কনস্টেবলকে দিয়ে ওটা মর্গে পাঠালো। সুরতহাল রিপোর্ট আর ময়নাতদন্ত হবার পরে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হবে।
আরেক প্রস্থ চা এলো। সাথে টা-ও আছে। গরম গরম কলিজার সিঙাড়া, সাথে কিছু ফলমূল। অলোক অবশ্য কলিজার টুকরো মেশানো সিঙাড়া খুব একটা খান না। কারণ তিনি নিশ্চিত নন, ওটা কীসের কলিজা। মানুষ ক্রমশ যেভাবে হিংসুক আর সহিংস হয়ে উঠেছে, তাতের শত্রুকে মেরে তার কলিজা মিশিয়ে বাজার গরম করলেও তাতে কিছু আশ্চর্য হবার কারণ নেই।
কী বুঝছেন অলোকেশ ভাই? মিঠেল সুরে বলল ওসি কবির। কেসটা কী?
কী আবার! জলজ্যান্ত খুন। কিন্তু আমার প্রশ্ন, ছেলেটি কে! তার পরিচয় কিছু পেলেন? অলোকেশ আপেলে কামড় বসলেন। গ্র্যানি স্মিথ আপেল, মানে যেটা দেখতে সবুজাভ। এর মতো নির্দোষ ফল আর নেই। খেতে তত সুস্বাদু নয়, তবে উপকারী।
না না, লাশের পরিচয় এখনও পাইনি, তবে পেয়ে যাবো।
কী করে পাবেন শুনি?
দেখুন স্যার, দেশের মানুষ এখনও ততটা সস্তা হয়নি যে কেউ হারালে বা খুন হলে পরিবার পরিজন তার খোঁজ করবে না।
হুম। আর যদি কেউ না আসে? কূটতর্ক জুড়ে দেন অলোকেশ রয়। শুভ তার বন্ধুটিকে বিলক্ষণ চেনে। সে জানে, ওসি সাহেবদের ঘেঁটে তিনি বিমল আনন্দ খুঁজে পান।
আসবে আসবে। এখন কতো বাজে?
কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখেন অলোকেশ। এগারোটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। ঘড়ি দেখার মূলত দুটো কারণ। এক নম্বর হল ওসি সাহেবের প্রশ্নের উত্তর দেয়া। আর দ্বিতীয় কারণ, তাকে যেতে হবে। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বলতে না বলতে এসে গেল একজন। সরি, একজন নয় দুজন। স্বামী-স্ত্রী এসেছেন তাদের ছেলের খোঁজ নিতে।
ওই এলো। কবির সাহেব চোখের ইশারা করে।
আশ্চর্য হন অলোকেশ। ভদ্রলোক জ্যোতিষী নাকি! কে কখন আসবে তার নির্ভুল দিনক্ষণ আগে থেকে জেনে বসে আছে!
হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন আগন্তুকদ্বয়। বললেন, স্যার আমাদের বাঁচাবেন।
আমি বাঁচাবো! নিশ্চয়ই বাঁচাবো। কিন্তু আপনাদের মারছে কে শুনি! সকৌতুক বলল ওসি কামরান কবির।
স্যার, কাল রাত থেকে আমার ছেলে রূপমকে খুঁজে পাচ্ছি না। সে উধাও। রাতে বাড়ি ফেরেনি। সকালেও না।
ছেলের বয়স কত? কোন স্কুলে পড়ে?
উত্তরা মডেল স্কুল স্যার। ক্লাস ফোরে পড়তো। খুব লক্ষ্মী ছেলে স্যার। কোথায় যে গেল! ভদ্রমহিলা বলল। তার চেহারা দেখে মনে হয় তিনি ওয়ার্কিং ক্লাস নন। হয় গৃহিণী, নয়তো অফিস আদালতে চাকরি করেন।
বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে শুভর। যে ছেলেটার লাশ দেখলো, সেই ছেলেটাই রূপম নয় তো! ভাগ্যিস লাশ ততক্ষণে হাসপাতালের দিকে রওনা হয়ে গেছে।
ওসি সাহেব কী ভেবে বলল, আচ্ছা, আপনার ছেলে রূপমের পরনে কী ছিল বলুন তো?
