সকালে বেশ খানিকটা বৃষ্টি হয়েছে।এখন ঝলমলে রোদ মিউনিসিপালিটির
রাস্তা
দীর্ঘদিন
মেরামত
করা
হয়
নাই
পুরো
রাস্তাজুড়ে
খানাখন্দভরা
সেগুলোতে
পানি
জমে
আছে। রোদের তেজ বেশ করা তাই গরমও শুরু হয়ে গিয়েছে একদম ভ্যাপসা গরম। এই ভাঙা রাস্তার একপাশ দিয়ে অতি সন্তপর্ণে হেটে হেটে পথ চলছিলেন সোবাহান সাহেব। সামনেই একটা মোড় সেখানে মিউনিসিপালিটি
নির্ধারিত
রিকশা
স্ট্যান্ড
সোবহান
সাহেবের
উদ্দেশ্য
মোড়ে
গিয়ে
একটা
রিকশা
নেওয়া।বৃষ্টি কিছুক্ষণ আগেই থেমে যাওয়ার কারণে পাড়ার সব চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষ একবারেই বের হয়েছে সেকারণেই হয়তো আজকে রিকশাস্ট্যান্ড
ফাকা। এইমোড়ে একটা অনেক পুরনো বটগাছ আছে বেশ ছায়া দেয়। সেই ছায়ার মধ্যেই এক রিকশাওয়ালা তার সীটে বসে হেলান দিয়ে চা আর বিড়ি খাচ্ছিলেন।সোবহান সাহেব তাকে বললেন এই রিকশা যাবে? রিকশাওয়ালা কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই বললো সকালের প্রথম বিড়ি ধরাইলাম স্যার একটু আরাম কইরা শ্যাষ করি তারপর যামু।
প্রায় একমিনিট লাগলো রিকশাওয়ালার বিড়ি শেষ করতে। তারপর সোবহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, উইঠা পরেন চাচা আপনারে উড়াল দিয়া নিয়া যামু।দূর্বল শরীর নিয়ে রিকশায় উঠে পড়েন সোবহান সাহেব রিকশাওয়ালাকে বলেন সোনালী ব্যাংকে নিয়ে চলো। রিকশা অত্যান্ত বাজে ভাবে চলছে রাস্তার খানাখন্দের উপর দিয়েও অনেক জোরে যাচ্ছে দুইবার ব্যাথাও পান সোবহান সাহেব রিকশাওয়ালাকে বলেন, এই আস্তে চলো। দশ মিনিট পরে রিকশা সোনালি ব্যাংকের সামনে এসে দাড়ায়। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে আস্তে আস্তে ব্যাংকের ভিতর ঢুকে পড়েন তিনি। আজকে ব্যাংকে অনেক ভীড় সোবহান সাহেব তার পেনশনের টাকা উঠাতে এসেছেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার প্রায় পনেরো বছর হয়ে গিয়েছে। আজকে প্রায় চারমাস পরে ব্যাংকে আসলেন টাকা উঠাতে আসলে তার টাকার খুব একটা প্রয়োজন পরে না। স্ত্রী মারা গিয়েছে কয়েক বছর আগে মেয়ের সাথে থাকেন মেয়ে একটা সরকারি কলেজের শিক্ষক। অনেক যত্ন করে তার। মেজো ছেলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকে সেও সবসময় খবর রাখেন রিটায়ার্ড মেন্টের টাকার সঞ্চয় পত্র কেনা আছে তার লভ্যাংশই তিনি খরচ করতে পারেন না। তবুও ব্যাংকে এসেছেন আজকে তার কারণ এই টাকা উঠাতে আসলে অনেক পরিচিত কলিগদের সাথে দেখা হয় গল্প হয় সবাই প্রায় বুড়ো হয়ে গিয়েছে। কত স্মৃতির গল্প করেন তারা একসাথে চা খান মনে হয় অনেক আগে কর্মক্ষেত্রে সামান্য ফাঁকি দিয়ে বসের চোখ লুকিয়ে কোন টংয়ের দোকানে বসে তারা চা খাচ্ছেন তখন যৌবন ছিলো, উদ্দাম ছিলো। কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়াতেই আলতাফ সাহেবের সাথে দেখা হয় তিনিও লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি সোবহান সাহেবের বস ছিলেন। একটা সরকারি অফিসের সামান্য কর্মচারী ছিলেন সোবহান সাহেব। আলতাফ সাহেবকে তার পিছনে দেখে ভীষণ লজ্জা পান তিনি অনেকটা জোর করেই তার সামনে তাকে দাঁড়িয়ে দেন। মনে মনে ভীষণ তৃপ্তি পায় সোবহান সাহেব তার চাকরি জীবনে আলতাফ সাহেবের মত সৎ অফিসার তিনি দেখেননি। টাকা উঠিয়ে ব্যাংকের নীচে নামেন তিনি একসময়ের সহকর্মী রশিদের সাথে দেখা হয় ভীষণ শুকিয়ে গিয়েছে রশিদ অসুস্থতায় আর দুশ্চিন্তায় অথচ কত আমুদে ছিলো এই রশীদ।
