Advertisement

উন্মেষ

ধারাবাহিক উপন্যাস : অপ্রণয় (প্রথম পর্ব) - অরুণ কুমার বিশ্বাস


০১.


অলোকেশ পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত। তার দম ফেলবার সময় নেই। কারণ মোনাশ ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্ন তাকে ক্রিমিনোলজির উপরে একটা পেপার উপস্থাপনের জন্য দাওয়াত করেছে। এই মাসের শেষের দিকে তাকে বাক্স-পেঁটরা গুছিয়ে অ্যাভালন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে উড়াল দিতে হবে।
     এমন জরুরি সময়ে তার পাচক কাম লোকাল গার্জেন বেচুরাম তাকে ছেড়ে গেছে। জমিজমা নিয়ে কীসের যেন গ-গোল। সেসব মেটাতে গ্রামে গেছে বেচুরাম। অলোকেশ বাধ্য হয়ে নিজের কাজ নিজেই করছেন। স্বহস্তে বানানো প্যানকেক উইদ চকলেট আর মগভর্তি কফি নিয়ে বসেছেন। এটাই তার প্রাতরাশ। সঙ্গে দুখানা ডিমসেদ্ধ। হাঁসের ডিম তার বিশেষ পছন্দ। ইহা আকারে বড়, প্রকারেও ভাল। মানে খেতে সুস্বাদু!  
    অমনি মুঠোফোন বাজে অলোকেশের। প্রিরিং! প্রিরিং! অদ্ভুত এক রিংটোন সেট করেছেন তিনি। একেবারে কানের পোকা নাড়িয়ে দেয়। এই নিয়ে উর্বীর সাথে তার কম ঝকমারি হয়নি। উর্বী মেয়েটা ভাল, তবে একটু খেয়ালি। সব সময় নয়, মাঝেসাঝে। মানে যখন তার মন খারাপ থাকে।
     কে উর্বী? ওর কথায় পরে আসছি। আপাতত কাজের কথায় আসি। উর্বী অলোকেশের সহকারী বললে কম বলা হবে, সামথিং মোর দ্যান দ্যাট। ভেরি স্পেশাল।  
   কে ফোন করেছে? কামরান কবির! উত্তরা থানার ওসি। নামখানা পূর্ণিমার চাঁদের মতোন জ¦লজ¦ল করছে তার সেলফোনের সুপরিসর স্ক্রিনে। এস নাইন। মেড বাই স্যামসাঙ।     
    কবির ভাই, বলুন কী খবর! কেমন আছেন? প্যানকেকে কামড় বসিয়ে বললেন দুঁদে ডিটেকটিভ অলোকেশ রয়।
  আমাদের আর থাকা ভাই! আদতে আছি কি নেই তাই বুঝে উঠতে পারি না। জটিল কেসে ফেঁসে গেছি তাই আপনার শরণ নেয়া। আপনি কেমন আছেন বলুন? তেলতেলে স্বরে বলল ওসি কামরান কবির।
    এর এই স্বরখানা অলোকেশ বিলক্ষণ চেনেন। বিপদে না পড়লে পুলিশ কখনও প্রাইভেট গোয়েন্দার ধার ধারে! কক্ষণো নয়। অলোক জানেন, আদতে পুলিশ কখনও বেসরকারি গোয়েন্দার বন্ধু নয়। তবে ক্যাঁচকা কলে আটকে গেলে তখন এই গোয়েন্দাকেই তার বাবা-বাছা বলে কাছে টানতে হয়।  
    এই তো আছি একরকম। অলোকেশ কেজো গলায় বললেন। সামনে একটা ফরেন ট্যুর আছে। শয়তানি বিদ্যার উপর একখানা পেপার প্রেজেন্ট করতে হবে। মেলবোর্নে। তাই নিয়ে ব্যস্ত।
    কী বিদ্যা বললেন? ওসি কবির ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সে সমানে খাবি খায়। এমন বিদ্যার কথা সে জীবনে শোনেনি।  
   অলোক চোক চোক করে খানিক হেসে তারপর বললেন, শয়তানি বিদ্যা। মানে কী বুঝলেন? খাঁটি বাংলায় বললে ক্রিমিনোলজি।
   ওসি সাহেব গোয়েন্দার কৌতুক ধরতে পেরেছে। বলে কিনা খাঁটি বাংলা। ক্রিমিনোলজি আবার বাংলা হল কবে থেকে!
যাই হোক, মুখরা শেষ করে এবার কাজের কথায় এলো ওসি কামরান কবির। সে সত্যি চিন্তিত। এক জটিল কেসে ফেঁসে গেছে! এমনই জটিল যে দিনশেষে দুচোখে ঘুমটুকুও আসে না। শুধু হাঁচি আর কাশি পায়। কাশি সামলাতে ঢক ঢক করে পানি খায়।  
বলুন, কেসটা কী এবার খুলে বলুন, আমি শুনছি। অলোকেশ খাওয়া থামিয়ে বললেন। বেঁচেবর্তে থাকলে জীবনে এমন আরো অনেক প্যানকেক বানিয়ে খেতে পারবেন। আপাতত ওসি সাহেবের কেসটা না শুনলে চলছে না।
   একটা বাচ্চা মারা গেছে। আমার অনুমান সে খুন হয়েছে।
   ছেলে না মেয়ে?
 ছেলে।  
  কোথায়? কীভাবে খুন হল? ব্যাক টু ব্যাক প্রশ্ন করেন অলোকেশ।  তার কণ্ঠে যুগপৎ উৎকণ্ঠা ও হতাশা। দেশটার আসলে হলটা কী! খুন আর নুন বেজায় সস্তা। চলতি ঘটনাবলী তাকে যেন সেই একাত্তরের কথা মনে করিয়ে দেয়। নদী-নালা ডোবা-জলাশয় সবখানে শুধু লাশ ভাসে। রক্তখেকো হায়েনা ইয়াহিয়া খানের সেই ভয়াল বিশ্রী মুখটা ভেসে ওঠে অলোকেশের দুচোখের পাতে।
     ফোনের ওপার থেকে কবির সাহেব যা বললেন তাতে খুনের বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। কবিরের কথনে ছেলেটার শরীর মোটে নিটোল নয়, সেখানে স্পষ্ট আঘাতের চিহ্ন আছে। ঘাড়ের পেছনে ছোট্ট ফুটো, আর গলার চারদিকে মালার মতো কালো দাগ। অলোক অনুমান করছেন, কেউ তাকে গলা দাবিয়ে মেরেছে। মানে গলা টিপেছে।

