আসলে দীর্ঘদিন থেকে পারিপাশ্বিক কিছু ঘটনা মনের ভেতর আকুপাকু করছে। চলতে, ফিরতে, নাইতে, খাইতে এমনকি মাঝে মাঝে ঘুমের বিছানায় ও একটা প্রশ্ন মনের ভেতর আকুপাকু করছে। আর সে প্রশ্নটা হলো মানুষ কি ধর্মের না ধর্ম মানুষের! আমি ধার্মিক নয়, ধর্ম সম্পর্কে আমার অগাধ জ্ঞানও নেই কিন্তু যখন দেখি আমার চেয়ে আম পারা পড়া লোকটিও ধর্ম নিয়ে নানা কথা বলে তখন মনের অলিন্দে পুষে থাকা, চলার পথে দেখা নানা অনিয়ম আর সেচ্ছাচারীতাই আমার আজকের এ প্রয়াস।
ছোট বেলায় আমরা দেখতাম শুক্রবার শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামের শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত মুসলমান মানে আমরা জুমার নামাজ পড়তাম পাড়ার মসজিদে। এতে সামাজিক বন্ধন ও সুদৃঢ হতো নামাজ আদায়ের পাশাপাশি। আর দুই ঈদে ইউনিয়ন ব্যাপী একটা কি দুইটা ঈদের জামাত হতো। নামাজ শেষে একবছর পর দেখা লোকটির সাথে ঘটতো সৌজন্য সাক্ষাত, করতো কোলাকুলি, নিত একে অপরের খোঁজ খবর, বৃদ্ধরা একে অপরের খোঁজ খবর নেওয়ার পাশাপাশি আবার মাফ চেয়ে নিতো এই বলে যে, ভাই আগামী ঈদে আবার দেখা নাও হতে পার। আল্লাহর ওয়াস্তে কোন ভুল ত্রুটি করলে মাফ করে দিবেন।
তেমন আরাধনা কামনা বাসনা আর মাফ চাওয়ার সে আনন্দটার কথা বলে বুঝাতে পারবো না।
কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে যে, সে ঈদের জামাত সব পাড়া বা গ্রামের মসজিদে মসজিদে হচ্ছে।
এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে যা জানলাম এবং বুঝলাম তার সারমর্ম এই সমাজের লোকেরা অন্য জায়গায় গিয়ে নামাজ পড়লে মুসল্লিদের নিকট থেকে ঈদ উপলক্ষ্যে আদায় করা অর্থ অন্যত্র চলে যায়।যাতে নিজের সমাজের ইমাম কিছু পায় না। আবার কেউ কেউ নিজকে বড় ইমাম প্রকাশ করতে যে আমিও ঈদের নামাজ পড়াতে পারি। তো নামাজ হলে নামাজ উপলক্ষ্যে ঈদে সবার থেকে বেশি আদায় করা যাবে এবং হুজুরের জন্য এক ভাগ, মসজিদের জন্য এক ভাগ, যে বা যারা আদায় করে তাদের জন্য এক ভাগ আবার যেখানে মাদ্রাসা আছে সেখানে মাদ্রাসার জন্য আরেক ভাগ।
হয়তো কিছু দিন পর দেখবো, ছোট হুজুর, বড় হুজুর, মেঝো হুজুর আর মোয়াজ্জমের জন্য ও ভিন্ন ভিন্ন হবে। কারণ আগে দেখতাম যে ওয়াক্তিয়া নামাজ পড়ায় সে জুম্মার নামাজও পড়ায়। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে ওয়াজ মাহফিলের জন্য অন্য বড় কোন আলেমকে আনতো।তারা চার পাঁচ ঘন্টা একাধারে ওয়াজ করতো আর মাঝে মাঝে আমরা সুযোগ পেলে দু একটা গজল গাইতাম।
আর এখন পাড়ায় পাড়ায় দিবস ছাড়াই ওয়াজ মাহফিলের এন্তেজাম হয় তাও আবার বিশ পঁচিশ দিন থেকে এখানে সেখানে হেঁটে, দাওয়াত লিফলেট দিয়ে চাঁদা তুলে অন্য জেলা থেকে মাওলানা এনে চার পাঁচটা মাইক লাগিয়ে, গেট দিয়ে বাতি জ্বালিয়ে শেষে মাওলানা সাহেব বলে এন্তেজাম কমিটির অত অত খরচ আপনারা কারা কারা দান করবেন হাত তোলেন। আমার অমুক ভাই পাঁচ হাজার, তমুক ভাই দশ হাজার দান করেছে বলুন মারহাবা। এখন কথা হলো হুজুরেরাই বলে যে ডান হাতে দান করবেন যেন বাম হাত না জানে, তো মাইকে ঘোষণা করলে কি বাম হাত জানে না?
শীত এলে এলাকার ছোটখাট দোকানদাররা দান করতে করতে ফতুর হয়ে যায়, অথবা লজ্জায় পড়ে দান করে পরে মনে মনে খারাপ মন্তব্য করে। আবার কেবল একজন নয় মাত্র পাঁচ ঘন্টা ওয়াজের জন্য তিনচার জন আলেম থাকে। শুরু করতে করতেই সময় শেষ হয়ে যায়।
এবার আসলাম টাকার কথায় অনেক আলেম নির্দিষ্ট দরদামে ওয়াজ করে। যদিও সকলে এক আল্লাহ, এক কোরআন থেকে কথা বলে, নসিহত করে কিন্তু দরদাম ভিন্ন ভিন্ন নাকি এখানেও সওয়াবের হেরফের আছে?