বয়সে সোবহান সাহেবের দুইবছরের জুনিয়র। সোবহানকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে রশিদ। বলে ভাই অনেকদিন পরে আপনাকে দেখলাম ইদানীং শরীরটা ভালো না ভূল ত্রুটি হলে ক্ষমা করে দিয়েন। সোবহান জানে রশিদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না ছেলেপুলে গুলো প্রায় সবাই বেকার। বড় ছেলেটা রিটায়ার্ড মেন্টের সব টাকা নষ্ট করেছে। ভীষণ মায়া হয় রশিদের জন্য পকেট থেকে দুইহাজার টাকা রশিদকে দিয়ে দেন তিনি বলেন ফলমূল কিনে নিয়ে বাড়িতে যেও। শরীরের একি হাল তোমার? আর কোন সমস্যা হলে বাসায় এসো। রশিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা রিকশা নেন সোবহান সাহেব। রিকশাওয়ালা তাকে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করে চাচা কোথায় যাবেন? কোন উত্তর দেয়না সোবহান সাহবে বলে, তুমি চালাও আজকে আমি পুরো শহরটা ঘুরবো তোমার রিকশায়। আসলে আজকে তার ভীষণ ঘুরতে ইচ্ছে করছে। শহরটার কত পরিবর্তন আগে ছোট্ট একটা রাস্তার উপরে শহর ছিলো এখন চারদিকে কত মানুষ আর কত যানবাহন। আলেয়াকে যখন বিয়ে করেন তখন মাত্র ১৫০০ টাকা বেতন পেতেন দুজন মানুষের সংসার ছিলো। বেতন পেয়ে প্রতি মাসেই তিনি আলেয়ার জন্য নতুন একটা কাপড় কিনতেন। কি যে খুশি হতো সে!তারপর প্রথম সন্তান শফিকের জন্ম তারপর আরও দুইজন দেখতে দেখতে সংসার বাড়লেও বেতন বাড়েনি। তাই প্রতিমাসে আলেয়ার শাড়ি আর কেনা হতো না দুই একমাস পর সর্বোচ্চ দুই- তিনটা ব্লাউজ পিস কেনা হতো তাতেই কি খুশি হতো সে! তখন নিজেকে মনে হতো দুনিয়ার সেরা স্বামী।ছেলেমেয়েদের কাছে সোবহান সাহেবের বেতনের দিন মানে অন্যকিছু ছিলো সেদিন তিনি মিষ্টি কিনতেন, বড় ইলিশ মাছ কিনতেন ছেলেমেয়েরা অপেক্ষায় থাকতো বাবা কখন আসবে? মাসে এই একটা দিনই তিনি ছেলেমেয়েদের জন্য মিষ্টি কিনতে পারতেন। বাড়ির গেটের কাছে এসেই তিনি বড় ছেলে শফিকের নাম ধরে ডাকতেন সাথে সাথে তিন ছেলেমেয়েই দৌড়ে আসতো কেউ মিষ্টির প্যাকেট নিতো কেউবা বাজারের। বেতনের পুরো টাকাটাই তিনি আলেয়ার হাতে তুলে দিতেন মহিলাটা তাই দিয়ে কিভাবে যে সংসার এতো সুন্দর করে চালাতেন সোবহান সাহেব এই বয়সে এসেও অবাক হন।তখন অভাব ছিলো কিন্তু তাতে কত যে সুখ ছিলো। এসব কথা ভাবতেই ভাবতেই চোখ দিয়ে জল গাড়িয়ে আসে সোবহান সাহেবের। তিনি আকাশের দিকে তাকান আকাশে আবার প্রচন্ড মেঘ করেছে এইকথা ভাবতেই বৃষ্টি শুরু হয়। রিকশাওয়ালা তাকে একটা দোকানে নামিয়ে দেয় আরও অনেক লোক দৌড়ে দোকানের ভিতরে ঢুকলো। দোকানে একটা সাইনবোর্ড তাতে লেখা এখানে বিকাশে টাকা পাঠানো হয়। বড় ছেলে শফিকের কথা ভীষণ মনে পড়ে শফিকের ছেলেটার সাথে যোগাযোগ নাই অনেকদিন ধরে। তার এই ছেলেটাকে তিনি কখনোই বুঝতে পারেননি, তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে সেই যে কান্নাকাটি করে চলে গিয়েছে আর আসেনি, একটা মোবাইল নাম্বার ছিলো দুইবছর থেকে বন্ধ। এই ছেলেটা তার কাছে থেকে কখনোই কিছু চায়নি। আজকে তার ইচ্ছা হচ্ছে শফিককে সব টাকা মোবাইলে দিয়ে বলি তুই না আমার রাজপুত্র ছেলে ছিলি ধর রাজপুত্রের মতো খরচ কর। ভীষণ আনমনা হয়ে যান সোবহান সাহবে তার চশমার গ্লাস চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে আসছে সেই ঝাপসা চোখে তিনি দেখেন শফিক এখন যে শহরে আছে সে শহরেও নিশ্চয়ই বৃষ্টি হচ্ছে আর ছেলেটা সেই শহরের রাস্তায় বুঝি বৃষ্টিতে ভিজছে আর হাঁটছে...
চলবে...
লেখকঃ আরজ আলী মাতুব্বর
সোনাতলা, বগুড়া।
0 Comments