     আপনি আসুন একবার, অলোক ভাই। বলল ওসি কামরান কবির। তার কণ্ঠে স্পষ্ট আকুতি। যেন অলোককে পেয়ে গেলে সে ঈদের চাঁদ হাতে পাবে।
হুম! দেখছি কী করা যায়। অলোকেশ বললেন। এটা তার ভাব নয়, বরং স্বভাব। সিরিয়াস কিছু মাথায় ঢুকলে তিনি কথা বলতে ভুলে যান। অকারণ বকবকানি নয়, বরং বক্তব্য যত সংক্ষেপ করা যায় তিনি সেই চেষ্টা করেন।
হুম নয় ভাই, দয়া করে আসুন। কামরান কবির চাপাচাপি করে। অলোকেশ অনুধাবন করেন যে, ওসি সাহেবের অবস্থা কলে আটকাপড়া নেংটি ইঁদুরের চেয়ে কিছু কম সঙ্গিন নয়। সে সত্যি বিপদে পড়েছে।  
     কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখলেন অলোকেশ। আজ শুক্রবার, সকালের দিকে রাস্তায় জ্যাম একটু কম হবে। ঢাকা শহরে চলতে গেলে এখন খুব টাইম-এফিশিয়েন্ট হতে হয়, নইলে কাজের কাজ তো কিছু হয়ই না, উল্টো রোড অ্যাকসিডেন্টে প্রাণ হারানোর সমূহ সম্ভাবনা দেখা যায়।  
     তার দুজন সহকারী- ক্রাইম রিপোর্টার শুভজিত ওরফে শুভ, আর তার প্রিয়দর্শিনী বন্ধুনি উর্বী। যাকে কিনা তিনি আদর করে ‘জলপিপি’ বলে ডাকেন। এখানে বলে রাখা ভাল, গোয়েন্দা পাখি জলপিপি, প্রেমিক পাখি জলপিপি। এই দুয়ে মিলে ডিটেকটিভ অলোকেশের উর্বী। যাকে তিনি বিয়ে করবেন করবেন করছেন, কিন্তু আদতে করছেন না। সদ্য ধোয়া কাপড়ের মতো হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখছেন।
     ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের আগে ‘এস’ আসে। কললিস্ট থেকে রিপোর্টার শুভর নম্বর বের করে সেন্ড বাটন চাপলেন অলোকেশ।
তিনি বেশি কথায় না গিয়ে জাস্ট জানতে চাইলেন সে আসতে পারবে কি না। শুভ হুম বলল। লোকেশন কোথায় জেনে নিল। কারণ বিকেলে তার একটা বিশেষ নেমন্তন্ন আছে। না গেলে মাথা কাটা যাবে।  
     কী করে যাবে এতটা পথ! অলোকের নিজস্ব গাড়ি নেই। প্রাইভেট গোয়েন্দা অথচ তার ব্যক্তিগত গাড়ি থাকবে না! আদতে নেই। বস্তুত তিনি গাড়িবান নন।
   অগত্যা উবার মহাশয়। মুঠোফোনের বাটন টিপে উবার ডেনে নেন অলোক। শহরে ইদানীং যেমন পানি জমছে তাতে উবারের আদলে একটা কুবের সার্ভিস থাকলে বেশ হত। ঝড়জলে বুড়িগঙ্গা নদী উপচে শহরে উঠে এলে কুবের মাঝির শরণ নেয়া যেত।  