কেন স্যার, আপনারা কি তাকে খুঁজে পেয়েছেন নাকি? কোথায় সে! কোথায় আমার সোনামাণিক?
আগে বলুন ওর পরনে কী ছিল? ধূসররঙ থ্রি কোয়ার্টার জিন্স আর সাদা টিশার্ট?
জি, জি স্যার? কোথায় সে? মহিলা প্রায় কেঁদে ফেললেন। তার কণ্ঠে স্পষ্ট বৃষ্টির আভাস।
অলোকেশ যা বোঝার বুঝলেন। তিনিও লাশ দেখেছেন। এই যে সেই রূপম, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হন তিনি। অলোকেশের ইশারা পেয়ে শুভ ওর সেলফোন নিয়ে এগিয়ে যায়। গ্যালারি থেকে ফটো বের করে বলে, দেখুন তো ম্যাডাম, এই আপনার ছেলে নাকি?
হ্যাঁ হ্যাঁ। এই তো রূপম। কিন্তু স্যার, ওর নাকে রক্তের দাগ কেন? গলাটা কেমন ফুলে আছে! ও এমন চিৎ হয়ে শুয়ে আছে কেন? ভদ্রমহিলা ভেঙে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলান। তার স্বামী ফজলু সাহেব চোখ মুছতে শুরু করেন।
আমি দুঃখিত, ও মারা গেছে। আপনার ছেলেকে কেউ মেরে ফেলেছে। ভাটারায় রাস্তার ঢালে আমরা ওর লাশ পেয়েছি আজ সকালে। যান্ত্রিক পুতুলের মতো বলল ওসি কামরান কবির। বড়সড় একটা মর্মন্তুদ দৃশ্যের জন্য প্রস্তুতি নেন অলোকেশ আর শুভজিত। এইটুকুন ছেলে অকালে মরে গেল!
অলোকের হাতে সময় নেই। ‘শয়তানি বিদ্যা’ বিষয়ক পেপারটা আজকালের মধ্যেই শেষ করতে হবে। তিনি বললেন, কবির, আপনি বরং জেরাফেরা শেষ করুন। আর হ্যাঁ, লাশের পিএম রিপোর্টটা এলে আমাকে জানাবেন। তারপর না হয় আরেকবার আমরা বসবো। আমি যদ্দুর ধারণা করছি, এটা হয় ছিনতাই কেস, নইলে ‘ফ্যামিলি ফিউড’ মানে পারিবারিক শত্রুতা। নইলে একটা মাসুম বাচ্চাকে কেউ এভাবে গলা টিপে মারবে না। তবে আমাকে সবচে বেশি ভাবাচ্ছে ভিকটিমের ঘাড়ের পেছনের ওই ছোট্ট ছিদ্রটা।
অলোকেশ বেরিয়ে গেলে ওসি সাহেব কিছু রুটিন জেরা করলো। ভদ্রলোকের নাম ফজলু, তিনি ব্যবসায়ী। ঢাকার মিরপুরে ঝুট কাপড়ের ব্যবসা তার। স্ত্রী রুবিনা একটা স্কুলে পড়ান। উত্তরা মডেল হাইস্কুল। ছেলে রূপম তার স্কুলেই পড়তো।
এসআই খগেন মিত্রকে নোট নিতে বলে জেরা শুরু করে ওসি কামরান কবির।
আপনার ছেলে কখন বাসা থেকে বেরিয়েছিল?
কাল সন্ধ্যায়। কাঁদতে কাঁদতে বললেন ফজলু সাহেব।
কেন বেরিয়েছে জানেন কিছু?
ওর বন্ধু মিঠুর জন্মদিন ছিল। আমাদের পাড়াতেই। কয়েক বিল্ডিং পরে। খুব বেশি হলে পাঁচশ গজ দূরত্বে।
চলবে...
0 Comments