মাকে দেখাবো।
‘মাকে দেখাবে?’
‘হুম’..
‘ঝাড়ু মেরে গল্পের রস বের করবে।’ ‘
গল্পে রস থাকলে তা যে করেই হোক বের হবে। লিখে দেবে কিনা বলো।’
‘পারবো না লিয়া.. ভয় করে।’
‘সৃষ্টির আদি হতে অন্ত লিখো,
প্রেমের গল্প লিখতে বলেছি, পারবে না। কাট্টি কাট্টি কাট্টি। লিয়া সোজা হয়ে বসলো।’ ‘পিরিত বড় অদ্ভুত বিষয় গো।
মায়া রাজ্যে দুটি মন.. ওদের শান্তিতে থাকতে দাও!’
‘সিগারেট দেবো স্যার?’
‘তোর স্যার সিগারেট খায় না, গাঁজা খায়।
আছে?’
‘জ্বি না।’
‘তো ভাগ.. গাঁজাখোড় গুলো।’
লিখে দেবে না?
‘আচ্ছা দেবো।’
লিয়া হাসে, যে হাসিতে মাঝ নিশুতির বাদলা ঝরে মন উঠোনে।
‘সন্ধে হয়ে এসেছে। আমি তবে যাই।’
কৌশিক হাত ধরলো, ‘সন্ধে এখনো বাকি.. যেয়ো না!’
‘কি করবে পাশে থাকলে?’
‘চুমু দেবো।’
‘তো দাও না!’
কৌশিক দূরে সরে যায়। লিয়া হাসে। হঠাৎ মেঘ ডাকে আকাশে। মেঘের ডাকে লিয়া শুকিয়ে যায়। বিষয়টা ইদানিং খেয়াল করেছে কৌশিক। ‘মেঘের ডাকে কেন এতো ভয়?’ লিয়া কথা বলে না. ভীত চোখে তাকিয়ে থাকে..
“ কিছু বলবে মা?
‘কী বলতে চাই তুই জানিস। কথাটা আজ বলে দে। আমাদের শান্তি দে।’
‘বোসো মা ভাত খাও। এসো খাইয়ে দিই। আমার হাতে খাবে মা, ঘেন্না করে?’
নাহার বেগম সামলাতে পারলেন না। মেয়ের গালে স্বজোরে চর বসালেন। লিয়ার মুখের ভাত ছিটে পড়লো দূরে। আকস্মীক ঘটনায় লিয়া স্তব্ধ। পাতের ভাত ফেলে দোঁড়ে পালালো ছাদে। কপালে তার চিন্তার ভাঁজ। বড় এক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে তার জন্য। যদিও সে জানে এ দুঃসংবাদ নয়, যা পৃথিবীর জন্য সু সংবাদ। পোড়া চোখে জল ছল ছল করে। সেই জল ছল ছল চোখে দেখে, গেটের সামনে যুবকটি এখনো দাঁড়িয়ে। অভ্যাসের পরিবর্তনে মানুষ কষ্ট পায়, দুঃখ বোধ করে। লিয়া সেই মানুষ হতে ভিন্ন। এ কারণে ন’মাস পূর্বে মেঘ দেবতা ডেকে বলেছিলো,
‘তোমার উপর মেঘের গোপন ইচ্ছে পূরণ হবে।’
লিয়া হেসে বলেছিলো, কেন? মেঘ দেবতা এর উত্তর দেয় নি, নিঃশব্দ ছিলো।
‘মেঘ দেবতার ইচ্ছে’ তো সহজ সাধ্য নয়। বড় তিতিক্ষার বিষয়, অসাধ্য সাধনের বিষয়। লিয়া সেই অসাধ্য সাধন করলো। ফল যা হবার হলোও তাই। পৃথিবীর মানুষ তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। সমাজ থেকে করলো আলাদা। আলাদা হবার অবশ্যই কারণ রয়েছে। তবে সেই কারণ সেকান্দার শেখ বলতে চান না। লজ্বায় মাথা কাটা যায়। মসজিদে সন্ধে আজান হলো। ‘এসো সত্যের পথে।’ লিয়া ওড়না মাথায় দিলো। হলদে আলো জ্বলে উঠলো রাস্তায়। সাদা টুপি মাথায় লোকজন রওনা হয়েছে মসজিদে। ওদিকে দৃষ্টি যেতেই চোখে পরলো যুবকটিকে। এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো যুবকটি কাঁদছে। তার চোখ হতে জল গড়িয়ে পড়ছে। এটি ভুল, এটি মিথ্যে.. লিয়া দৌঁড়ে নিচে নেমে এলো। শোবার ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে। সন্ধে বাতি দেয়া হয় নি। সুইচ অন করতেই বিদ্যুৎ গেলো চলে। ঘর হলো অন্ধকার। পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে মোম রাখা আছে। সেদিকে যেতেই শক্ত কিছুর সাথে পা আটকে পরলো। ধাই সামলাতে না পেরে লিয়া আছড়ে পরলো মেঝেতে। এ পর্যায়ে ঘটলো আশ্চর্য ঘটনা। এক অন্ধকার শরীর উঠে দাঁড়িয়ে লিয়ার পেটে স্বজোড়ে লাথি বসালো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘কেন বেঁচে আছিস? তোর মৃত্যু আমাকে শান্তি দেয়। কেন বেঁচে আছিস এখনো?’ কথাগুলো বলে অন্ধকার শরীর অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। লিয়া মেঝেতে উবু হয়ে পড়ে আছে। পেটের নিচটায় প্রচন্ড ব্যাথা, পৃথিবী অন্ধকার করা ব্যাথা। দম চেপে আছে, ব্যাথা উপশমের অপেক্ষা করছে। অথচ সময়ের সাথে ব্যাথাটা বেড়ে চলেছে। লিয়া মাকে ডাক দিলো। বুদ্ধিমতি মায়ের বুঝতে দেরি হলো না, মেয়ের প্রসব ব্যাথা উঠেছে। নিয়ে যাওয়া হলো রান্না ঘরে। খবর পেয়ে সেকান্দার সাহেব ছুঁটে এলেন। মেয়ে রান্না ঘরের মেঝেতে প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে। মা উদ্গ্রীব হয়ে বললেন, ‘এখন কি করবে?’ ‘হারামজাদিকে হসপিটালে নিয়ে যাই!’ ‘ডাক্তার হসপিটাল করলে চলবে না।’ সেকান্দার সাহেব কথা বললেন না। এক গোছা পাটের দড়ি সঙ্গে নিয়ে রুমে ঢুকলেন। দড়ি নেবার ঘটনাটা সাহিদা দেখে নিলো। বন্ধ জানালার ফাঁকে চোখ রেখে শীতল অনুভুতি নেমে গেলো শরীর বেয়ে। সেকান্দার শেখ সিলিং ফ্যানে দড়ি ঝোলাতে শুরু করেছেন। সাহিদা নিরুপায় হয়ে বললো,
‘চাচাজী কী করেন, মইরা যাবেন তো।
দরজা খোলেন, ও চাচাজী দরজা খোলেন।’
ততক্ষণে সেকান্দার শেখ খেয়াল করলেন, পায়ের নিচের মোড়াটা নড়তে শুরু করেছে। ওদিকে লিয়া গোঙাতে গোঙাতে বলছে,
‘মা, মাগো আর পারছি না। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’
‘চুপ, চুপ কর মাগী! মস্তি করার সময় মনে ছিলো না?’
এমন কথা বলো না মা। আমি আবারো বলছি, আমার সন্তানের বাবা নেই। কেন বিশ্বাস করছো না মা? তুমি দেখো এ সন্তান একদিন পৃথিবী জয় করবে। পৃথিবী জয়ের জন্যই ও আমার পেটে এসেছে। ও যেদিন এসেছে, সে রাতে আমি সপ্ন দেখেছি। একটি জোতির্ময় মুখ... লিয়ার আর কথা বলতে পারছে না, কথা জড়িয়ে আসছে। প্রসব ব্যাথায় ছটফট করছে। নাহার বেগম বসে আছেন। ও’ঘর হতে সাহিদার ডাকাডাকি কানে আসছে। সাহিদা অমন করে ডাকছে কেন?” মৃত গল্পেরা ঘুমিয়ে রয় বিছানায়। গা ছমছমে পূর্ণী প্রহরে যখন পৃথিবী ভাসে জোছনায়, যুক্তিকে তখন অযৌক্তিক মনে হয়। জানালার সাদা পর্দা উড়িয়ে মায়াবতী ঢোকে ঘরে, ঘরে ঢোকে শীতল বাতাস হয়ে। ঘুম ভেঙে উঠে বসে কৌশিক। দেখে, মায়াবতী জানালার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, ভেসে যাওয়া জোছনা পড়েছে তার মুখে। সেই মায়ার বর্ণণা করা যায় না। অচিনপুরে মাতাল বাঁশি বাঁজে। ‘কেন এতো ভালোবাসো আমায়?’ কৌশিকের কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে রয়। সে জানে, লিয়া বাস্তব নয়, জোছনা রাতে রূপকারের আাঁকা ছবি। কেন এমন বলছো? আমি তোমার কল্পনা? জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আমি কল্পনা? কৌশিকের চোখ ভিজে বারেবার। বলতে কষ্ট হয়, লিয়া তুমি আমার কল্পনা। পরাবাস্তবতায় লিখা গল্প। (যদিও এখান হতেই নতুন এক গল্পের জন্ম হয়।)
প্রথম পর্ব
লেখকঃ শোয়েব সাইফী
0 Comments