   অলোকের কপাল ভাল, একদম জ্যাম নেই আজ। তিন ঘণ্টার রাস্তা মাত্র ত্রিশ মিনিটে পৌঁছে যান অলোকেশ। একবার অবশ্য উবারচালককে তিনি বলেছিলেন, রোক্কে! আস্তে চালাও ভাই। জানের মায়া আছে। এখনও বিয়ে অব্দি করিনি। জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ পুরোটাই বাকি।   
    অলোকের জন্য চাতকের মতো পথ চেয়ে বসেছিল ওসি কামরান কবির। যাওয়া মাত্র খাঁটি মোষের দুধের চা এসে গেল। ইহা অখাদ্য ও রীতিমতো অস্বাস্থ্যকর জেনেও চায়ে চুমুক দেন তিনি। শুভ উসখুস করে, কারণ চায়ের কাপের রিম মানে কিনারে ময়লা। চায়ে কী যেন ভাসছে।  
    ইশারা করেন অলোকেশ। বলতে চান, ও কিছু না, খেয়ে নে। পথ চলতে গেলে অমন অনেক ময়লা টুপ করে গিলে ফেলতে হয়। দুনিয়াটা তোমার বাবার শ^শুরবাড়ি নয়, কথাটা মনে রেখো।   
   এবার বলুন ভাই, কেসটা কী? চায়ের কাপ থেকে মুখ তুলে অলোকেশ বললেন।  
লাশ পাওয়া গেছে। কিশোর ছেলে। শিশুও বলতে পারেন। বয়স আনুমানিক দশ কি এগারো। দেখে মনে হয় গেরস্থঘরের ছেলে, মানে উন্মূল শ্যাওলা নয়।
  কী বললেন! কোথাকার ছেলে! অবাক হন অলোকেশ। ওসি কবির হঠাৎ পুলিশের চাকরি বাদ দিয়ে সাহিতচর্চা ধরলেন নাকি! আশ্চর্য কা-!
   গেরস্থ অর্থাৎ ভালোঘরের ছেলে বলে মনে হল। চেহারাসুরত ভাল, চেহারায় চেকনাই আছে। মোটেও ফেলনা নয়। বক্তব্য পরিষ্কার ও বিশদ করে ওসি সাহেব।
না না, কী যেন বললেন- উন্মূল শ্যাওলা নয়। মানে কী?
মানে খুব সহজ। ছেলেটাকে দেখে টোকাইটাইপ মনে হয়নি। রফিকুন্নবীর টোকাই।
বাহ! মনে মনে খুশি হন অলোকেশ। কবিরের জানাশোনা অনেক। নিশ্চয়ই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন। নইলে টোকাই চরিত্রের স্রষ্টা যে রফিকুন্নবী এটা তার জানবার কথা নয়।
সত্যি বলতে কী, জ্ঞানী লোকের সাথে মেলামেশার মজাই আলাদা। বেহুদা সময় নষ্ট হয় না। কিছু না কিছু জানা যায়।  
লাশ কোথায়? পোস্টমর্টেমে পাঠিয়েছেন? সুরতহাল রিপোর্ট কী বলছে?
  এখনও কিছুই বলেনি ভাই। আপনাকে না দেখিয়ে লাশ কী করে মর্গে পাঠাবো! বলল কবির। অলোকেশ তাতে মৃদু তেলের অভাস পান। তেল আদতে অতীব দরকারি ও ফলদায়ক জিনিস। যিনি মোটেও তেল খান না বলে দাবি করেন, তিনি স্বয়ং সময় সুযোগ পেলে তেলের বোতলে টুকটাক চাটা দেন। তেলকে অগ্রাহ্য করার সাহস বস্তুত কারো নেই। তেল খুব সুস্বাদু ও ধন্বন্তরী, যদিও অস্বাস্থ্যকর। বেশি খেলে হার্টের বারোটা বাজে।

চলবে...

Post a Comment

0 Comments