আবার আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে, অধিকাংশ দানকারীই অবৈধ ব্যবসায়ী, ঘুষখোর,সুদখোর বা মাদক বিক্রেতা বলে তাদের দানের পরিমানটাও অনেক বেশি। মারহাবাও খুব জোরে শোনা যায়।
আর সাধারণদের সাধ্য পরিমাণ।
তো আমার একটা সূত্র মনে পড়ে আমরা অনেকেই পরিবার সন্তান প্রতিবেশির আদর স্নেহ,ভালোবাসা উপেক্ষা করে বিদেশ যাই। সেখানে না পায় দীর্ঘদিন স্ত্রী সঙ্গ, না দেখে পুত্রের মুখ, না দেখে পিতা-মাতার মুখ তারপর আসে দুই মাস তিন মাস দেশে এসে আনন্দ করে আর আমরা যারা দেশে থাকি তারা প্রতি দিন সবার মুখ দেখি অল্প আয়ে পিতামাতা, সন্তানের মুখে অল্প তুলে অল্প অল্প সুখ লাভ করি।
তাহলে ওয়াজ মাহফিলও কি তেমন? ভিক্ষার টাকায় অযাচিৎ হাজার হাজার টাকা অপচয়। ইসলাম অপচয় পছন্দ করে কি?
রমজান মাস। রমজানে প্রায়দিন দেখতাম বাবা দুপুরের নামাজ পড়ে ইফতার সাথে নিয়ে অনেক দূর মাদ্রাসা মসজিদে যেতেন কোরআনের তাফসির শুনতে। আমরাও মাঝে মাঝে যেতাম। আর এখন রমজান এলেও সেসব দিনের মতো মনে হয় না।
আগের মানুষেরা ছিল সহজ সরল শুনতো কম মানতো বেশি আর এখন মানুষ শুনে বেশি মানে কম। কারণ ইমামেরাও এখন ধর্ম নয় নিজের স্বার্থটা আগে দেখে।
কোন কোন ইমামতো এখন বীমাও করে মানুষকে ভবিষ্যতের কথা বলে যা ইসলাম সমর্থন করে না। তাহলে কি ইসলাম পরিবর্তনশীল?
না। ইসলাম পনেরশত বছর আগে পৃথিবীতে যেভাবে এসেছে কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে ঠিক সেভাবে থাকবে অবিচল। কারন ইসলামের শাস্বত মহাগ্রন্থ আল কোরআন পরিবর্তন ও পরিবর্ধনহীন এক গ্রন্থ যাতে সন্দেহের বিন্ধুমাত্র ও অবকাশ নেই।
পথে পথে মসজিদ কিন্তু মুসল্লি নেই, মসজিদের সংখা যে হারে বাড়ছে মুসল্লি সে হারে বাড়ছে না, দান খয়রাত যে হারে বাড়ছে সে হারে মাদকাসক্ত আর মাদক ব্যবসায়ীর সংখাও বাড়ছে। না জানি একদিন অপরাধী মাদক সেবীরা অপরাধ করে গুনাহ মাপের জন্য মসজিদ দখল করে মাফের জন্য কারন আল্লাহতো রাহমানীর রহিম। রহমতের গুনে সবাইকে মাফ করবেন কিন্তু যারা পর সম্পদ ভক্ষনকারী তাদেরতো আল্লাহ মাফ দিবে না বলে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা দিয়েছেন।
এখনতো পর সম্পদ ভক্ষনকারীর সংখাও বাড়ছে, বাড়ছে ঘুষখোর, জ্বীনা-ব্যভিচারী, সুদখোর। তারা বলবে আমরা ভালো আর তখন ভালোরা তাদের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে হয়তো মসজিদ ছাড়বে।
অনেক ইমামতো আবার মানুষের বাড়ি বাড়ি খেতে গিয়ে আল্লাহ নবী রাসুল ধর্মের কথা বলে ঝাড় ফুঁকের নামে ভিতর বাড়ি ডুকে যুবতী মেয়ে, মহিলাদের বলাৎকারও করে। ধর্মে যা আছে তার তোয়াক্কা না করে রাত এগারো বারোটা পর্যন্ত অন্যের ঘরে বসে নানা ফন্দি ফিকির করে। প্রয়োজনে নানা ভাবে প্রলোভিত ও করে।
তাছাড়া ইমাম, মাস্টার, ডাক্তার কবিরাজ সকল শ্রেণীর পেশার মানুষের নিকট ও ক্ষুধা,তৃষ্ণা, লোভ, কাম, ক্রোধের দেবতারা ও আসে। কেহ এসবের উর্ধ্বে নয়।
সময়ে এসব না ভাবলে, এসবের কার্য কারণ না জানলে বৃথা হবে পরে কেঁদে। যৌবনের ধর্ম সবারই কিন্তু এক কেউ সহজে প্রকাশ করে আর কেউ কৌশলের আশ্রয় নেয়।
তো যারা নতুন নতুন নিয়ম বের করে তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি আমি গুনাহগার বান্দা তা বুঝার চেষ্টা করছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল মুমিন মুসলমানকে সহজ-সরল সঠিক ও পূণ্যের পথে পরিচালিত করার তাওফিক দান করে সে প্রার্থনায়। ভুল গুলো মার্জনা করে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সে কামনায়।
লেখক: ইউসুফ মাহমুদ সংগ্রাম
কবি ও উপন্যাসিক।
0 Comments